• বাংলাদেশ-জিম্বাবুয়ে
  • " />

     

    মুশফিকের ব্যাটিং-কিপিং : 'ইন ও ইয়াং'?

    মুশফিকের ব্যাটিং-কিপিং : 'ইন ও ইয়াং'?    

    খালেদ আহমেদের ক্যারিয়ারের প্রথম বল। মিরপুর টেস্টে খেলা বাংলাদেশীদের মধ্যে শারীরিক উচ্চতায় খালেদ এগিয়েই থাকবেন। হ্যামিল্টন মাসাকাদজাকে খালেদ করলেন শর্ট। পরের বলটা আরও বেশি, এটি আবার বেরিয়ে গেল লেগস্টাম্পের বাইরে দিয়ে। মুশফিক বাঁদিকে লাফ দিয়ে ধরলেন। উচ্চতায় মুশফিক খালেদের ঠিক বিপরীত। তবে মুশফিক উচ্চতাকে হার মানিয়ে কিপিং করছেন- পয়েন্ট ঠিক সেটা নয়। মুশফিক মিনিট দশেক আগেই শেষ করেছেন ব্যাটিং। এর আগে আর কোনও বাংলাদেশী ব্যাটসম্যান এতো সময় ক্রিজে থাকেননি, এতো বেশি বল খেলেননি। মুশফিকের চোখে-মুখে ক্লান্তির ছাপ আপনি পাবেনই না! 

     

    ****

     

    দুইটি পরিসংখ্যান। স্বীকৃত উইকেটকিপার হিসেবে কমপক্ষে ৫০ টেস্ট খেলা ক্রিকেটারদের মধ্যে ব্যাটিং গড়ে মুশফিকুর রহিমের ওপরে শুধু তিনজন। জিম্বাবুয়ের অ্যান্ডি ফ্লাওয়ার, অস্ট্রেলিয়ার অ্যাডাম গিলক্রিস্ট, ইংল্যান্ডের ম্যাট প্রায়র। জিম্বাবুয়ের ইতিহাসে ফ্লাওয়ারের চেয়ে বেশি রান নেই আর কারও, যার বেশিরভাগই তিনি করেছেন উইকেটকিপার হিসেবেই। তবে অস্ট্রেলিয়ায় গিলক্রিস্টের চেয়ে বেশি রান আছে আরও ১৫ জনের। প্রায়রের চেয়ে বেশি রান আছে আরও ৩২ ইংলিশ ব্যাটসম্যানের। আর বাংলাদেশের ইতিহাসে এখন দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রান মুশফিকের, তার ওপরে শুধু তামিম ইকবাল। গিলক্রিস্ট বা প্রায়র নয়, মুশফিকের ‘ক্যাটাগরি’তে এখানে সবচেয়ে মিল ফ্লাওয়ারের সঙ্গেই। 

    আর তারপর, কমপক্ষে ৫০ টেস্ট খেলা ২৮ জন উইকেটকিপারের মধ্যে প্রতি ইনিংসে ডিসমিসাল সবচেয়ে কম মুশফিকের। অবশ্য এখানে ফ্লাওয়ারের রেকর্ডটাও মুশফিকের চেয়ে খুব ভাল নয়। তার ডিসমিসাল রেট ১.৫৭২, মুশফিকের ক্ষেত্রে সেটা ১.১৬৩। অবশ্য ডিসমিসালের ক্ষেত্রে বোলিং আক্রমণের ওপরও নির্ভর করে অনেককিছু। গুরুত্বপূর্ণ সময়ে মুশফিক ক্যাচ ফেলেছেন বা সুযোগ হাতছাড়া করেছেন- এমন ঘটনাও আছে। 

    কিন্তু, এরপর আরেকটা পরিসংখ্যান আপনাকে আরেকটু ভাবাবে। ক্যারিয়ারে ১২টি ম্যাচ মুশফিক উইকেটকিপিং না করে খেলেছেন, সেখানে ব্যাটিং গড় ২৪.৪৭। কিপিং করলে সেই গড়টাই বেড়ে দাঁড়ায় ৩৮.৭৪-এ। এই ১২ ম্যাচে সেঞ্চুরি নেই একটিও, বাকি ৫২ ম্যাচে সেঞ্চুরি ৬টি। এর মধ্যে দুইটি ডাবল। মিরপুরের সাম্প্রতিকতম ডাবলে মুশফিক তো ছাড়িয়ে গেলেন সব উইকেটকিপারকেই। মুশফিকের ব্যাটিং ও উইকেটকিপিং কি তবে ‘ইন ও ইয়াং’- এর মতো? বিপরীতমুখী হলেও একটিকে ছাড়া আরেকটি অচল? 

     

    ****

     

    সিলেটের উইকেট পড়তে গিয়ে গুবলেট পাকিয়ে ফেলেছিল বাংলাদেশ। টসে জিতে ব্যাটিং নেওয়ার পর ২৬ রানে ৩ উইকেট পড়ার পর মনে হতে পারে, মিরপুরের উইকেটও কি তবে বুঝলো না বাংলাদেশ? প্রথম দিনশেষে অবশ্য বদলে গেছে অনেক চিত্রই। আর দ্বিতীয় দিনশেষে তো বলাই যায়, মিরপুরের উইকেটকে নিজের করেই নিয়েছে বাংলাদেশ। আরও নির্দিষ্ট করে বললে, মুশফিকুর রহিম। ১৭৮ ওভার খেলা হয়েছে দুই দিন মিলিয়ে, মুশফিক মাঠে ছিলেন ১১.১ ওভার ছাড়া সবকটিতেই। হয় উইকেটের সামনে, অথবা পেছনে। ব্যাটিংয়ে উইকেটকে যেমন বুঝেছেন, এরপর সেটা নিয়ে পরামর্শ দেওয়ার চেষ্টা করেছেন বোলারদের। 

    “কিপিং করেছি কারণ কোন উইকেটে ছিলাম এই ফিডব্যাক যেন আমি আমার বোলারদের দিতে পারি। আমি যত সহজে বুঝতে পারব অন্যরা পারবে না”, মুশফিক বলছেন মাসাকাদজার আউটের ঘটনা, “এরকম হয়েছিল, তাইজুল যখন একটা প্রান্ত থেকে বল করছিল আমি বললাম যেন অন্যদিক থেকে করে। কারণ শেন উইলিয়ামস যখন অন্য দিক থেকে বল করছিল বল একটু উঠছিল নামছিল। ওই প্রান্ত থেকে বাঁহাতি স্পিন খেলা কঠিন হবে। মাসাকাদজা কিন্তু ওই প্রান্ত থেকেই আউট হয়েছে। এটা নাও হতে পারত, কিন্তু এই টেস্টটা আমাদের যে কোনোভাবে জিততে হবে। সেটাই আর কী।”

    মাসাকাদজার আউটের পর মুশফিক উল্লাসটাও করলেন সাধারণ উইকেটকিপিং উদযাপনের চেয়ে আলাদা। এ উইকেটে যেন ভাগ আছে তারও! 

     

    **** 

     

    মুশফিকের অভিষেকের পর তিনি ছাড়া টেস্টে বাংলাদেশের হয়ে কিপিং করেছেন আর তিনজন। শুরুর দিকে খালেদ মাসুদ, এরপর লিটন দাস, নুরুল হাসান। লিটন দক্ষিণ আফ্রিকা সফর ও শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ঘরের মাটিতেও উইকেটকিপার ছিলেন, আর ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরে ছিলেন নুরুল। 

    এ ম্যাচগুলোতে লিটনের ব্যাটিং গড় ২৯.৬১, মাসুদের ১৬.১৫, নুরুলের ১৯.১৬। 

    জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে উইকেটের পেছনে মুশফিক ফিরলেন আবার। বরাবরই মুশফিক বলে এসেছেন, তার পুরো খেলার ক্ষেত্রে সাহায্য করে কিপিংটা। আজও বললেন সেটাই, “কিপিং যেটা বলি আমাকে অনেক বেশি সাহায্য করে। এমন নয় কিপিং করলে আমি প্রতি ম্যাচেই একশ বা দুইশ করব। কিন্তু কিপিংটা একটা প্রক্রিয়া এবং আমি প্রক্রিয়ায় অনেক বেশি বিশ্বাসী। আমার মনে হয় এটা অনেক সাহায্য করে।”

    সিলেট টেস্টের আগে কোচ স্টিভ রোডস বলেছিলেন, কী কারণে ঠিক মুশফিক কিপিং করছেন, সেটা খোলাসা করতে চান না। তবে তারও চাওয়া মুশফিক কিপিং করুন। মুশফিকও বলছেন সেরকমই, “এখন টিম ম্যানেজমেন্ট যেটা চাইবে সেটা তো তাদের ব্যাপার। সেভাবে অবদান রাখতে চেষ্টা করি। অনেক সময় কিপিং করে বা ব্যাটিং করে ওয়ার্কলোড বেশি হয়ে যায়।

    “কিন্তু আমার জন্য এটা চ্যালেঞ্জ, এবং আমি চ্যালেঞ্জ উপভোগ করি। আমি চাই না এমন একটা মানুষ যে ড্রেসিংরুমে বসে থাকি।  আমি যতক্ষণ মাঠে থাকব আমি যেন দলের জন্য কিছু করতে পারি, নইলে খারাপ লাগে। সামনে এই দায়িত্ব আমাকে দিলে আমার মনে হয় আমি ভাল ফল দিতে পারি।” 

     

    **** 

     

    দিনের খেলা শেষ। মুশফিক ক্লোজ-ইন ফিল্ডার মুমিনুল হকের সঙ্গে কথা বলছিলেন শেষ বলের পর। কিছু একটা বুঝাচ্ছিলেন মুমিনুলকে। ব্রায়ান চারি হাতটা মেলালেন মুশফিকের সঙ্গে, দারুণ এক ইনিংসের অভিনন্দনই জানালেন হয়তো। দেখে মনে হবে, মুশফিকের আলোচনায় হয়তো অনাহুত বিচ্যুতি ঘটলো একটু। মুমিনুলের সঙ্গে কথা শেষে মিরাজের সঙ্গে কিছু একটা বলছিলেন, লিটন পিঠটা চাপড়ে দিলেন। মুশফিক সেদিকেও যে খুব বেশি মনযোগ দিলেন, তাও নয়। 

    মুশফিক যেন তখনও আছেন খেলার মাঝেই। 

    মুশফিক আদতেই খেলায় ছিলেন। থাকবেন আরও। কিপিংয়ের রেকর্ডটা আহামরি না হলেও, ব্যাটিংয়ে ঠিকই ভাঙছেন রেকর্ড। মুশফিকের ব্যাটিং আর কিপিং যেন ইন ও ইয়াং। আলো আছে বলেই না ছায়া!