• " />

     

    বাংলাওয়াশ আর ক্রিকেটের সুদিন

    বাংলাওয়াশ আর ক্রিকেটের সুদিন    

    ১.

    বাংলাওয়াশ শব্দটা তখনও অচেনা। ২০১০ সালের অক্টোবর মাসের এক ভ্যাপসা গরমের দিন। মিরপুর, শের-এ-বাংলা জাতীয় স্টেডিয়াম। সঙ্গে ভাই আর এক বন্ধু। ওয়ানডের টিকেট পাওয়া সহজ ছিল তখন, অন্তত এখনকার তুলনায় তো বটেই! বাংলাদেশ ও ইতিহাস গড়া সিরিজ জয়ের মাঝে দাঁড়িয়ে এক কিউই তরুণ-তুর্কী, কেন উইলিয়ামসন। শফিউল ইসলামের বলটা মিডউইকেট দিয়ে তুলে মারতে চাইলেন, ক্যাচ নিলেন রকিবুল হাসান। প্রথমে মনে হয়েছিল ইমরুল কায়েস। কী এক গর্জন বয়ে গেল শের-এ-বাংলা জুড়ে, আনন্দের গর্জন! আইসিসির ‘পূর্ণশক্তির’ এক ‘পূর্ণ’ সদস্যকে সিরিজ হারালো বাংলাদেশ। প্রথমবারের মতো। সিট থেকে উঠে দাঁড়াতে গিয়ে ভাই একটু টলে উঠলেন। কাঁপছিলেনও একটু একটু। যা গরম ছিল! শুধুই কি গরম! আর আবেগ?

     

    ২.

    আমেরিকান ফুটবলের টানা জয়ের রেকর্ড নিয়ে একটা সিনেমা আছে। ‘হোয়েন দ্য গেম স্ট্যান্ডস টল’। একটা হাইস্কুল-দল জিতেছিল টানা ১৫১টি ম্যাচ। তারপর, কোন এক মৌসুমের শুরুতে এক প্রতিকূল আবহাওয়ায় একটি ম্যাচ হেরে বসলো তারা। থেমে গেল জয়রথ! ম্যাচশেষে ড্রেসিংরুমে খেলোয়াড়রা তখন সব হারানোর বেদনায় থরথর। সহকারি কোচ বললেন, ‘রিপোর্টার, বন্ধু, পরিবার, আগন্তুক, সবাই তোমাদেরকে জিজ্ঞাসা করবে। কী হলো! কীভাবে জয়রথ থামলো তোমাদের! এবং প্রত্যেকবার তোমরা একই উত্তর দেবে, সত্যটা বলবে। “বিপক্ষ দল আমাদের চেয়ে ভাল খেলেছে, আর আমরা হেরেছি একটি হাইস্কুল ফুটবল ম্যাচ”! এটাই ফুটবল। একটা ম্যাচ দিয়ে তোমরা নিজেদের বিচার করার সুযোগ দিও না। বরং নিজেকে বিচার করো, কীভাবে তোমরা বেঁচে থাকছো, তা দিয়ে!’

     

    ৩.

    বাংলাদেশ বিশ্বকাপে গিয়েছিল বিশ্বকাপ জেতার জন্য নয়। হয়তো বুকের গহীন কোণে সেই স্বপ্নটা ধারণ করেন অনেকেই। যখন বাংলাদেশ ২০০৩ সালে কেনিয়া-কানাডার কাছে হেরে বিদায় নিয়েছিল, তারপরও করতেন! যখন বাংলাদেশ এই ২০১৫ তে এসে ভারতের কাছে কোয়ার্টার ফাইনালে হেরে বিদায় নিল, তখনও করেছেন। কেউ কেউ বলবেন, সুযোগ ছিল এবারই। ‘অন্যায্য’ভাবে বাংলাদেশকে ‘হারিয়ে’ দেওয়া হয়েছে। তবে বাংলাদেশ কোয়ার্টার ফাইনালে গিয়েছিল অনেকেরই প্রত্যাশার সীমানাকে ছাড়িয়ে।

     

    তারপর ভারত এলো। প্রতিশোধের আগুন জ্বললো ধিকিধিকি। বদলা নিতে হবে বিশ্বকাপ কোয়ার্টার ফাইনালে হারের। শুরু হলো টেস্ট ম্যাচ দিয়ে। বৃষ্টি বাগড়া বাধালো চরমভাবে। ড্র হলো একমাত্র টেস্ট। এক পেসার খেলানো নিয়ে শোরগোল উঠে গেল চারদিকে। ম্যাড়মেড়ে ম্যাচেও চোখে আঙ্গুল দেখালো ব্যাটিং ব্যর্থতা। বাংলাদেশ আসলে কী করতে চায় টেস্টে? ড্র করতে, নাকি জিততে চায়? জয়ের স্বপ্নটা হয়তো লুকানো থাকে, বাস্তবে তার প্রতিফলন মেলে না। বাস্তবে বাংলাদেশ নামে সাত-আটজন ব্যাটসম্যান নিয়ে। তবুও মুখ থুবড়ে পড়ে প্রায়ই। পাকিস্তানের সঙ্গে শেষ টেস্টেও পড়েছিল। পড়েছিল ফতুল্লা টেস্টেও।

     

    তারপর ওয়ানডে সিরিজ। আকাশে বাতাসে বিচিত্র সব শব্দ। টেস্টের সবেধন নীলমণি এক পেসারের জায়গায় এবার বাংলাদেশ নামলো চার-চারজন ফ্রন্টলাইন পেসার নিয়ে। মুস্তাফিজুর নামের এক তরুণ নতুন করে সবাইকে ‘কাটার’ আর ‘স্লোয়ার’ চেনালেন। বাংলাদেশ জিতে নিল প্রথম দুই ম্যাচ।

     

    তারপর? শুধুই একটি শব্দ। বাংলাওয়াশ। করতেই হবে। কোন ছাড় নেই।

     

    ৪.

    বাংলাওয়াশ হয়নি। সিরিজের শেষ ম্যাচটা ভালো খেলেনি বাংলাদেশ। ভারত বড় স্কোর গড়েছে, সেই স্কোর তাড়া করার মতো মানসিকতা দেখাতে পারেননি ব্যাটসম্যানরা। তবে সিরিজ জেতা হয়ে গেছে। ভারতের বিপক্ষে প্রথম। অনেক প্রথমের স্বাদই পাচ্ছে বাংলাদেশ। বিশ্বকাপে প্রথম কোয়ার্টার ফাইনাল, টেস্ট স্ট্যাটাসের পর পাকিস্তানের সঙ্গে প্রথম জয়, তারপর সিরিজ জয়, তারপর ‘ক্লিন-সুইপ’। মানে বাংলাওয়াশ আর কী!

     

    সময়টা উপভোগ করার। ওয়ানডের এই দলটাকে সময় দিলে আরও অনেক উপভোগের মতো সময় এনে দেবেন তারা, প্রত্যাশা করাই যায়। বাংলাদেশ এখন শুধু বড় দলের শিকারী নয়, হয়ে উঠছে বড় দল। কিন্তু কেবল ওয়ানডেতে। দলে জায়গা নিয়ে প্রতিযোগিতা বাড়ছে। নতুনরা চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছেন পুরোনোদের। দলে জায়গা পাওয়ার এই সুস্থ প্রতিযোগিতা বাংলাদেশের জন্য অবশ্যই ইতিবাচক এক দিক।

     

    তবে অপেক্ষা করে আছে এই জয়ধারাকে ধরে রাখার চ্যালেঞ্জ। অপেক্ষা করে আছে বিদেশের মাটিতে এমন নিয়মিত জয়ের চ্যালেঞ্জ। আছে আরও বড় এক চ্যালেঞ্জ। টেস্ট ক্রিকেটের চ্যালেঞ্জ। ওই লাল চেরির চ্যালেঞ্জ।

     

    ৫.

    টেস্ট ক্রিকেটের চ্যালেঞ্জ কীভাবে নিতে পারছে বাংলাদেশ? পাকিস্তানের সঙ্গে খুলনা টেস্টে তামিম-ইমরুলে ভর করে পাকিস্তানের সঙ্গে ড্র করেছিল বাংলাদেশ। তারপর ঢাকা টেস্টে ফিরে গেছে সেই পুরোনো রূপে! ভারতের সঙ্গে ফতুল্লা টেস্টে যে কয়েক সেশন খেলা হয়েছে, চোখ রাঙ্গিয়েছে সেই চ্যালেঞ্জ! ফলো-অনেও পড়তে হয়েছে। 

     

    হ্যাঁ, বাংলাদেশ টেস্ট ক্রিকেটে ‘অভ্যস্থ’ হতে পারেনি এখনও। সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগতে হয় তাই। ওয়ানডেতে বাংলাদেশ এখন ম্যাচ খেলে অনেক, ঘরোয়া কাঠামো নড়বড়ে হলেও মেধাবী ক্রিকেটাররা আন্তর্জাতিকেই নিজেদের প্রমাণ করছেন। তবে টেস্ট আর ওয়ানডে তো এক নয়! টেস্ট খেলার সুযোগ বাংলাদেশ পায় কমই। তাহলে অভ্যস্থ হওয়ার উপায়? সেই অনেক ব্যবহারে ক্লিশে হয়ে যাওয়া কথাটাই বলতে হয় বারবার। ঘরোয়া কাঠামো ঠিক করা। আজ পনেরো বছর যে কথাটা বলে যাচ্ছেন ক্রিকেট বুঝতে পারা ক্রিকেটপ্রেমীরা। বিসিবিও আজ এটা, কাল সেটা বলে চালিয়ে দিচ্ছেন জাতীয় লীগ, বিসিএল। কাজের কাজ হচ্ছে কী?

     

    ৬.

    মুস্তাফিজুরকে নিয়ে বিস্ময়ের শেষ নেই। তবে মুস্তাফিজুরই একমাত্র ক্রিকেটার নন, বাংলাদেশের ক্রিকেটে যার উত্থান বিস্ময়জাগানিয়া! বিস্ময় জাগিয়েছিলেন মোহাম্মদ আশরাফুল, সোহাগ গাজী, আবুল হোসেন, এনামুল হক জুনিয়র। তাঁরা কই এখন?

     

    হারিয়ে গিয়েছেন, হারিয়ে যেতে বসেছেন। মুস্তাফিজুর হারিয়ে যান, এটা নিশ্চয়ই চান না কেউই। মুস্তাফিজুরকে ধরে রাখার উপায়?

     

    ধরুন, সামনে দক্ষিন আফ্রিকা সিরিজে তিনি খারাপ করলেন। তারপরের সিরিজেও আবার। বাদ পড়লেন। তারপর ফিরে আসবেন কীভাবে? অবশ্যই ঘরোয়া ক্রিকেট খেলে। ঘুরেফিরে সেই ঘরোয়াতে গিয়েই আটকায় সব। সেই ঘরোয়া ক্রিকেট, সেখান থেকে জাতীয় দলে আসার রাস্তাটা পরিস্কার হওয়া প্রয়োজন। সবার আগে। কীভাবে একজন জাতীয় দলে আসেন, সেটা ‘রহস্যময়’ হয়ে থাকলে মুস্তাফিজুরও হারিয়ে যাবেন!

     

    ৭.

    সামনে দক্ষিণ আফ্রিকা সিরিজ। বাংলাদেশ সে সিরিজ অবশ্যই জিততে পারে। এবং হ্যাঁ, হারতেও পারে অবশ্যই। মুস্তাফিজুরের ‘স্লোয়ার’ আর ‘কাটার’ এর রহস্য ভেদ করতে পারেন দক্ষিণ আফ্রিকানরা। তামিম ভারত সিরিজের শেষ দুই ওয়ানডেতে যেমন রান পাননি, না পেতে পারেন সেই সিরিজেও। সাকিব পারফর্ম করতে না পারেন। নাসির ব্রেকথ্রু এনে দিতে না পারেন। সৌম্য স্বভাবসুলভ আক্রমণাত্মক মানসিকতায় খেলতে গিয়ে আউট হতে পারেন ইনিংসের শুরুতেই। মানে বাংলাদেশ হারতে পারে।

     

    পাকিস্তানকে বাংলাওয়াশ করে, ভারতকে সিরিজ হারিয়ে বাংলাদেশ ‘ইনভিনসিবল’ হয়ে ওঠেনি। অপরাজেয় হয়ে ওঠেনি। নির্দিষ্ট দিনে যে ভাল খেলবে, জিতবে তো সে দলই।

     

    যদি এমনই হয়, তখন? আবার কি শুরু হয়ে যাবে তামিমকে নিয়ে ম্যাগি ন্যুডলসের ট্রল? মধ্যরাতে তাঁদের পরিবারের মানুষকে ফোন করে উলটাপালটা কথা বলা? ফেসবুকে নিন্দার ঝড়!

     

    হতে পারে।

     

    তবে হওয়া উচিৎ কি? একটা সিরিজ হারলেই, একটা ম্যাচ হারলেই শেষ হয়ে যায় কি সব? বাংলাওয়াশ হয়নি বলে ভারত সিরিজ জয়ের আনন্দ শেষ হয়ে যায় কি? একটা নো বলের সিদ্ধান্ত পক্ষে যায়নি বলে ফুরিয়ে কি যায় প্রথমবার বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালে খেলার গর্ব?


    যদি হয়, তাহলে মিছেই এই সুসময়ের জয়গান। মিছে এই সুদিনে পাশে থাকা।

     

    ৮.

    বল করতে ছুটছেন, কোরাস ধরেছে দর্শকরা। প্রতি বলেই উৎসাহ দিয়ে যাচ্ছেন, বাড়তি এক প্রেরণা পাচ্ছেন বোলাররা, ফিল্ডাররা। অথবা প্রতিটা রান কী আনন্দে গ্রহণ করছেন দর্শকরা। ক্রিকেটার মাত্রই প্রেরণা পেতে বাধ্য।

     

    কিন্তু যদি মনের মধ্যে খেলা করে দর্শকদের এই কোরাসের, চিৎকারের অন্যরূপ! যদি এমন হয়, ভাল খেলতে না পারলেই ধেয়ে আসবে সমালোচনা। আকাশচুম্বী প্রত্যাশা না মেটাতে পারলে ধুয়ে দিবেন সেই দর্শকরাই!

     

    তাহলে ক্রিকেটার মাত্রই চাপে পড়তে বাধ্য।

     

    বাংলাদেশের ক্রিকেটের যে সুসময় চলছে, তা উপভোগ করার মতো। তবে সুদিন থাকবে না সবসময়। ওয়ানডেতে বাজেভাবে হারতে হতে পারে। টেস্টে ঠিকমতো দাঁড়ানোর আগেই শেষ হয়ে যেতে পারে সব। যে ঘরোয়া কাঠামো থেকে উঠে এসেছেন এদেশের ক্রিকেটাররা, তাতে এমন হওয়াটাই কিন্তু স্বাভাবিক।

     

    আবেগ সামলিয়ে তাই সময়টা উপভোগ করা যায়। আর তাকানো যায় সামনে। প্রত্যাশা করা যায়, একদিন বিসিবির সুমতির উদয় হবে। তারা ঘরোয়া ক্রিকেট নিয়ে ‘সিরিয়াসলি’ ‘সিরিয়াস’ কিছু ভাববেন। টেস্টেও সুদিন আসবে। ক্রিকেটকে তাড়িয়ে উপভোগ করবেন দর্শকরা। জেতার আনন্দে তো বটেই, হারলেও লড়াইয়ের অনুপ্রেরণায়।

     

    আবেগ সামলিয়ে সুসময় উপভোগ করা, দুঃসময়ে বাস্তবতা মেনে নেওয়া গেলেই ক্রিকেটের আসল রূপটা বেরিয়ে আসবে হয়তো! ক্রিকেট সবকিছুর ওপরে হয়ে উঠবে বাইশ গজের ওই লড়াই। যেখানে খুঁজে পাওয়া যাবে জীবনের প্রতিচ্ছবি।

     

    ক্রিকেটকে ক্রিকেটেরই মন্ত্রে উপভোগের চেয়ে বাড়তি আনন্দ কীসে আছে আর!