• " />

     

    অতিমানবের মানবীয় যাত্রা

    অতিমানবের মানবীয় যাত্রা    

    সেঞ্চুরিয়নে সাকিব আল হাসান যেন মর্ত্যে নামিয়ে আনলেন তাঁকে। শূন্য রানেও যে টেস্টের কোনো ইনিংসে আউট হওয়া যায়, এবি ডি ভিলিয়ার্স যেন জানতেনই না! টানা ৭৮ ইনিংস ‘ডাক’বিহীন থাকার পর অবশেষে স্ট্যাম্পড হলেন, শূন্য রানেই। প্রথম টেস্টেও ডাউন দ্য গ্রাউন্ডে এসে মারতে গিয়ে আউট হয়েছিলেন, একই ভুল ঠিক পরের টেস্টেই করলেন আবার। এবি ডি ভিলিয়ার্স যেন জানান দিলেন, তিনি ‘অতিমানব’ নন, নিতান্তই মানুষ।


    যেমন তিনি ক্রিকেটকেই বেছেছিলেন। টেনিস, গলফ বা রাগবিকে বাদ দিয়ে। একসাথে তো আর সবকিছুর শীর্ষে পৌঁছানো যায় না! তবে ক্রিকেটের শীর্ষপর্যায়ে খেলা শুরুর সময় থেকেই দক্ষিণ আফ্রিকার ভবিষ্যত ভাবা হয়েছে তাঁকে। দক্ষিণ আফ্রিকার সর্বোচ্চ টেস্ট রানের ইনিংস নিজের করে নিয়েছিলেন। গ্রায়েম স্মিথের সে রেকর্ড ভেঙ্গে সে ইনিংসটা তাঁকেই উৎসর্গ করেছিলেন! কখনও খেলেছেন ম্যাচ জেতানো ইনিংস(২০১২ সালে অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে দ্বিতীয় ইনিংসে করেছিলেন ১৮৪ বলে ১৬৯ রান), কখনও খেলেছেন ম্যাচ বাঁচানো ইনিংস(২০১৩ সালে ভারতের সঙ্গে চতুর্থ ইনিংসে ১৬৮ বলে ১০৩ রান)। কখনও আবার ম্যাচ বাঁচাতে করেছেন ২২০ বলে ৩৩ রান(ডু প্লেসির রাজকীয় অভিষেক, অ্যাডিলেড, ২০১২)। ডি ভিলিয়ার্স অভিষেকের পর থেকে টানা ৯৮ টেস্ট খেলেছেন, অতিমানবের মতো। পিতৃত্বের ডাকে ছুটতে হয়েছে এরপর, নিতান্ত মানুষের মতো। চোটের সংগেও এক অতিমানবীয় ইনিংস খেলা শুরু করেছিলেন।


     

    আট মাস চোটগুলোকে বয়ে নিয়ে বেড়িয়েছিলেন। টেস্ট, ওয়ানডে, টি-টোয়েন্টি। আইপিএল। সিপিএল। ভেবেছিলেন, চোটকে হার মানিয়ে খেলেই যাবেন। খেলেই যাবেন সবকিছুকে তুচ্ছ করে। তাঁকে আউট করার উপায় বের করতে হাপিত্যেশ করে মরবে প্রতিপক্ষ। তিনি ছাড়িয়ে যাবেন শুধু নিজেকে! সেই তাঁকেই হার মানতে হলো। এবি ডি ভিলিয়ার্স যেন ‘অতিমানব’ থেকে ‘মানব’ হয়ে ছিটকে গেলেন ক্রিকেট থেকে। অনেক সাধের টেস্ট অধিনায়কত্বের স্বাদটা পেলেন শুধু দুই ম্যাচের জন্যই। মাঠের বাইরে বসেই দেখলেন, তাঁর সতীর্থরা টেস্ট র‍্যাংকিংয়ের ৭ নম্বর থেকে কিভাবে ৩ নম্বরে তুলে আনলো ‘তাঁর’ দলটাকে। মাঠের বাইরে থেকেই তাই অধিনায়কত্বটা ছেড়ে দিলেন ফাফ ডু প্লেসির কাছে।

     


    তিন ফরম্যাট। বিশ্বভ্রমণ। শরীরে আর কতো সয়! আর আছে চাপ। সব মিলিয়ে যেন কাঁধের ওপর চেপে বসেছে পৃথিবীসম ভার! ক্যারিয়ারের কোনদিকে কোন অর্জনের পেছনে ছুটবেন, ডি ভিলিয়ার্স যেন ঠিক করে উঠতে পারছেন না সেটাই!


    প্রায় ছয় মাস মাঠের বাইরে থেকে ফিরলেন। ফিরলেন, কিন্তু ফিরলেন না যেন! আপাতত ওয়ানডে আর টি-টোয়েন্টিই খেলবেন। নিউজিল্যান্ড সিরিজ, ইংল্যান্ড সিরিজ, বাংলাদেশের সঙ্গে দেশের মাটির সিরিজের কোনোটিতেই সাদা পোশাকে দেখা যাবে না তাঁকে। বছরের শেষের দিকে ভারতের সঙ্গে সিরিজের পর অস্ট্রেলিয়া, ডি ভিলিয়ার্সের লক্ষ্য এখন সেই আট টেস্টে খেলা। সে দুই সিরিজে খেলার মতো শারীরিক অবস্থায় না থাকলে বিদায়ই বলে দিবেন। এর আগে চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি আছে, আছে আইপিএল।

     

    অন্য কোনো টি-টোয়েন্টি টুর্নামেন্টে না খেললেও আইপিএলকে ‘না বলার মতো অবস্থায় নেই’ তিনি।

     

    ২০১৯ এর বিশ্বকাপের দিকেও চেয়ে আছেন। ডি ভিলিয়ার্স প্রোটিয়া বিশ্বকাপের স্বপ্নটা আরেকবার বয়ে নিতে চান। ২০১৫ সালের বিশ্বকাপে যেমন নিয়েছিলেন। তারও আগে, উইকেটকিপিংয়ের ভারটা নিতে পারছিলেন না। কুইন্টন ডি ককের ওপর সে ভার ছেড়ে দিয়ে মনোযোগ দিলেন দলের নেতৃত্বে। অনেক আরাধ্য বিশ্বকাপকে করলেন পাখির চোখ। সেমিফাইনালে গ্রান্ট এলিয়ট যেন হয়ে উঠলেন ‘অতিমানব’, রান-আউটের সুবর্ণ সুযোগ মিস করে আর ম্যাচশেষে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে ডি ভিলিয়ার্স হয়ে গেলেন নিতান্ত এক মানুষ। আর দশজন সতীর্থের মতো তিনিও মুষড়ে পড়লেন, স্বপ্নভঙ্গের বেদনায়!


    আর দশজন ক্রিকেটারের মতোই এখন টেস্ট ক্রিকেটে ফিরতে হলেও পারফর্ম করেই ফিরতে হবে ডি ভিলিয়ার্সের মতো ‘অতিমানব’কেও। জ্যাক ক্যালিসকে ক্যারিয়ারের শেষদিকে সুযোগ দেয়া হয়েছিল নিজের পছন্দমতো টেস্ট সিরিজ খেলার। ভিলিয়ার্স সে সুযোগ পাবেন না। আপাতত তাই দলই মুখ্য। লক্ষ্য সীমিত ওভারে খেলা চালিয়ে যাওয়া, ওয়ানডেতে নেতৃত্ব দেয়া।

     

    ডি ভিলিয়ার্স কতোদূর যাবেন, সেটা বলবে সময়। যে কোনো দিকে যে কোনো শট খেলা ব্যাটসম্যান আর কতোদিন আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ব্যাটিং করে যাবেন, সেজন্য অপেক্ষা করতে হবে সময়ের। অনুপম ফিল্ডিংয়ের পসরা সাজানো ফিল্ডারের আর কী কী দেখানো বাকী আছে, সেটাও বলবে ওই সময়ই। ওয়ানডেতে দ্রুততম ফিফটি, সেঞ্চুরি, দেড়শ রানের মতো অতিমানবীয় কীর্তির আর কী বাকি, সেটার উত্তরও সময়ের কাছেই। সে সময়টা হয়তো খুব বেশী নেই, অথবা আছে পর্যাপ্ত!

     

    আব্রাহাম বেঞ্জামিন ডি ভিলিয়ার্স নামের এক ক্রিকেটীয় ‘অতিমানব’-এর কাছে যে সামনের ১২ মাসের সময়টাই খুব গুরুত্বপূর্ণ, নিতান্ত এক ‘মানব’-এর মতো!