• বাংলাদেশ-জিম্বাবুয়ে
  • " />

     

    'ধৈর্য' আর 'মনযোগই' মুশফিকের হাইলাইটস

    'ধৈর্য' আর 'মনযোগই' মুশফিকের হাইলাইটস    

    ধৈর্য। মনযোগ। একাগ্রতা। এবং অতি অবশ্যই সংযম।

    এই হচ্ছে মুশফিকুর রহিমের ২১৯ রানের ইনিংসের হাইলাইটস। পরিসংখ্যান বলছে, এমনিতেই এই ইনিংসটা ‘ভেরি ভেরি স্পেশাল’। বাংলাদেশের হয়ে টেস্টে ব্যক্তিগত সর্বোচ্চ স্কোর, প্রথম উইকেটকিপার হিসেবে দুইটি ডাবল সেঞ্চুরি- এসব রেকর্ড তো বাঁধিয়ে রাখার মতোই। তবে এই ডাবল সেঞ্চুরির মাহাত্ম্য তার চেয়েও কিছুটা বেশি। বাংলাদেশের হয়ে টেস্টে মিনিট বা বলের হিসেবে দীর্ঘতম ইনিংস- এই রেকর্ড দিয়ে দিয়ে কিছুটা বোঝা যাবে মাহাত্ম্য। আর বাকিটা বোঝা যাবে একদম ওপরের লাইনের চারটি শব্দ দিয়ে।

    ২০০৩-০৪ মৌসুমে সিডনিতে শচীন টেন্ডুলকার খেলেছিলেন ২৪১ রানের মহাকাব্যিক একটা ইনিংস। সেই ইনিংসে একবারও নিজের প্রিয় কভার ড্রাইভ খেলেননি, যুধিষ্ঠিরসম সংযমে বেঁধে রেখেছিলেন নিজেকে। মুশফিককে অবশ্য অতটা ত্যাগ স্বীকার করতে হয়নি। জিম্বাবুয়ের স্পিনারদের ঔদার্যের সুযোগে নিজের প্রিয় শট স্লগ সুইপও খেলতে পেরেছেন এক দুবার। ডাউন দ্য উইকেটে এসে মেরেছেন একটা ছয়ও। তারপরও মুশফিক ইনিংসের বড় একটা সময় নিজেকে বেঁধে রেখেছিলেন ঋষীসুলভ সংযমে। সিলেটে যে ভুল করেছিলেন, সেটি থেকে শিক্ষা নিয়েছেন একেবারে হাতে কলমে।

    সিলেটের ওই টেস্টের কথাই মনে করা যাক। প্রথম ইনিংসে জার্ভিসের অফ স্টাম্পের বাইরের বলটা খোঁচা মেরেছেন। পরের ইনিংসে নিজের প্রিয় স্লগ সুইপ করতে গিয়ে ক্যাচ দিয়েছেন ডিপ স্কয়ার লেগে। মুশফিক এবার সেই দুই ভুল আর সচেতনভাবে করেননি। কাল একবার শুধু বল স্লিপের ওপর দিয়ে চলে গিয়েছিল। আর জার্ভিসের বলে একটা শট চলে গেছে স্লিপ আর গালির মাঝ দিয়ে। তা ছাড়া চতুর্থ বা পঞ্চম স্টাম্পের প্রলোভন এড়িয়ে গেছেন দারুণ একাগ্রতায়। আর স্পিনারদের বলে স্লগ সুইপ করার সুযোগ তো মিলেছিল এন্তার। সেই ফাঁদেও পা দেননি একবারও। ১৯৯ রানে যখন মাভুতাকে এক ওভার মেডেন দিলেন, একবার মাত্র সুইপ করতে গিয়েছিলেন। সেটা থেকে রান হয়নি, তবে তাতে মুশফিক ধৈর্য হারাননি। ঠিক বল আর ঠিক মুহূর্তের জন্য অপেক্ষা করেছেন চিলের একাগ্রতায়। বাংলাদেশের ব্যাটিং যখন অগ্নিপরীক্ষার সামনে, মুশফিক সেই জতুগৃহ থেকে বেরিয়ে এসেছেন দিগ্বিজয়ী হয়েই।

    আজকের ডাবল সেঞ্চুরিতে যে মুশফিক কোনো সুযোগই দেননি সেটা মনে করিয়ে দিয়েছেন ম্যাচ শেষে, ‘ আমি এই ইনিংসে কোন রকম ঝুঁকি না নিয়েই খেলেছি। এটা আমার কাছে বড় ফ্যাক্ট মনে হয়েছে। আমার যেগুলো প্রিয় শট, সেগুলো ছাড়াই যে আমি এত ইজিলি রান করতে পারি, এই বিশ্বাসটা এসেছে নিজের খেলার মধ্যে। পরের বার এমন হলে আমি সেই শটস গুলোতে ফিরতে পারব। এটা এই ইনিংসে বড় অর্জন ছিল।’ 

    স্পিনাররা না পারলেও পেসাররা বিশেষ করে জার্ভিসও ধৈর্যের চূড়ান্ত পরীক্ষা নিয়েছেন মুশফিকের। সেই পরীক্ষায় এবার শতভাগ নম্বর পেয়ে পাশ। নিজেকে যে এই শৃঙ্খলে বেঁধে রাখাটা আলাদা তৃপ্তি দিচ্ছে মুশফিককে। মনযোগের কথাটা তাই বললেন আলাদা করেই, 'টেস্ট খেলতে গেলে ধৈর্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। আপনি যখন মিরপুরের উইকেটে খেলবেন ব্যাটসম্যান হিসেবে কখনও বলতে পারবেন না পরে কি আসছে। তবে এটা আজকে আমার জন্য বাড়তি সুবিধা ছিল। কারণ, অন্যান্য উইকেটে দেখা যায়, আমি অন্যান্য শট খেলতে যেতাম বা ভাবতাম এই বলটা এদিক খেলি। সে তুলনায় আমাকে এই উইকেটে প্রতিটি বলে গভীর মনোযোগ দিতে হয়েছে। কারণ, এখানে নতুন বা পুরান যে বলই হোক হঠাৎ করে বাড়তি বাউন্স করেছে বা নিচু হয়ে গেছে। এখানে ব্যাটিং করাটা সহজ ছিল না। আর এই ব্যাপারটা এক দিক থেকে আমাকে সাহায্য করেছে।'

    স্বাভাবিকভাবেই তুলনা চলে আসবে পাঁচ বছর আগে গলের সেই ডাবল সেঞ্চুরির সাথেও। যে কোনো প্রথমের আবেদন অন্যরকম, তবে মুশফিক এখনই এই ইনিংসটা সেরা বলছেন না, ‘এগিয়ে রাখার সময় আসে নি। যদি এই ম্যাচটা জিততে পারি তাহলে এটাই এগিয়ে থাকবে। কারণ আমরা গলে টেস্ট জয় করি নি, ড্র করেছি। ওটাও কঠিন ছিল। কারণ ওরা ৫০০ রানের মত করেছিল। তারপর এসে ব্যাট করা সহজ ছিল না এবং অ্যাগেইন্সট অ্যা কোয়ালিটি অ্যাটাক। আবার এই উইকেটে শুরুতে এসে ব্যাট করার সময় বোলারদের যথেষ্ট হেল্প ছিল, আর বোলাররাও যথেষ্ট ভাল করছিল।’

    তবে এরপর যে কথাটা বললেন, তাতেই বোঝা গেল এই ইনিংসটা কেন আলাদা, ‘এই ইনিংসটাকে গলের তুলনায় অনেক কমপ্যাক্ট বলতে পারেন। আমি এখানে বলও অনেক খেলেছি। আমার মনে হয় এটা ভাল ইনিংস ছিল। সেরা বলব না, তবে ভাল ইনিংস ছিল।’

    মুশফিক মুখ ফুটে না বললেও অবশ্য সমস্যা নেই।  রেকর্ড নয়, প্রতিজ্ঞা আর সংযমের চূড়ান্ত পরাকাষ্ঠার জন্যই এই ইনিংসটা বাংলাদেশের টেস্ট ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে থাকবে অনেক দিন।