আফগানিস্তানের সঙ্গে থ্রিলার জেতালেন মুস্তাফিজ
সুপার ফোর, আবুধাবি
টস- বাংলাদেশ(ব্যাটিং)
বাংলাদেশ ২৪৯/৭ (মাহমুদউল্লাহ ৭৪, ইমরুল ৭২*, আফতাব ৩/৫৪)
আফগানিস্তান ২০৪৬/৭ (হাসমতউল্লাহ ৭১, শাহজাদ ৫৩, মুস্তাফিজ ২/৪৪, মাশরাফি ২/৬২)
বাংলাদেশ ৩ রানে জয়ী
থ্রিলার। থ্রিলারে ক্ষণে ক্ষণে রঙ বদলায়, কাহিনী মোড় নেয়। সব জমা থাকে শেষ দৃশ্যের জন্য। শেষ পর্যন্ত সব জয় করে নেন কেউ। যিনি দূর্ধর্ষ এক নায়ক। আফগানিস্তানের সঙ্গে সুপার ফোরের বাংলাদেশের ম্যাচটা একটা থ্রিলার। আর নায়কের নাম মুস্তাফিজুর রহমান। শেষ ওভারে ৮ রান দরকার ছিল, মুস্তাফিজ দিয়েছেন ৪। শেষ বলে দরকার ছিল ৪, মুস্তাফিজ দেননি কিছুই। এতদিন “শেষে এসে সব হারানো” বাংলাদেশ এবার শেষ পর্যন্ত অপেক্ষা করে জিতেছে ম্যাচ। সঙ্গে টিকিয়ে রেখেছে ফাইনালের আশাও। দুই ম্যাচ হেরে এখন আর আশা নেই আফগানিস্তানের, পাকিস্তানের সঙ্গে শেষ ম্যাচটা তাই বাংলাদেশের জন্য এখন সেমিফাইনালের মতো।
এই ম্যাচে বাংলাদেশ খেই হারিয়ে ফেলতে পারতো প্রথম ইনিংসেই। ৮৭ রানে ৫ উইকেট পড়ে যাওয়ার পর বাংলাদেশকে টেনেছিলেন মাহমুদউল্লাহ ও ইমরুল কায়েস। বোলিংয়ের সময়ও কয়েকবার ছুটে যেতে ধরেছে ম্যাচ, তবে স্নায়ু ধরে রেখেছিলেন তারা। সব এসে ঠেকেছিল ওই শেষ ওভারে, যেখানে মুস্তাফিজের সামনে ছিল “অল-ইন” ধরনের বোলিংয়ের অপশন। মুস্তাফিজ সবটা ঢেলে দিলেন। দ্বিতীয় বলে কট এন্ড বোল্ড করলেন রশিদকে, যিনি আগের ম্যাচে হারিয়ে দিয়েছিলেন বাংলাদেশকে। এরপর লেগবাই, ডট, লেগবাই। শেষে গিয়ে শেনওয়ারির হাতেও অপশন ছিল একটিই- বাউন্ডারি। সেই দ্বৈরথটা জিতে নিলেন মুস্তাফিজ, বনে গেলেন থ্রিলারের নায়ক!
২৫০ রানের লক্ষ্য, আফগানিস্তান শুরুতেই দুই উইকেট হারিয়ে পড়েছিল চাপে। শুরুতে ব্রেকথ্রু দিয়েছিলেন মুস্তাফিজ, ইহসানউল্লাহকে পয়েন্টে ক্যাচ বানিয়ে। এরপর নিজে রান-আউট হওয়ার শোধটা যেন নিলেন সাকিব, কাভার থেকে সরাসরি থ্রো-তে ইনফর্ম রহমত শাহকে আউট করে। শাহজাদের একটা সহজ ক্যাচ পড়তে না পেরে ছেড়েছিলেন মিঠুন, সেই শাহজাদই পরে করলেন ফিফটি। সংগে ছিল আফগানদের ডট বলের প্রবণতা, যেটা চাপ হয়ে বসছিল তাদের ওপর। বাড়ছিল প্রয়োজনীয় রান-রেট।
ব্যাটিংয়ের মতো বোলিংয়ে এসেও ঝলক দেখালেন মাহমুদউল্লাহ, শাহজাদকে বোল্ড করে। তবে বেঁকে বসলেন যেন অধিনায়ক আসগর আফগান ও হাসমতউল্লাহ শাহিদি। হাসমতউল্লাহ করলেন টানা তৃতীয় ফিফটি, ৭১ রান করে বোল্ড হলেন মাশরাফির বলে। তার আগেই আসগরকে ফিরিয়েছেন বাংলাদেশ অধিনায়ক। ১০ ওভারে ৬২ রান দিলেও তার গুরুত্বপূর্ণ দুই উইকেট রাখলো দারুণ ভূমিকা। সঙ্গে ওয়ানডে ক্যারিয়ারে ২৫০ উইকেটও পূর্ণ হয়েছে তার।
আফগানদের লড়াইয়ের গল্পের শেষটা সেখানেই নয়। সেটা হলে তো আর এই ম্যাচ থ্রিলার হয় না!
মোহাম্মদ নবী আসলেন, এ বছর শেষ দশ ওভারে আফগানদের সবচেয়ে কার্যকর ব্যাটসম্যান তিনি। সঙ্গে শেনওয়ারি। ৪৬ রান তারা তুললেন দ্রুতই, চাপটা ফিরে এলো বাংলাদেশের দিকে। ৪৬তম ওভারে নিজে আসতে গিয়েও মুস্তাফিজকে বোলিং দিলেন মাশরাফি, তাকে দিয়ে শেষ তিন ওভার করাবেন বলে। সে সিদ্ধান্তটা কাজে লাগলো অসাধারণভাবে। এর আগের ওভারেই শেনওয়ারিকে এলবিডব্লিউ দিয়েছিলেন আম্পায়ার মারি এরাসমাস, সাকিবের বলে। তবে হক-আই দেখালো, বলটা মিস করে যেতো লেগস্টাম্প। হক-আইয়ের সিদ্ধান্তে যেন হতভম্ব হয়ে গেলেন আম্পায়ার এরাসমাস নিজেও! শেনওয়ারি এরপর আরেকবার আউট হতে পারতেন, তবে 'বেসিক' ভুলে শান্ত দাঁড়িয়েছিলেন বাউন্ডারির অনেক সামনে, বল তাকে মিস করে হলো চার।
শেনওয়ারি ফিরলেন না। ফিরলেন নবী।
৪৯তম ওভারে এলেন সাকিব। এবার নবীর সঙ্গে খেললেন সাহস নিয়ে খেলা। প্রথমে ঝুলিয়ে দেওয়া বলে ছয় খাওয়ার পর আবার তাই করলেন, এবার সামনে এসে লো ফুলটস বানিয়ে চালাতে গিয়ে ক্যাচ দিলেন নবী। শেষ তিন বলে দিলেন চার রান। মুস্তাফিজের জন্য বাকি রাখলেন আট। আর তারপর, মুস্তাফিজ ৩ রান হাতে রেখেই জিতিয়ে দিলেন ম্যাচ!
এর আগের গল্পটা মাহমুদউল্লাহ ও ইমরুলের।
ইমরুল এশিয়া কাপের স্কোয়াডে ছিলেন না। ওপেনিংয়ের দুর্দশা দেখে ডেকে পাঠানো হয়েছিল, তবে নামলেন ছয়ে। তাকে জায়গা করে দিতে সাতে নেমে গেলেন মাহমুদউল্লাহ। দুজন মিলে বাংলাদেশকে পেলেন ৮৭ রানে ৫ উইকেটের অবস্থায়, এশিয়া কাপে যা হয়ে দাঁড়িয়েছে পরিচিত দৃশ্য। দুজন মিলে এরপর গড়লেন ১২৮ রানের জুটি, এ টুর্নামেন্টে বাংলাদেশের জন্য যা সর্বোচ্চ। ইমরুল-মাহমুদউল্লাহকে প্রথমে চাপ সামাল দিতে হয়েছে, কাজ করতে হয়েছে ইনিংস পুনর্গঠনের। এরপর রানের গতি বাড়ানোর চেষ্টাটাও করতে হয়েছে তাদেরই।
পুরো ইনিংসে টাইমিংয়ে অসাধারণ ছিলেন মাহমুদউল্লাহ, রশিদকে পরপর দুই ওভারে মেরেছেন দুইটি ছয়ও। ৪১তম ওভারে সিঙ্গেল নিয়ে পূরণ করেছেন ২০তম ফিফটি, এরপর গেছেন ৭৪ রান পর্যন্ত। শেষ পর্যন্ত টাইমিংয়েই গড়বড় হয়েই আউট হতে হয়েছে তাকে, আফতাবের অফস্টাম্পের অনেক বাইরের বলে খেলতে গিয়ে ডিপ পয়েন্টে দিয়েছেন ক্যাচ।
ইমরুল ধীরগতির ছিলেন, তবে মাহমুদউল্লাহকে দিয়েছেন যোগ্য সমর্থন। স্ট্রাইক বদলের চেষ্টা করে গেছেন, শেষে গিয়ে খেলেছেন দারুণ সব শট। স্পিনে সোজা খেলার চেষ্টা করছিলেন। ৭৭ বলে পূর্ণ করেছেন ফিফটি, শেষ পর্যন্ত করেছেন ৮৯ বলে ৭২ রান। পরে ৯ বলে ১০ করে আফতাবের স্লোয়ারে স্কুপ করতে গিয়ে ক্যাচ দিয়েছেন মাশরাফি। মিরাজ অপরাজিত ছিলেন ৪ বলে ৫ রানে।
এর আগে বাংলাদেশের শুরুটা ছিল দারুণ হতাশার। আবারও ডট বলের চাপ নিতে পারেননি শান্ত, আফতাবকে জায়গা বানিয়ে কাভারের ওপর দিয়ে উড়িয়ে খেলতে গিয়ে মিসহিটে দিয়েছেন ক্যাচ, ১৮ বলে ৬ রান করে। তিনে উঠে আসা মিঠুন বুঝতেই পারেননি মুজিবের স্পিন, ব্যাট নামানোর আগেই সব শেষ হয়ে গেছে তার।
এরপর লিটন-মুশফিকের জুটিতে বাংলাদেশ ঠিক পথেই ছিল।
লিটন ক্যারিয়ার সর্বোচ্চ রান করলেন, এমনকি এর চেয়ে (৪৩) বেশি বল ওয়ানডেতে লিটন এর আগে খেলেনননি। ছন্দে ছিলেন, ইনিংসও ছিল গোছানো। রশিদ খানের বলে ইনসাইড-আউটে দারুণ একটা চার মারলেন, তবে পরের বলেই ফুললেংথের বলে স্লগ করতে গিয়ে হারালেন নিয়ন্ত্রণ। লিটনের ইনিংস যতোটা ভাল ছিল, আউটের ধরন ছিল তার চেয়েও বাজে।
তিন বলের ব্যবধানে দ্বিতীয় উইকেট হারালো বাংলাদেশ, মুশফিকের সঙ্গে ভুল বুঝাবুঝিতে রান-আউট পাঁচে নামা সাকিব। দুর্দশা বাড়লোই শুধু এরপর, ইমরুলের সঙ্গে ভুল বুঝাবুঝিতে এবার কাটা পড়লেন এদিনই তৃতীয় বাংলাদেশী হিসেবে পাঁচ হাজার রান পূর্ণ করা মুশফিকুর রহিম, রশিদ তার বাহু দিয়ে ভাঙলেন স্টাম্প। মুশফিক এর আগে একটা জীবনও পেয়েছিলেন স্লিপে।
তখনও জানা ছিল না, শেষ বলের পর মুশফিকের একটা বুনো উল্লাস দেখা যাবে!