ছবির ছবিয়াল, ছবিয়ালের ছবি
জো সলোমন ব্যাকওয়ার্ড স্কয়ার লেগে দাঁড়ানো।
ঠিক ব্যাকওয়ার্ড স্কয়ার লেগ নয়, তার একটু আগে। ফ্র্যাঙ্ক ওরেল ওয়েস্ট ইন্ডিজের সব ফিল্ডারকেই সাধারণ সব পজিশন থেকে একটু এগিয়ে এনেছেন। অস্ট্রেলিয়ার টেস্ট জিততে প্রয়োজন এক রান, ওয়েস্ট ইন্ডিজের দরকার এক উইকেট। বল বাকি দুইটি। ওয়েস্ট ইন্ডিজ তো আক্রমণ করবেই। ওরেল সবাইকেই শান্ত করতে ব্যস্ত। ওয়েস হলকেও। তিনি নো বল দিয়ে ফেললেই ‘খেল খতম’। তিন বল আগেই হল রান-আউটের একটা সুযোগ পেয়েছিলেন। শিকার সামনে এসে বসে থাকলে বন্দুক হাতের শিকারিকে যতখানি পরিশ্রম করতে হয়, স্টাম্পে বল লাগাতে হলকে করতে হতো শুধু সেটুকুই। হাত ফসকে গেল তার। চাপ, কী দারুণ ভয়ঙ্কর একটা বিষয়! এর পরের বলে হল মিড-উইকেটে দৌড়ে গিয়ে রোহান কানহাইকে প্রায় উড়িয়েই দিয়েছিলেন! দুজনের সংঘর্ষের মাঝ দিয়ে শুধু ক্যাচটাই পড়ে গেল।
সলোমনকে অবশ্য আলাদা করে শান্ত করতে হয় না। স্বভাবেই তিনি এমন।
সলোমন টেস্ট খেলেছিলেন ২৭টি। ৭ বছরের আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার। সেঞ্চুরি একটি। ৩৪ গড়ের মাঝারি মানের ব্যাটসম্যান। ঠিক ঝলকানি ছিল না ব্যাটে। তবে ফিল্ডার হিসেবে সলোমনকে আলাদা করে চোখে পড়তো, অভেদ্য লক্ষ্যভেদে ছিলেন ওস্তাদ। গায়ানার আমগাছে ঢিল ছুঁড়ে ছুঁড়ে মকশো করেছিলেন হাত। এই ওভারের আগেরটিতেই মিড-উইকেট থেকে সরাসরি থ্রোতে রান-আউট করেছিলেন অ্যালান ডেভিডসনকে।
ম্যাচে বাকি দুই বল। রান সমান দুই দলেরই। এক রান হলে জিতবে অস্ট্রেলিয়া, একটা উইকেট হারালে টেস্ট ক্রিকেট দেখবে প্রথম টাই ম্যাচ। হলের বলের মুখোমুখি লিন্ডসে ক্লাইন। শুধু বলটা আসবে, ব্যাটে লাগিয়েই তিনি পড়িমড়ি ছুটবেন। স্নায়ুচাপের সাগরে হাবুডুবু খাচ্ছেন তখন সবাই। বিহাইন্ড দ্য স্কয়ারে খেলেই ছুট লাগালেন ক্লাইন। ব্যাকওয়ার্ড স্কয়ার লেগে সলোমন তখন প্রস্তুত হয়ে গেছেন। চিন্তার সময় নেই। বল আসবে। ধরবেন। দৃষ্টিতে একটা স্টাম্প, ভেদ করতে হবে সেটাই। হবে ইতিহাস। আর নাহয় কালের গর্ভে হারিয়ে যাবে সব।
সলোমনের হাত থেকে বলটা বেরিয়ে গেল স্টাম্প বরারবর। আগের ওভারে যে ভুল করেননি, গায়ানার আমগাছগুলোতে ঝুলে থাকা আমগুলোর দিকে পাথর নিশানা করতে যার ভুল হয়নি, সে ভুলটা এবারও হলো না। ওপ্রান্ত থেকে ছুটে আসা ইয়ান মেককিফ প্রাণপণ চেষ্টা করেও ঢুকতে পারলেন না ক্রিজে। তৈরী হলো ইতিহাস।
আর সে ইতিহাসকে ধরে রাখলো ‘লং টম’ ডাকনামের একটা ক্যামেরার শেষ নেগেটিভ। ৫x৪ গ্র্যাফ্লেক্স বডি, ১০১ সেন্টিমিটারের এফ/৮ ফোকাস দৈর্ঘ্যের লেন্স সেটার। মালিকের নাম রন লভিট। মেলবোর্নের দ্য এজ পত্রিকার ফটোগ্রাফার।
টেস্টে তখন ওভার হতো ৮ বলের, দিনে প্রায় ৯৫ ওভার। সারাদিনে ক্রিকেট ফটোগ্রাফারদের তখন সম্বল ছিল দুইটা ম্যাগাজিন, ১২টা করে নেগেটিভ। লভিটদের মনযোগ যে অন্য পর্যায়ের ছিল, সেটা আলাদা করে বলা আর সলোমনের ফিল্ডিং সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা একই।
তবে ব্রিসবেনের সেই দিনে লভিটদের মনযোগের পরীক্ষাটা ছিল অন্য পর্যায়ের।
ওয়েস্ট ইন্ডিজ জিতেই গেছে ধরে নিয়ে সিডনির ফ্লাইট ধরতে চা-বিরতির পরই ধারাভাষ্য কক্ষ ছেড়ে গিয়েছিলেন এবিসি রেডিওর কিংবদন্তি অ্যালান ম্যকগিলভ্রে আর তার বন্ধু কিথ মিলার। ইতিহাসের অন্যতম সেরা টেস্টের শেষটার সাক্ষী হতে না পারার এই আক্ষেপ সঙ্গী করেই দুনিয়া ছেড়েছিলেন রেডিও ধারাভাষ্যের পথপ্রদর্শক ম্যকগিলভ্রে।
ফটোগ্রাফারদের অবস্থাও সুবিধার নয় তখন। ক্ষণে ক্ষণে রঙ বদলানো ম্যাচে দিনের বরাদ্দ নেগেটিভ প্রায় শেষ করে ফেলেছিলেন তারা, দিনের শেষ ওভারের আগেই। লভিটের পাশে ছিলেন ব্রিসবেনের কুরিয়ার মেইলের বব বার্নস। শেষ ওভারের আগে তার সম্বল ছিল ছয়টি নেগেটিভ। আর লভিটের কাছে ছিল ডার্ক স্লাইডের একপ্রান্তের একটা নেগেটিভ। লভিট আর বার্নস বুদ্ধি করলেন, দুজনের মিলিত নেগেটিভ দিয়ে শেষ করবেন ম্যাচ।
অস্ট্রেলিয়ার দরকার ছিল ৬ রান। সম্বল তিন উইকেট। প্রথম ছয় বলে হলো ৫ রান, উইকেট গেল ২টি। শেষ হয়ে গেল বার্নসের নেগেটিভ। লভিট একটা ক্লিকও করলেন না এর মাঝে।
টেস্টে বাকি দুই বল, লভিটের ক্যামেরার ব্যাগে বাকি শুধু একটি ডার্ক স্লাইড। এই নেগেটিভ হোল্ডারের দুইপাশে দুইটা নেগেটিভ থাকে। লভিটের সমস্যা নেগেটিভের পরিমাণের চেয়েও বড় তখন।
খেলা শুরুর আগে লভিট গ্যাবায় আসা কুইন্সল্যান্ড গভর্নরের একটা ছবি তুলেছিলেন ‘ফিচার স্টোরি’র জন্য। দিনের খেলার বরাদ্দ নেগেটিভগুলো ব্যবহার করতে চাননি বলে লভিট ছবিটা নিয়েছিলেন ডার্ক স্লাইডের একপ্রান্তে। ক্যামেরা থেকে সেটা বের করে ব্যাগে রেখেছিলেন, কিন্তু বেমালুম ভুলে গিয়েছিলেন, কোন প্রান্ত ব্যবহার করেছেন।
ওপাশে অস্ট্রেলিয়া উইকেট হারাচ্ছে, হলের সঙ্গে সংঘর্ষ হচ্ছে কানহাইয়ের। আর এদিকে লভিট ঘামছেন, ক্যামেরায় ঢোকাবেন ডার্ক স্লাইডের কোন প্রান্ত এটা ভেবে! পাশে বসা বার্নসকে লভিট বললেন, ‘শেষ দুই বলে যদি কিছু না ঘটে, তাহলে আমার চাকরি থাকবে না নিশ্চিত। একটা ছবিও তুলিনি এখনও।’
ঘটনা ঘটলো। লভিট শাটারে ক্লিক করলেন। ‘শান্ত’ সলোমনের থ্রোতে রান-আউট মেককিফ, উল্লাসে মত্ত ক্যারিবীয়রা, তারা ভেবেছিলেন জিতেছেন তারাই। পরে গিয়ে জেনেছিলেন, আদতে তারা বনে গেছেন ইতিহাসের অংশ।
তবে শান্ত থাকতে পারছিলেন না লভিট। ছবি নিয়েছেন, কিন্তু ডার্ক স্লাইডের কোন প্রান্তের নেগেটিভে, সেটা তো নিশ্চিত নয়! ট্যাক্সি করে কুরিয়ার মেইলের অফিসে গেলেন, সেখানকার ডার্ক রুমেই দিনের ছবিগুলোর প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে হবে।
ডার্ক রুমের আলোতে তার শেষ শটটা মেলে ধরে একটা চিৎকার দিয়েছিলেন লভিট। দুই রুম দূরে বসে বার্নসের মনে হয়েছিল, যেন পাশে বসেই উল্লাস করছেন তিনি। সে উল্লাসের কারণটা তো যেনতেন নয়। তার সামনে তখন জীবন্ত হয়ে উঠেছে সেই কাঙ্খিত ছবি।
গ্যাবায় দীর্ঘ ছায়ার মাঝেই দেখা যাচ্ছে, ব্যাটিং প্রান্তের স্টাম্প ভাঙ্গা, বলটা তখনও চলমান। সলোমন তার কিংবদন্তিতুল্য থ্রোয়ের ফলো-থ্রুতে আছে্ন। তার ডানে মাথার ওপরে দুইহাত তুলে পিছন ফিরে দাঁড়িয়ে আছেন হল, হয়তো বিস্মিতই। অথবা উত্তেজিত।
ব্যাটিং প্রান্তে উল্লাসে মত্ত সোবার্স, উত্তুঙ্গ কানহাইয়ের উচ্ছ্বাস। ফ্রেমের ডানে ক্লাইন, পেছনে তাকিয়ে দেখছেন মেককিফ পৌঁছাতে পারেননি ওপ্রান্তে। আর এদিকে, সুযোগ্য সেনাপতির মতো বোলিং প্রান্তের স্টাম্প আগলে রেখেছেন ওরেল, যাতে থ্রো এপাশে আসলেও সুযোগটা নিতে পারেন। শান্ত, ধীর, স্থির ওরেল।
সেদিন ওরেলের চেয়েও বেশি শান্ত থাকতে হয়েছিল সলোমনকে। আর লভিটকে। যারা কালের গর্ভে না হারিয়ে অংশ হয়েছিলেন ইতিহাসের। ক্রিকেট ইতিহাসের সবচেয়ে বিখ্যাত ছবিগুলোর একটি বা অনেকের মতে সবচেয়ে বিখ্যাত ছবিটির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশে ছিলেন এই দুইজন।
সলোমন ইতিহাস তৈরী করেছিলেন। লভিট সেটা ধারণ করেছিলেন তার ‘লং টম’-এর শেষ শটে।
পুনশ্চঃ
লভিট দ্য এজের ইতিহাসে প্রথম ফটোগ্রাফার হিসেবে পরে ফটো-সম্পাদক হয়েছিলেন। কাজ করতে করতে ডেস্কেই মৃত্যু হয়েছিল তার।
১৯৮৪ সাল থেকে জো সলোমন নিউ ইয়র্কে বাস করেন, এখন বয়স ৮৭। সেই টাই টেস্টের ক্রিকেটারদের মধ্যে সলোমনসহ বেঁচে আছেন ১২ জন।
তথ্যসূত্র
১) অস্ট্রেলিয়ান ফটোগ্রাফি
২) গ্র্যাফ্লেক্স.কম
৩) প্রেস ফটোগ্রাফি ইন অস্ট্রেলিয়া
৪) দ্য সিডনি মর্নিং হেরাল্ড
৫) ব্রাইডন কাভারডেল : দ্য ক্রিকেট মানথলি
৬) ইএসপিএনক্রিকইনফো