• " />

     

    যাঁদের কাঁধে দায়মুক্তির জোয়াল

    যাঁদের কাঁধে দায়মুক্তির জোয়াল    

    ১৯৮৭ সালের ৩১ মার্চ। বাংলাদেশ ক্রিকেট দল প্রথমবারের মতো মাঠে নেমেছিল পাকিস্তানের বিপক্ষে। শ্রীলংকার মরাতুয়ার টায়রোন ফার্নান্দো স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত ম্যাচটা গাজী আশরাফরা হেরে যান ৭ উইকেটে। আঁতুড় ঘর ছেড়ে লাল-সবুজের ক্রিকেট তখন হাঁটি হাঁটি পা পা করে সবে মাত্র আন্তর্জাতিক অঙ্গনে প্রবেশ করছে। রকিবুল হাসান, গাজী আশরাফ লিপু, আতাহার আলী খান, মিনহাজ নান্নুরা তখন মাঠে নামতেন ‘সম্মানজনক’ পরাজয় কিংবা স্রেফ ভালো খেলার প্রত্যাশায়। কালেভদ্রে সুযোগ মেলা আন্তর্জাতিক ম্যাচগুলোয় বাংলাদেশ কেবলই হারতো, ‘সম্মানজনক’ পরাজয় মিলতো কদাচিৎই।

     

     

    ‘৯৭ সালের আইসিসি ট্রফি জিতে আকরাম খানের দল পেলো প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপের টিকিট। তখনও বাংলাদেশের অঘোষিত লক্ষ্যমাত্রা ‘ভালো খেলা’র গণ্ডি ছাড়ায় নি। কিন্তু ১৯৯৯ সালে ইংল্যান্ডের ওই বিশ্বকাপে টাইগাররা গন্ডিটা ছাড়িয়ে গেলো। হারিয়ে দিলো পরাশক্তি পাকিস্তানকে! 

     

     

    বলা বাহুল্য, বাংলাদেশের প্রথম ‘বড় দল’ বধ ওটাই। এরপর দিন, মাস, বছর গড়িয়েছে...হাবিবুল বাশার, মোহাম্মদ আশরাফুল, সাকিব আল হাসান, মুশফিকুর রহিম, মাশরাফি মর্তুজাদের নেতৃত্বে বাংলাদেশ ধীরে ধীরে শরীর থেকে মুছে ফেলেছে ‘মিনো’ তকমা। বিগত ১৬ বছরের অগ্রযাত্রায় টাইগাররা সবক’টি টেস্টখেলুড়ে দেশকেই কমবেশী হারিয়েছে। ব্যতিক্রম কেবল পাকিস্তান। সেই ‘৯৯ সালেই ৬-১ হয়ে যাওয়া ব্যবধানটা এই ‘১৫ সাল অব্দি এসে হয়ে গেছে ৩১-১!

     

     

    পাকিস্তানের বিপক্ষে শেষ তিনটা ম্যাচই ছিল শেষ মুহূর্তের আক্ষেপের। ৩ উইকেট, ২ রান, ২১ রান...এশিয়া কাপের ঐ ফাইনাল তো বাংলাদেশী ক্রিকেটপ্রেমীদের আজন্ম দুঃস্বপ্নই হয়ে আছে।

     

     

    সেই পাকিস্তান আবারও বাংলাদেশে। নানা জটিলতায় কিছুটা ‘ব্যাকফুটে’ থাকা পাকিস্তান ঢাকায় পা রেখেছে অপেক্ষাকৃত তরুণ দল নিয়েই। মিসবাহ-আফ্রিদীদের অবসরের পর উমর আকমল-আহমেদ শেহজাদরা দল ছেড়েছেন শৃঙ্খলাভঙ্গের খড়গ মাথায় নিয়ে; চোট নিয়ে ছিটকে পড়েছেন শোয়েব মাকসুদ-সোহেল খানরাও।

     

     

    বিপরীতে বিশ্বকাপে প্রত্যাশাতীত পারফর্ম করে আত্মবিশ্বাসের তুঙ্গে বাংলাদেশ দল। সাকিব আল হাসান, মাহমুদুল্লাহরা তো ঘোষণা দিয়েই রেখেছেন এই সিরিজে বাংলাদেশই ফেভারিট!

     

     

    সাকিবকে পাল্টা খোঁচাও দিয়েছেন পাকিস্তানের এই দলটার অন্যতম অভিজ্ঞ খেলোয়াড় মোহাম্মদ হাফিজ। স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন তিন দশকের দ্বৈরথে বাংলাদেশের কাছে তাঁরা কেবল একবারই হেরেছে! সাকিবরা পারবেন তো খোঁচাটুকু ফিরিয়ে দিয়ে ব্যবধানটা কমিয়ে নিতে? ইতিহাসের দায় মেটানোর এই সিরিজে বাংলাদেশ ঠিক কাদের উপর ভরসা করবে? পাকিস্তানের বিপক্ষে বাংলাদেশের এই দলটার কারা সবচেয়ে উজ্জ্বল ছিলেন? নিকট অতীতের পরিসংখ্যান ঘেঁটে সেটা একটু জানার চেষ্টা করা যাক।

     

     

    কেবল বাংলাদেশের বর্তমান দলেই নয়, এ যাবতকালের সব দল মিলিয়েই পাকিস্তানের বিপক্ষে বাংলাদেশের সবচেয়ে সফল ব্যাটসম্যান সাকিব আল হাসান। বিগত ছয় বছরে জাতীয় দলের সবচেয়ে বড় এই তারকা পাকিস্তানের বিপক্ষে ১২টি ম্যাচ খেলে ৪১ গড় আর ৮৩.৬৭ স্ট্রাইক রেটে রান করেছেন ৪৫১। ১টি শতক আর ৩টি অর্ধশতকে পাকিস্তানের বিপক্ষে তাঁর ব্যক্তিগত সর্বোচ্চ ১০৮ রান।

     

    ব্যাটসম্যান ম্যাচ/ইনিংস রান সর্বোচ্চ গড় স্ট্রাইক রেট শতক/অর্ধশতক
    সাকিব আল হাসান ১২ ৪৫১ ১০৮ ৪১.০০ ৮৩.৬৭ ১/৩
    তামিম ইকবাল ১৩/১৩ ৩৬৪ ৬৪ ২৮.০০ ৮০.০০ ০/৪
    মাহমুদুল্লাহ  ১৪/১৩ ২২১ ৫৮* ২৪.৫৫ ৫৪.৮৩ ০/১
    নাসির হোসেন ৬/৫ ১৯৯ ১০০ ৩৯.৮০ ৬৭.৬৮ ১/০

     

    ১৩ ম্যাচ খেলে ২৮ গড় আর ৮০ স্ট্রাইক রেটে ৪টি অর্ধশতকসহ ৩৬৪ রান নিয়ে তামিম ইকবালও রয়েছেন যে কোন সময়ের সেরা বাংলাদেশী ব্যাটসম্যানদের তালিকায় দুই নম্বরে। বর্তমান দলের সদস্যদের মধ্যে তৃতীয় সর্বোচ্চ ২২১ রান মাহমুদুল্লাহর। সাকিব ছাড়া পাকিস্তানের বিপক্ষে শতরানের ইনিংস রয়েছে আর দু’জন বাংলাদেশীর, নাসির হোসেন ও এনামুল হক বিজয়ের।

     

     

     

    বল হাতেও সাকিব আল হাসান পাকিস্তানের বিপক্ষে যে কোন সময়ের সেরা বাংলাদেশীর তালিকায় আছেন তিন নম্বরে। ৩২.০৬ গড়ে নিয়েছেন ১৬ উইকেট। ১৮ উইকেট নিয়ে সবার উপরে থাকা আব্দুর রাজ্জাক জাতীয় দলে ফিরে আসার লড়াইটা এখনও চালিয়ে যাচ্ছেন। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ১৭ উইকেট বর্তমান অধিনায়ক মাশরাফি বিন মর্তুজার। এক ইনিংসে ৬৫ রানের বিনিময়ে ৪ উইকেট নিয়ে সেরা বোলিং ফিগারেও মাশরাফি রয়েছেন যে কোন সময়ের বাংলাদেশী বোলারদের মধ্যে দ্বিতীয় অবস্থানে।

     

    বোলার ম্যাচ/ইনিংস উইকেট গড় ইকোনমি সেরা
    মাশরাফি বিন মর্তুজা ১৫/১৫ ১৭ ৩৯.২৩ ৫.৭৫ ৪/৬৫
    সাকিব আল হাসান ১২/১২ ১৬ ৩২.০৬ ৪.৫১ ২/৩৯
    মাহমুদুল্লাহ ১৪/১২ ০৬ ৬৫.৫০ ৬.৪২ ৩/৪
    রুবেল হোসেন ২/২ ২০.২৫ ৪.৫০ ২/২৩

     

    তিনি ছাড়া বাংলাদেশের পক্ষে পাকিস্তানের বিপক্ষে ৪ উইকেট ছিল কেবল আর একজনের, তাপস বৈশ্য। ৪ রানে ৩ উইকেট নিয়ে সেরা বোলিং ফিগারের আরেকটি কীর্তি রয়েছে মাহমুদুল্লাহর। গড় বিবেচনায় সবার উপরে আছেন মমিনুল হক। এখন পর্যন্ত ১টি ম্যাচ খেলে এই খণ্ডকালীন বাঁহাতি ৯ ওভার বল করে ১৮.৫০ গড়ে ৩৭ রানের বিনিময়ে নিয়েছেন ২ উইকেট। ২০.২৫ গড়ে পেসারদের মধ্যে সেরা রুবেল হোসেন ২ ম্যাচ খেলে নিয়েছেন ৪ উইকেট।

     

     

     

    ১৬ বছরের অপেক্ষাটা অবশ্য অনানুষ্ঠানিকভাবে ঘুচিয়ে দিয়েছে বিসিবি একাদশ। গতকাল ফতুল্লায় পাকিস্তানকে নাসির হোসেনরা হারিয়ে দিয়েছেন ১ উইকেটে। আর সে জয়ে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন জাতীয় দলের উদীয়মান তারকা সাব্বির রহমান। তাঁর ১২৩ রানের অনবদ্য ইনিংসটির পুনরাবৃত্তি নিশ্চিতকরেই আরও একাধিকবার চাইবে বাংলাদেশ।

     

     

     

    বিশ্বকাপ কোয়ার্টার ফাইনাল থেকে পাওয়া এক ম্যাচের নিষেধাজ্ঞায় কাল সিরিজের প্রথম ম্যাচে মাঠে নামা হচ্ছে না মাশরাফির। ভারপ্রাপ্ত নেতা সাকিব আল হাসানের অলরাউন্ড পরিসংখ্যান আশার আলো দেখাচ্ছে। নিজেকে হারিয়ে খুঁজে ফেরা তামিমকেও পুরনো চেনা রূপে ফিরে পাওয়ার প্রত্যাশা থাকবে। ঘরোয়া লিগে সামর্থ্যের জানান দিয়ে দলে ঠাই পেয়েছেন রনি তালুকদার। নতুন এই উদ্বোধনী জুটি একটা ভালো সূচনা এনে দিলে সৌম্য, মমিনুল, মাহমুদুল্লাহ, মুশফিক, সাকিব, সাব্বির, নাসির...বড় সংগ্রহ গড়ার কারিগরদের তালিকাটা খুব ছোট নয়। পেস আক্রমণে অন্তত আগামীকালের জন্য নেতৃত্বের ভার চাপছে সময়ের তারকা রুবেল হোসেনের কাঁধেই। তাঁর সাথে তাসকিন-আবুল হাসানের যে কেউ কিংবা দু’জনই যোগ দিতে পারেন। ঘূর্ণি বলে সাকিবের নিয়মিত সঙ্গী হতে পারেন আরাফাত সানি। নাসির, সাব্বির, মাহমুদুল্লাহদর খণ্ডকালীন ঘূর্ণিঝড়ের কার্যকারিতাও পরীক্ষিতই।

     

     

    সব মিলিয়ে এবার পাকিস্তানের বিপক্ষে নিজেদের সময়ের সবচেয়ে সেরা দলটাকেই সম্ভবত পাচ্ছে বাংলাদেশ। সাকিব-মাহমুদুল্লাহদের আত্মবিশ্বাস আশাবাদী করছে গোটা বাংলাদেশকেই। প্রত্যাশা-প্রাপ্তির হিসেবটা না হয় সময়েই মিলিয়ে নেয়া যাবে!