আনন্দলোকের অনিশ্চিতযাত্রা

স্টিভেন জেরার্ড লিভারপুল ছাড়ছেন। ১৭ বছরের সম্পর্ক ছিন্ন করে পাড়ি জমাবেন মার্কিন মুলুকে। সেদিন অ্যানফিল্ডে বিদায়লগ্নে শেষ সাক্ষাতকার দিচ্ছিলেন, দর্শকদের ধন্যবাদ জানাচ্ছিলেন। কোলে কনিষ্ঠ কন্যা। জেরার্ড একটা করে বাক্য শেষ করেন, আর দর্শকরা কোরাস ধরেন। ১৭ বছর ধরে তাঁর জন্য যে গানগুলো বাঁধা হয়েছে, যেন সবগুলো গাইতে হবে, শেষবারের মতো! চলছে করতালি। তবে জেরার্ড-কন্যার কাছে এসব অর্থহীন, দর্শকদের চিৎকার আর করতালির আওয়াজে দুহাত দিয়ে কান চেপে রাখছে বারবার! তবে বড় মেয়েটি জানে, তার বাবা চেষ্টা করেছেন প্রচন্ড (লীগ জেতার মনে হয়!)। লিভারপুলকে মিসও করবেন অনেক। জেরার্ডের ছোটমেয়েটি যখন বড় হবে, ঠিক বড়বোনের মতো, তখন হয়তো এসব স্মৃতি ঝাপসা হয়ে আসবে। হয়তো গল্প শুনে বুঝবে, কীভাবে তাদের বাবা হয়ে উঠেছিলেন একটা ক্লাবের সমার্থক। একটা ইংলিশ ফুটবল ক্লাবের সমার্থক!
ক্রিকেট ফুটবলের মতো ক্লাবভিত্তিক নয়। ক্রিকেট আন্তর্জাতিকতা নির্ভর। দ্বিপাক্ষিক সিরিজই সেখানে মূল আকর্ষণ। তবে আন্তর্জাতিক কাঠামোটা ঠিক যুতসই নয়। দ্বিপাক্ষিক সিরিজের সূচী নির্ধারিত হয় মূলত বোর্ডগুলোর মধ্যে দরকষাকষিতেই। আইসিসি সেখানে কেরানীর ভূমিকাই পালন করে। টুকে রাখে নোটবুকে, ম্যাচ অফিসিয়ালদের পাঠাতে হবে যে!
অস্ট্রেলিয়া তাই বাংলাদেশকে ডাকে না, লর্ডস ওল্ড ট্রাফোর্ডের টেস্ট সেঞ্চুরির স্মৃতিই তামিম ইকবালকে হয়তো বয়ে নিয়ে বেড়াতে হবে আজীবন। বাড়ির পাশের ভারতও মুখ ফিরে চায়নি এতদিন।
হ্যাঁ, সব ছাপিয়ে মুখ্য বিষয় হয়ে দাঁড়ায় অর্থ। টাকা। লাভ যেখানে, সেদিকেই ধাবিত হয় সব বোর্ড। ক্রিকেটের আনন্দলোক হয়ে পড়ে টাকা বানানোর কারখানা। হবেই না কেন! ক্রিকেট তো একটা পণ্যের নাম। কাটতি দেখেই এর তো এর বাজারজাতকরণ করতে হবে।
যেদেশে যখন ক্রিকেটের ভরামৌসুম, তখন চাই প্রতিদ্বন্দ্বিতা। চাই নামের ভার। চাই বড় দলের তকমা। বড় সিরিজের তকমা। টেলিভিশনের সব সেকেন্ড তখন চড়া দামে বিকোবে। সিরিজের নামের আগে নিজেদের নাম বসাতে হুলস্থুল কান্ড বেঁধে দেবে কর্পোরেট হাউসগুলো! সেই ভরা মৌসুমে হবে অ্যাশেজ, হবে বোর্ডার-গাভাস্কার ট্রফি। হবে চ্যাপেল-হ্যাডলি ট্রফির খেলা। হবে বড় বড় সব ম্যাচ। নামীদামী ধারাভাষ্যকার। অসাধারণ সব বিশ্লেষণে ভরপুর প্রি-ম্যাচ আর পোস্ট ম্যাচ শো। পত্রিকার পাতাজুড়ে থাকবে সংবাদ। বাড়বে বিজ্ঞাপনের হার। পাল্লা দিয়ে বাড়বে প্রতি ইঞ্চি কলামের দামও। একটা ‘কমপ্লিট প্যাকেজ’।
আর অফসিজনে? ঘুরে আসা যায় বাংলাদেশ। জিম্বাবুয়ে। অথবা ওয়েস্ট ইন্ডিজ। দায়সারা একটা সিরিজ। শুধুই ওয়ানডে। সঙ্গে হয়তো দুই একটি টেস্ট। ওহ্, টি-টোয়েন্টিও নাহয় থাকুক একটা!
ভারত ‘প্রতিশ্রুতি’ দিয়েছে যখন, তখন তো আসতেই হবে। তবে ক্লান্ত যে সবাই। বিশ্বকাপের পরে বিশ্রাম মেলেনি। আইপিএলযজ্ঞে ছুটতে হয়েছে। আসবেন না তাই প্রথম সারির বা নিয়মিত একাদশের অনেকেই। ডেল স্টেইনও চাননা, বাংলাদেশে এসে বাড়তি খাটুনি করতে। এর চেয়ে দেশের হয়ে একটা বৈশ্বিক ট্রফির জন্যই নাহয় বাঁচিয়ে রাখা যাক শক্তি! আইপিএল খেলে যে ক্লান্ত তিনিও!
হ্যাঁ, আইপিএল। ক্রিকেটকে বদলে দেওয়া আইপিএল। মাথা ঘুরে ওঠার মতো টাকার ঝনঝনানি দেখানো আইপিএল। আন্তর্জাতিকতার সীমানা পেরিয়ে যেন নতুন এক ক্রিকেট সাম্রাজ্য গড়ার স্বপ্ন বিসিসিআই কর্মকর্তাদের। কিংবা ক্রিকেট সাম্রাজ্যের সিংহাসন কুক্ষিগত করার অনেক বড় এক হাতিয়ার আইপিএল। ক্রিকেটাররা তাই ছুটছেন। অ্যালেক্স হেলস নিজের দেশের টুর্নামেন্ট বাদ দিয়ে গিয়ে বেঞ্চ গরম করবেন। ক্রিস গেইল ফ্রিল্যান্সার হয়ে যাবেন। কাইরন পোলার্ড-ডোয়াইন ব্রাভোদের সঙ্গে ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেট বোর্ডের বনিবনা হবে না।
আবার কেভিন পিটারসেন আইপিএল ত্যাগ করে আসবেন, সারের হয়ে ডিভিশন টু এর কাউন্টি ম্যাচ খেলতে। ইসিবি বলে দেবে, তোমার উপর আমাদের বিশ্বাস নেই।
বিশ্বাস। বড়ই অদ্ভূত এক শব্দ। কী বিশ্বাসেই না ক্রিকেটের রোমাঞ্চ দেখতে বসেন দর্শকরা। ক্রিকেট জীবনের সমান বড়। ক্রিকেট জীবনের প্রতিচ্ছবি। ক্রিকেট অনিশ্চয়তায় ভরপুর। সেই বিশ্বাসকেই ভেঙ্গে দেন হ্যান্সি ক্রনিয়েরা। সেলিম মালিক, অজয় জাদেজা, মোহাম্মদ আজহারউদ্দিন, মোহাম্মদ আমীর, মোহাম্মদ আসিফ, সালমান বাট, লু ভিনসেন্টরা। বিশ্বাস ভেঙ্গে দিয়ে রুপকথার নায়ক থেকে ঝাপসা স্মৃতি হয়ে মিলিয়ে যেতে থাকেন মোহাম্মদ আশরাফুলরা।
পাকিস্তানকে বাংলাওয়াশের স্বাদ দিয়ে সবাই যখন ফুঁসছেন, যে-ই আসুক ‘ধরে দিবানি’, ঠিক তখনই বেড়িয়ে পড়ছে জাতীয় লিগের ফিক্সিং-সর্প। থাবা বসাতে আসছে আবার। ওলটপালট করে দিতে আসছে আবার।
বিশ্বাস ঠুনকো হয়ে যায়। স্মৃতিও ঝাপসা হয়ে যায়।
নজর দেওয়ার মতো সময় নেই কর্তাব্যাক্তিদের।
বিসিবি ব্যস্ত। ব্যস্ত বিপিএলের নতুন সূচীটা ঠিক করতে। নাহয় প্রথম শ্রেনির ক্রিকেটেই একটু ফিক্সিংয়ের ‘আভাস’ পাওয়া গেছে, তাতে কী! ইসিবি বিশ্বাস খুঁজে ফেরে। কী চায়, নিজেই জানে না। বিসিসিআই অন্ধ হয়ে ক্ষমতা আঁকড়ে ধরে রাখতে চায়। পিসিবির মিউজিক্যাল চেয়ারের খেলা চলে। জিম্বাবুয়েকে ডেকে এনে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে চায়। ভারত পাকিস্তান দুদলই বাইরে গিয়ে খেলে, কিন্তু ভারত আবার পাকিস্তানকে ডাকে না। । জেডসিবি ব্রেন্ডন টেলরকে ধরে রাখতে পারে না। ডব্লিউসিবি জানেনা, ক্রিস গেইলরা আসলে কাদের। ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়া ব্যস্ত নিজেদের নিয়ে। ‘বিগ থ্রি’ হয়ে গেছে। নিজেকে নিয়েই থাকো! এনজেডসি তো ক্রিকেটকেই দাঁড় করাতে চায়। রাগবির পাশে যদি একটু জায়গা মেলে। এসএলসি ব্যস্ত সরকার আর বোর্ডের মধ্যে সম্পর্কটা ভাল করাতে। একবার ভারত, একবার পাকিস্তানকে সমর্থন দিতে।
আর আইসিসি? পাকিস্তান জিম্বাবুয়েকে ডেকে আনছে। তবে আইসিসি অনড়। ম্যাচ হোক। আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি দিব। তবে অফিসিয়াল পাঠাবোনা। মানে বিয়ে করবো, সংসার নয়। মানে আমার চোখ আছে। তবে সব কিছু দেখি না। হাত বাঁকালে রেহাই নেই। ফিক্সিং হলে দায় বোর্ডের ওপর। তাদের বিষয়, তারাই দেখবে!
মাঝে পড়ে থাকে দর্শকরা। বিশ্বাস নিয়ে। রোমাঞ্চের আশায়।
কোরাস ধরে, অ্যানফিল্ডে জেরার্ডের বিদায়সংগীত গাওয়ার মতো।
আর ক্রিকেট কর্তারা কানে হাত দিয়ে থাকেন। জেরার্ড-কন্যার মতো।