• " />

     

    অতৃপ্তির তৃপ্তিটা কই!

    অতৃপ্তির তৃপ্তিটা কই!    

    ১.

    ‘আমার তো সেট হতেই লাগে ছয় ওভার। খেলা মোটে আট ওভারের, আমি কী খেলবো রে ভাই!’ কথাটাতে কী খুঁজবেন? শ্লেষ, আক্ষেপ নাকি নিতান্তই অসহায়ত্ব? নাকি অন্যকিছু? বছর দশেক আগে নির্মাণ স্কুলের এক অধিনায়ক বলেছিলেন কথাটা, নিতান্তই কোনো বন্ধুত্বমূলক আড্ডায়।

     

    তখনও টি-টোয়েন্টি পেখম মেলেনি আজকের মতো। প্রথম কোনো টি-টোয়েন্টি ম্যাচ দেখে তাই সবার অনুভূতি একই ছিল বোধহয়, হচ্ছেটা কী আসলে! এতদিনের ক্রিকেট যেন বদলে গেছে। চোখের পলকে  শেষ হয়ে গেল তো পুরো ম্যাচটাই! ওভারের পর ওভার বল করার বালাই নেই, ধীরে ধীরে সেট হওয়ার ‘আভিজাত্য’ নেই। অতি আক্রমণাত্মক ফিল্ডিং সাজানোর ‘বিলাসিতা’ খুঁজে পাওয়াও দায়! ক্রিস কেয়ার্নসরা প্রথম আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টিতে যখন আশির দশকের সাজে নামেন, বেশ একটা পিকনিকের আমেজ মেলে! গ্লেন ম্যাকগ্রা যখন ট্রেভর চ্যাপেলের মত ‘আন্ডার-আর্ম’ বোলিং করতে যান, মনে হয়, টি-টোয়েন্টিতে তো আসলে ‘সিরিয়াস’ হওয়ার কিছু নেই! অর্জুনা রানাতুঙ্গা যখন বলে বসেন টি-টোয়েন্টি ‘তিন মিনিটের ম্যাগি নুডুলস’, দ্বিমত পোষণের সুযোগ থাকে না!

     

    কেয়ার্নসদের পরচুলা হারিয়ে গেছে। ম্যাকগ্রার আন্ডার-আর্ম করতে যাওয়ার মজাও কেউ করেন না আর! স্টিভ স্মিথ মাঠ থেকে মাইক্রোফোনে কথা বলতে বলতে আউট হয়ে গেলে রব ওঠে তাই, টি-টোয়েন্টি অস্ট্রেলিয়ানরা ‘সিরিয়াসলি’ নেয় না। শোকেসে তাই হয়তো এই স্মারকটা নেই অজিদের!

     

    অস্ট্রেলিয়া আসলেই হয়তো টি-টোয়েন্টিকে অন্যভাবে নেয়! ভারতের সঙ্গে টেস্ট খেলতে স্টিভেন স্মিথের দল যখন ভারতে, দেশের মাটিতেই তখন শ্রীলঙ্কার সঙ্গে খেলছে আরেক অস্ট্রেলিয়া!

    টি-টোয়েন্টি যখন 'ফান' ছিল 

     

    ২.

    টি-টোয়েন্টির বিশ্বসেরা হওয়ার স্মারকের মতো টি-টোয়েন্টির জন্মের সময়েও অস্ট্রেলিয়া নেই সেভাবে! যেভাবে ওয়ানডের বিপ্লবে ছিল ‘ডাউন-আন্ডার’ এর এক ভদ্রলোক, কেরি প্যাকার। তবে টি-টোয়েন্টির বর্ণনায় আপনি আনতে পারেন রবীন্দ্রনাথকে, ‘ছোট প্রাণ, ছোট ব্যথা; ছোট ছোট দুঃখ কথা’...। টি-টোয়েন্টি তো ক্রিকেটের ছোটগল্পই! বিশাল কলেবর নেই। অতি বর্ণনার বালাই নেই। তবে ব্যাপকতা আছে, আছে গ্রহণযোগ্যতা।

     

    এই বিস্তৃতিই নাকি ক্রিকেট প্রসারের হাতিয়ার। আটলান্টিকের ওই পাড়ে ক্রিকেট নিয়ে যেতে হলে খেলতে হবে টি-টোয়েন্টিই। একটা খেলা সারাদিন ধরে হয়, কিংবা হয় পাঁচদিন ধরে, খেলা বোঝার আগেই তো আগ্রহ হারিয়ে যাবে! টি-টোয়েন্টির আবির্ভাবেও কিন্তু এই আগ্রহেরই ‘অবদান’। ইংলিশ ক্রিকেটে দর্শকসংখ্যা কমে যাচ্ছে, স্কুলপড়ুয়াদের আগ্রহ কমে যাচ্ছে ব্যাপকহারে। উপায়? সময় কমিয়ে আনো, কমিয়ে আনো ওভার। প্রতিদ্বন্দ্বিতা বাড়বে। জমজমাট লড়াই হবে কাউন্টিগুলোর মাঝে!

     

    টি-টোয়েন্টি স্বীকৃতি পেলো অনেক কাঠখড় পোড়ানোর পর। ২০০৩ সালে যখন অস্ট্রেলিয়া টানা দ্বিতীয় বিশ্বকাপ জিতলো, সে বছরেরই ১৩ জুন ক্রিকেট দেখলো তার নতুন সংস্করণ। নটিংহ্যাম্পশায়ার আর ডারহাম, ইতিহাসের প্রথম স্বীকৃত টি-টোয়েন্টিতে মুখোমুখি হলো চেস্টার-লি-স্ট্রিটে। ইংলিশরা কি পেয়ে গেল সেই ‘সোনার ডিম পাড়া হাঁসের’ সন্ধান? হয়তো। তবে ‘হাঁস’ সে গৃহস্থের ঘরে থাকলো না। উড়াল দিল। তবে বেশ সময় নিয়েই!

    ক্রিস গেইল : টি-টোয়েন্টিতে বেঁধেছেন প্রাণ! 

     

    ৩.

    ক্যারিবীয় ‘বিশ্বকাপটা’ ‘ফ্লপ’ হয়েছিল মূলত লম্বা সময়ের কারণেই। প্রায় ৪৭ দিন ধরে চলা সে বিশ্বকাপে আবার ছিল না বাদ্যযন্ত্রের প্রবেশাধিকার। মদ নিষিদ্ধ, পতাকা-ব্যানার নেয়া যাবে না, এমনকি নিজের বোতলে পানিও না! চির-আমুদে ক্যারিবীয়রা মুখ ফিরিয়ে নিল। আইসিসির মাথা-খারাপ অবস্থা, দিনের শেষে ক্রিকেট নামক পণ্যটাই তো বেচতে হবে! দৃশ্যপটে আবির্ভাব তাই টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের। কিন্তু সদস্য দেশগুলোকে বোঝাবে কে?

     

    বিসিসিআই মহাসচিব নিরঞ্জন শাহ বললেন, ‘টি-টোয়েন্টি? তাহলে টেন-টেন বা ফাইভ-ফাইভ অথবা ওয়ান-ওয়ানই বা নয় কেন!’ স্রেফ জানিয়ে দিলেন, ‘ভারত কোনোদিন টোয়েন্টি টোয়েন্টি খেলবে না’। হাসি পাচ্ছে? পেতেই পারে। নিরঞ্জন এক শর্তে এমন টুর্নামেন্ট আয়োজনে রাজি হয়েছিলেন, অংশগ্রহণ বাধ্যতামূলক করা যাবে না। আইসিসি সভাপতি এহসান মানি রীতিমতো ‘রাজনীতি’র আশ্রয় নিলেন। ২০১১ সালের বিশ্বকাপ আয়োজনের সুযোগ দেয়ার বিনিময়ে নিরঞ্জনকে রাজি করালেন প্রথম টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে ভারতের দল পাঠানোয়। ভারতও কম না। শচীন, সৌরভ, দ্রাবিড়, লক্ষণদের ছাড়াই পাঠালো দল। অধিনায়ক মাহেন্দ্র সিং ধোনি। বিশ্বকাপের আগে ভারত খেলেছিল মোটে একটি টি-টোয়েন্টি; ভারত বা পাকিস্তানের কেউ প্রস্তুতি ম্যাচও খেলেনি কোনো! তারপর?

     

    মিসবাহর ‘ডেথস্কুপ’ ভারতকে ভাসালো উল্লাসে। বিশ্বকাপ দেখতে দেখতেই ললিত মোদি আইপিএলের প্রস্তাবনা অনুমোদন করিয়ে নিলেন, চ্যাম্পিয়নস লিগ টি-টোয়েন্টির ভাবনাও নিয়ে এলেন।

    এহসান মানি আজ আইসিসিতে নেই, নিরঞ্জন শাহ বিসিসিআইতে নেই, মোদি আইপিএলের হারানো সিংহাসন খুঁজে ফিরছেন শুধু! তবে টি-টোয়েন্টির বিশ্বকাপ আছে, আইপিএল আছে। বহাল তবিয়তে। মেলছে পেখম, উড়ছেই তো!

     

    ৪.

    মুসা আমানও উড়াতে পারতেন। বিমান। তিন গোয়েন্দা পড়ে থাকলে মুসাকে চেনার কথা। চেনার কথা কিশোর পাশা আর রবিল মিলফোর্ডকেও। অতি বুদ্ধিমান, অতি সাহসী কেউ, কেউ আবার বইয়ের পোকা। কেউ ইলেকট্রনিক্সে পারদর্শী, কেউবা আবার কারাতেতে ভাল! আধুনিক ক্রিকেটারদের অনেককেই কিন্তু একের ভিতরই তিন হতে হয়! একাই বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত আমেরিকান, একাই আমেরিকান নিগ্রো, একাই আইরিশ আমেরিকান! ডেভিন ওয়ার্নাররা তাই টেস্ট খেলেন, ওয়ানডে খেলেন, টি-টোয়েন্টিও খেলেন! এবি ডি ভিলিয়ার্স খেলতে খেলতেই চোটে পড়েন। অনিশ্চিত হয়ে পড়ে তাঁর ‘ভবিষ্যত’।

     

    শুরুতে টেস্ট ছিল। ওয়ানডে এলো আশির দশকে। কেরি প্যাকার বিপ্লব ঘটিয়ে ওয়ানডের আধুনিকায়ন করলেন। টি-টোয়েন্টি এলো। জিটিভির মালিক ভারতীয় বোর্ডের ব্রডকাস্টিং স্বত্ব না পেয়ে হতে চাইলেন এ শতাব্দীর কেরি প্যাকার। নিয়ে এলেন আইসিএল। কপিল দেবকে ভারতীয় বোর্ডের চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হলো। কপিল আইসিএল দিয়ে ‘একশজন শচীন’ গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখালেন! আইপিএলের ডামাডোলে হারিয়ে গেল তা! শাহরিয়ার নাফিসদের কেউ কেউ ফিরে এলেন। তবে হারিয়ে গেলেন আফতাবরা।

     

    দুনিয়াজোড়া শুরু হলো সুপার-ডুপার সব প্রিমিয়ার লিগ। ক্রিকেটার কেনাবেচা শুরু হলো। ক্রিস গেইলরা হয়ে যেতে লাগলেন ‘ফ্রি-ল্যান্সার’। যে টাকা দিবে, খেলবেন তার হয়ে।  ললিত মোদির আইপিএলে হারিয়ে গেলেন অ্যালান স্ট্যানফোর্ডের মতো ব্যবসায়ীও, যিনি আইসিসিকে প্রথম মিলিয়ন ডলারের ‘লোভ’ দেখিয়েছিলেন!

     

    বিসিবিই বা বসে থাকে কেন! তারা আনলো বিপিএল। বিসিবি জানতো না, কিংবা বুঝতো না, এই ‘প্রিমিয়ার লিগের’ সঙ্গে তাঁরা আনছেন ফিক্সিংয়ের এক বিষবাষ্পও! এবার হারিয়ে গেলেন মোহাম্মদ আশরাফুল। টি-টোয়েন্টির সবই বোধহয় ‘বেশ তো, ভাল তো’-র মতো। খারাপের মধ্যে খারাপ শুধু আশরাফুল-আফতাবদেরই হারিয়ে ফেলা!

    আইপিএলের চিয়ারলিডাররা

     

    ৫.

    টি-টোয়েন্টিতে হারিয়ে যাচ্ছে আরও অনেক কিছুই। স্পিনাররা বল ঘুরাতে চান না। ফ্লাইট বেশী দেয়ার দরকার নেই। দিলেই তো ঝুঁকি বাড়বে! অথচ হওয়ার কথা উল্টো। ফ্লাইট দিলে ব্যাটসম্যান শট খেলবে, আউটের ঝুঁকি বাড়বে! কিন্তু ব্যাটসম্যানকে আউট করেই বা কী লাভ! ২০ ওভার, ১১ জন ব্যাটসম্যান। তার চেয়ে বরং রান আটকানোই শ্রেয়! অফ স্ট্যাম্পের অনেক বাইরে, ওয়াইডের দাগঘেঁষা ফুল লেংথের ডেলিভারিটাই তাই অসাধারণ! টি-টোয়েন্টির মতো করে ওয়ানডের ‘ডেথ-ওভারে’ও তা দারুণ বল। ওয়ানডেকে যে বোলারদের জন্যই ‘ডেড’ বানিয়ে ফেলা হচ্ছে! ব্যাটের সাইজ বাড়ে, মাঠ ছোট হয়ে আসে। ফ্রি-হিট আসে। বোলাররা কোণঠাসা হন। কোনো পেসারকে টি-টোয়েন্টিতে বোলিং করতে দেখে তাই ইমরান খানের মনে হয়, ভিনগ্রহ থেকে কোনো প্রানী এসেছেন! তারপরও থাকেন ট্রেন্ট বোল্ট বা ইমরান তাহিররা। আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টির ‘জন্মবার্ষিকী’তে নিউজিল্যান্ড-দক্ষিণ আফ্রিকার ম্যাচে এ দুজনের বোলিং ফিগার তাই অন্য কোনো রোমাঞ্চ জোগায়! বিপক্ষ দলের ১৮৫ রানে ইনিংসেও বোল্ট তাই ৪ ওভারে ৮ রান দিয়ে ২ উইকেট নেন। তাহির ২৪ রানে ৫ উইকেট নিয়ে একাই ধ্বসে দেন কিউইদের।

     

    টি-টোয়েন্টি তাই শুধু কেড়ে নেয়নি, বা নিচ্ছে না। ফিল্ডিংয়ের উন্নতিটা চোখে পড়ার মতো এখন। ব্যাটসম্যানদের উদ্ভাবনী শট বেড়েই চলেছে। রিভার্স স্কুপ থেকে শুরু করে ‘পেটেন্ট’ করা ‘দিলস্কুপ’ শট খেলছেন তাঁরা।

    আছে বিপিএল, বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগ 

    টি-টোয়েন্টির দ্রুত রান তোলার মানসিকতা গিয়ে ঠেকছে টেস্ট পর্যন্ত! আগে চতুর্থ ইনিংসে যে রান তাড়া করতে গিয়ে আগেই ড্র এর মানসিকতা নিয়ে নামতো সবাই, এখন নামে জিততে। অতি সাহসী না হলে তাই আগেভাগেই ইনিংস ঘোষণা করার সাহস দেখান না অনেক অধিনায়কই!  

     

    আর হ্যাঁ, ক্রিকেটাররা টাকা পাচ্ছেন। মাথা ঘুরে ওঠার মতো টাকার সেই অঙ্কটা। এদেশ থেকে ওইদেশ ঘুরে বেড়িয়ে ক্রিকেট ফেরি করেন তাঁরা। টি-টোয়েন্টি না হলে কি মার্কিন মুলুকের বেসবল গ্রাউন্ডে ক্রিকেট হয়! ফিরে আসেন শৈশব কৈশোরের তারকারা!

     

    ৬.

    শৈশব কৈশোরের তারকারা নাহয় আবার খেলতে ফিরে আসেন, কিন্তু এখন যাঁদের শৈশব কৈশোর, যাঁরা হবেন ভবিষ্যতের তারকা, কী অবস্থা তাঁদের? রাহুল দ্রাবিড় ভারতের অনূর্ধ্ব-১৯ আর ‘এ’ দলকে কোচিং করিয়েছেন সম্প্রতি। তিনি দেখেছেন তাঁদের কিছু রূপ। তাঁরা মেধাবি, সন্দেহ নেই। তবে ফিল্ডাররা যখন ছড়িয়ে পড়ে, ব্যাটসম্যানরা দিশা পান না, সিঙ্গেলস কিভাবে বের করবেন! বোলারদের উইকেট পাওয়ার সব কৌশল যেন শেষ হয়ে যায়, যখন ব্যাটসম্যানরা আক্রমণ করা বন্ধ করে দেন! হয়তো তাঁরা টি-টোয়েন্টির যুগে বেড়ে উঠেছে বলেই!

     

    টি-টোয়েন্টি ফিল্ডিংয়ের উন্নতি করেছে, তবে রাহুল দ্রাবিড় চলে যাবার পর থেকে ভারতের স্লিপ-কর্ডনটা যেন আলগাই হচ্ছে! ইউনুস খান থাকতে তবুও পাকিস্তানের একটু জোর ছিল। মাহেলা জয়াবর্ধনে থাকতে রঙ্গনা হেরাথ চিন্তা করতেন না বোধহয় খুব একটা! অ্যালেস্টার কুকের আশপাশ থেকেও গ্রায়েম সোয়ান, অ্যান্ড্রু স্ট্রাউসরা হারিয়ে গেছেন! যাঁরা ‘টি-টোয়েন্টি প্রজন্ম’, তারা তো ঘন্টার পর ঘন্টা একটা ক্যাচের জন্য দাঁড়িয়ে থাকেন না! ‘পার্টনারশিপ ক্যাচ’ নিতে তারা পটু, তবে স্লিপ থেকে ঠিকই হাত গলে বেরিয়ে যায় ক্যাচ!

     

    আবেগ নামের ওই আশ্চর্য জিনিসটা কিন্তু ঠিকই থাকে! বাংলাদেশে। টি-টোয়েন্টি হোক বা ওয়ানডে, বাংলাদেশের খেলার দিন রাস্তা ফাঁকা হয়ে যায়, এখানে ওখানে কোনো টেলিভিশন সেটের সামনে জটলা। কেউবা লাউডস্পিকারে বাজাচ্ছেন সরাসরি ধারাভাষ্য! তবে এই আবেগের মূলশর্ত হলো সাফল্য! কান্না তখনই আসে, সাফল্য যখন হাতছানি দিয়ে ছুঁয়ে যায়! ভারত-পাকিস্তানের এক টি-টোয়েন্টি ফাইনাল বদলে দিল কতকিছু! টি-টোয়েন্টি খেলতেও যেমন ক্রিকেটারদের বদলাতে হয়। হাশিম আমলা বা মাহেলা জয়াবর্ধনেদের অবশ্য লাগে না তা। জয়াবর্ধনে তাই কোনো রকম ‘উদ্ভাবনী’ শট না খেলেই সেঞ্চুরি পেয়ে যান। আমলার ব্যাটিং দেখে চোখ জুড়িয়ে যায় টি-টোয়েন্টিতেও! বিশ ওভারের এই ফরম্যাট বরং ইংল্যান্ডকে অধরা একটা বৈশ্বিক ট্রফি দেয়, ওয়েস্ট ইন্ডিজের ক্যালিপসো সুরে ছন্দ ফিরিয়ে আনতে চায়। সাঙ্গা-জয়ার ‘একটা ট্রফি’র আক্ষেপ ঘুচিয়ে দেয়!

    ক্যারিবীয়দের টি-টোয়েন্টি উল্লাস 

     

    ৭.

    আবুধাবিতে সিরিজের প্রথম টেস্ট। নিস্প্রাণ এক ড্র এর দিকেই এগুচ্ছিল ম্যাচটা। আগের ইনিংসে অভিষেকে সবচেয়ে খরুচে বোলিংয়ের রেকর্ড গড়া আদিল রশীদই পরের ইনিংসে ছয় উইকেট নিয়ে ম্যাচে ফিরিয়ে আনলেন প্রাণ!

     

    ইংল্যান্ডকে ৯৯ রানের লক্ষ্য দিল পাকিস্তান। শুরু হলো ইংল্যান্ডের দুই লড়াই। সময়ের সঙ্গে, পাকিস্তানের সঙ্গে। মরুর বুকে সূর্য হেলে পড়ছে। জয়টাও উঁকি দিচ্ছে। পাকিস্তানের সময়ক্ষেপণ শুরু হলো। ব্যাটিং অর্ডারে অদল বদল করা হলো, জো রুট সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে রান তুলতে মরিয়া হয়ে পড়লেন। ইংল্যান্ড আর জয়ের মাঝে দাঁড়িয়ে শুধু ওই টকটকে সূর্যটাই!

     

    শেষ পর্যন্ত জয় হলো সময়েরই! কেউ জিতলো না, কেউ হারলো না! টেস্টটা শেষ হয়ে গেল, কিন্তু একটা অতৃপ্তি রয়ে গেল। আহা, ফলটা যদি হতো! তবে রোমাঞ্চ কিন্তু কমলো না। পাঁচ দিন, পনের সেশন, চার ইনিংসের সব রোমাঞ্চ যে এসে মিলেছিল ওই কয়েক মিনিটে! যেন বিশাল এক বইয়ের শেষপাতা। যেটা না পড়লে বই পড়া বৃথা, আগে কী হয়েছে তা না পড়লে শেষপৃষ্ঠায় আবার বৃথা রোমাঞ্চ খোঁজা!

     

    ১৯৯৯ সালের সেই সেমিফাইনাল-ই বা কে ভোলেন! কমেডি-ট্র্যাজেডি মিলেমিশে একাকার! কেউ হারলো না, কেউ জিতলো না, তবুও এক দল মাতলো জয়োছ্বাসে, আরেকদলকে ভর করলো রাজ্যের হতাশা!

     

    টি-টোয়েন্টির আয়ু ছোট। দুঃখ, বেদনা, আনন্দ, উচ্ছ্বাসের মাত্রা সীমিত। চিয়ারলিডারের নাচ আছে, কৃত্রিম বহ্নিশিখার আভা আছে, মাঠের মধ্য থেকে ক্রিকেটারদের কথা শোনার ব্যবস্থা আছে। টি-টোয়েন্টিতেও টাই হয়। ‘ফুটবলীয়করণে’র অংশ হিসেবে শুরু হয় ‘টাইব্রেকার’। টি-টোয়েন্টির ভাষায়, ‘ওয়ান ওভার ইলিমিনেটর’ বা ‘সুপার ওভার’! সেখানেও টাই হলে বাউন্ডারির সংখ্যা বিবেচনায় এক দল জয়ী! তবে ফল কিন্তু আনতেই হবে। সেই ফল আনার ব্যাপারটা এসে ঠেকছে ওয়ানডেতেও। আগামী চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির সেমিফাইনাল বা ফাইনালেও তাই দেখা যাবে ‘ওয়ান ওভার ইলিমিনেটর’-এর। বিনোদনই যেখানে শেষ কথা, জয়-পরাজয় নির্ধারণ তো সেখানে অতি আবশ্যক! দিনশেষে জয়ী দলের নাম একটিই। সাড়ে তিন ঘন্টার রোমাঞ্চও শেষ ওখানেই। লোকে ঘরে ফিরে সব শেষের সাক্ষী হয়েই!

     

    শেষ হয়, তবে ‘শেষ হইয়াও হইলো না শেষ’ এর অতৃপ্তিটা তো থাকে না!

    নাকি সেই অতৃপ্তির মাঝে কেউ আর তৃপ্তি খোঁজেন না এখন!* 

     

    *প্যাভিলিয়নের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ ম্যাগাজিন 'সুইচ-হিট'-এ প্রকাশিত।