• বিশ্বকাপের ক্ল্যাসিক মুহুর্ত
  • " />

     

    ১৯৮৩ : যে অঘটনে বদলে গেল সব

    ১৯৮৩ : যে অঘটনে বদলে গেল সব    

    জোয়েল গার্নার (ও. ইন্ডিজের ১০ নম্বর ব্যাটসম্যান) : কী মনে হয়, আজ তোমাকে ব্যাটিং করতে হবে? 
    ম্যালকম মার্শাল (৮ নম্বর ব্যাটসম্যান) : হ্যাঁ। তোমাকেও করতে হবে। 
    (গার্নারের চোখে বিস্ময়, সেটা লক্ষ্য করে ব্যাখ্যা করার প্রয়োজন বোধ করলেন মার্শাল) দেখো, আমরা যখনই কম রান তাড়া করি, সবাই ভাবে পরের জন কাজটা করে দিবে।
    গার্নার : তাই যদি হয়- তাহলেই সেরেছে আজ। 

    **** 

    আয়াজ মেমনের দ্বিতীয় সফর, উপমহাদেশের বাইরে প্রথম। তখনও আইনের ডিগ্রিটা কাজে লাগাবেন নাকি ক্রিকেট-লেখক হওয়ার ভূতটা লালন করবেন মস্তিস্কে- দ্বিধা ছিল মনে।

    ভারত থেকে সেবার বিশ্বকাপ কাভার করতে গিয়েছিলেন আয়াজের মতে ছয়জন সাংবাদিক। ঠিকই পড়েছেন- ছয়জন। অফিস নয়, অনেকটা খরচ বহন করতে হতো তখন নিজেদেরই। এতো নিরাপত্তার বালাই ছিল না, আয়াজ জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে কপিল দেবের সেই ১৭৫ রানের ইনিংসের কিছুটা দেখেছিলেন ভারতের ড্রেসিংরুমের বাইরে গুন্ডাপ্পা বিশ্বনাথের সঙ্গে বসে। সুনীল গাভাস্কারের সঙ্গেও বিশ্বকাপ চলার সময়ই আড্ডা হতো আয়াজের, দুজনই 'হেভি স্মোকার' ছিলেন বলে শ্রীকান্তের সঙ্গে ব্যাপারটা জমতো বেশ। সে ছয়জন সাংবাদিক যেন ছিলেন ভারত দলের বর্ধিত অংশের সদস্য। 

    ভারতের প্রথম ম্যাচটা মিস করেছিলেন আয়াজ, ওল্ড ট্রাফোর্ডে না গিয়ে তিনি থেকে গিয়েছিলেন ওভালে নিউজিল্যান্ডের ম্যাচটা দেখতে। যে সিদ্ধান্তটা আজও পোড়ায় তাকে। অবশ্য এরপর ছায়ার মতো লেগে ছিলেন ভারত দলের সঙ্গে- ফাইনাল অবধি। 

    ইংল্যান্ডকে টপকে ভারত যখন ফাইনালে উঠলো, শুরুতে ভারতীয় সাংবাদিকদের প্রেসবক্সের অ্যাক্রিডিটেশন কার্ড দিতে চায়নি লর্ডস কর্তৃপক্ষ। পরে অবশ্য সেটা পেয়েছিলেন আয়াজরা। ফাইনালের দিন ট্রেনের বদলে ট্যাক্সি নিয়েছিলেন, মাঠে ঢোকার সময়ই একটা রব শুনলেন- একটু পর বুঝলেন- সুনীল গাভাস্কার আউট হলেন। প্রেসবক্সে ঢোকার মুখে রিচি বেনোর সঙ্গে দেখা, বেনো তাকে বাজি অফার করেছিলেন, ভারত জিতলে ১ এর বিপরীতে ৬৬ হারে। আয়াজ সেটা নেননি। ১৯৮৩ সালের এই আরেকটা সিদ্ধান্ত আজও পোড়ায় আয়াজকে, শুধু কতোগুলো টাকা জিততে পারতেন বলে নয়, বেনোর বাজিতে রাজি হলে গল্পটা যে অন্যভাবে লিখতে পারতেন তিনি। 


    ****

    সন্দিপ পাতিলের বয়স তখন ২৭, তবে প্রথমবারের মতো ইংল্যান্ড সফর। এর আগে কোনো ক্যাম্প নেই, কিছু নেই। আগের দুই বিশ্বকাপে ভারতের সম্বল একটি জয়, সন্দিপের কাছে এটা ছিল স্রেফ একটা ভ্রমণ আর তা থেকে অভিজ্ঞতা সঞ্চয়ের মত ব্যাপার। 

    প্রথম ম্যাচেই ওয়েস্ট ইন্ডিজকে হারিয়ে দিয়েছিল ভারত। সন্দিপরাও যেন সেটা বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। ক্যারিবীয় ভয়ঙ্কর বোলার বা ব্যাটসম্যানদের মুখোমুখি হওয়ার চেয়ে তাদের মাথায় ছিল বাকিংহাম প্যালেস বা ট্রাফালগার স্কয়ার দেখা। অবশ্য ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে নিজেদের জয়ের সঙ্গে জিম্বাবুয়ের অস্ট্রেলিয়াকে হারানো তাদেরকে একটা আত্মবিশ্বাস দিয়েছিল- সম্ভব হয়তো অনেক কিছুই। কেমন কেমন করে এরপর যেন উধাও হয়ে গেল বাকিংহাম প্যালেস, মিলিয়ে গেল ট্রাফালগার স্কয়ার। সন্দিপরা ঢুকে পড়লেন ক্রিকেটে। 

     

     

    ভারতের নতুন অধিনায়ক, মাস চারেক আগেই সুনীল গাভাস্কারকে সরিয়ে অধিনায়কত্ব দেওয়া হয়েছে কপিল দেবকে। কপিলের বয়স তখন ২৪। হিন্দি বা ইংরেজি, কোনোটাতেই ঠিক সুবিধা করতে পারেন না। ম্যাচের আগে টিম মিটিংয়ে কপিলের বক্তব্য হয় খুবই শর্টকার্ট-মার্কা। কথাটা শেষ করেন এটা বলে, ‘শেরো, জিত লো! (বাঘেরা, জিতে নাও!)’। 

    ফাইনালেও বলেছিলেন। তবে ১৮৩ রানে অল-আউট হয়ে রিচার্ডস ভারতীয় বোলারদের ওপর চড়াও হলেন ক্ষুধার্ত বাঘের মতো। ডিপ স্কয়ার লেগে ফিল্ডিং করছিলেন সন্দিপ। ক্রিকেটারদের ফ্যামিলি এনক্লোজার ঠিক তার পেছনেই, সেখানে বসা সুনীল গাভাস্কারের স্ত্রী পাম্মি মার্শনেইল সন্দিপকে একটা বার্তা দিলেন স্বামীকে দিতে। ফাইনালের ১৫ মিনিট পর সেন্ট জনস উডে যেন তার সঙ্গে দেখা করেন গাভাস্কার। বার্তাটা গাভাস্কারের কাছে প্রান্তবদলের এক বিরতিতে পৌঁছালেন সন্দিপ। 

    পরের ওভারে মদন লালের বলে কপিল দেবের সেই বিখ্যাত ক্যাচে ফিরলেন রিচার্ডস। 


    ****

    রাজদীপ সারদেশাইয়ের বয়স ১৮, অক্সফোর্ডে পড়েন, তবে বাবা দিলিপ সারদেশাইয়ের মতো মাথার মধ্যে ক্রিকেটের ভূতটা তারও। ইংল্যান্ডের এক লিগে খেলছিলেন। 

    ফাইনালের টিকেট শেষ হয়ে গিয়েছিল মাসখানেক আগেই। বেশিরভাগই কিনেছিলেন ইংলিশরা, তাদের দল ফাইনালে উঠবে অনুমান করে। তবে ভারত বেশিরভাগ ইংলিশদেরই হতাশ করল। খেলা দেখার ইচ্ছা ছিল রাজদীপদের, মিলছিল না টিকেট। হুট করেই পেয়ে গেলেন সেটা। যোগ দিলেন বন্ধুদের সঙ্গে। তাদের সঙ্গে ছিলেন সাবেক টেস্ট ক্রিকেটার যাজুরবিন্দ্র সিং। আর রাজকোটের বিখ্যাত রাজকুমার কলেজের একটা দল, যারা ছিল ইংল্যান্ড পরিদর্শনে। 

    ভারত অল-আউট হয়ে যাওয়ার পর যাজুরবিন্দ্র ছুটলেন শপিংয়ে। সেদিন তার ভাই এসে পৌঁছেছেন লন্ডনে। ‘নিয়মরক্ষার’ দ্বিতীয় ইনিংস দেখার চেয়ে সময়টা কাজে লাগাতে চেয়েছিলেন তিনি। রাজদীপের মতে, জীবনে হয়তো এর চেয়ে বাজে সিদ্ধান্ত আর নেননি যাজুরবিন্দ্র। 

    **** 

    মুকুল কেশাভান দিল্লীতে, প্রথম বইটা বের হতে তখনও ১১ বছর দেরি তার। 

    ১৯৮২ সালে এশিয়ান গেমস প্রথমবারের মতো জাতীয়ভাবে দূরদর্শন চ্যানেলে ব্রডকাস্ট করা হয়েছিল ভারতে। ১৯৮৩ সালের বিশ্বকাপ তাই প্রথম ক্রিকেট ইভেন্ট- দিল্লী, মুম্বাই(বোম্বে), কলকাতা (ক্যালকাটা), চেন্নাইসহ (মাদ্রাজ) গোটা ভারতের দর্শকরা দেখেছিলেন একই সঙ্গে। ততদিনে রঙিন টিভিও এসে গেছে, তবে মুকুলদের বাসায় তখনও সাদা-কালো সেট। অবশ্য ফাইনালটা দুই রকমের টিভিতেই দেখেছিলেন মুকুল। প্রথম ভাগটা নিজেদের সাদা-কালো সেটে, ভারতের ব্যাটিংয়ের পর জেঁকে বসা হতাশাটা ভাগ করতে গিয়েছিলেন এক বন্ধুর বাড়ি, যার কাছে ছিল রঙিন টেলিভিশন। 

    প্রথম ইনিংসে ভারতের পারফরম্যান্সটা ছিল সাদা-কালোই, সঙ্গে অনুমিত। অ্যান্ডি রবার্টস-জোয়েল গার্নার- মাইকেল হোল্ডিং- ম্যালকম মার্শালদের সঙ্গে ল্যারি গোমেজের তোপে ভারত শেষ ১৮৩ রানেই। সর্বোচ্চ ২৮ রান কৃষ্ণচামারি শ্রীকান্তের, ৮০ বলে ২৮ রানের ‘মূল্যবান’ ইনিংস মহিন্দর অমরনাথের। তবে সে ইনিংসটা অমরনাথকে কোন রঙে রাঙাবে সেটা তখন কে জানতেন! 

    ****


    বালবিন্দর সান্ধু। মদন লাল। রজার বিনি। মহিন্দর অমরনাথ। চারজনের মাঝে যেন অলিখিত প্রতিযোগিতা ছিল- কে কার চেয়ে ধীরগতির বোলিং করবেন। কপিল দেবের পেসের সঙ্গে ভারতের আক্রমণ ছিল এই চারজনের- সবাই স্লো মিডিয়াম পেসার, নিরীহগতির বোলিং সবার। সান্ধু, মদন, বিনিরা মিলিয়ে ওয়েস্ট ইন্ডিজকে বানিয়েছিলেন ৭৬ রানে ৬ উইকেটে। 

    জেফ ডুজনের সঙ্গে মার্শালের জুটি হুমকি দিচ্ছিল। এলেন অমরনাথ। 

    মুকুল তখন ডিনার করতে বাসায় ফিরেছেন। আবার সেই সাদা-কালো টিভি। তার ভেতরে অমরনাথ হয়ে উঠলেন রঙিন। ফিরলেন ডুজন, ফিরলেন মার্শাল। মাঝে কপিলের বলে এলবিডব্লিউ রবার্টস। অমরনাথ শেষটা করলেন হোল্ডিংকে এলবিডব্লিউ করে। 

    মুকুলরা চিৎকার করে উঠলেন। দিল্লী চিৎকার করে উঠলো। কলকাতা, মুম্বাই, চেন্নাইসহ গোটা ভারতই তাই। 

     

     

    লর্ডসের ভেতরে তখন ছুটতে শুরু করেছেন রাজদীপরা। এক ক্যারিবীয় সমর্থক একটা বিয়ারের ক্যান ছুঁড়ে মেরেছেন তাদের দিকে লক্ষ্য করে। রাজদীপ সেটা ক্যাচ ধরলেন, যেটুকু বিয়ার বাকি ছিল, চালান করলেন গলার ভেতর। 

     

    আয়াজ তার ম্যাচ রিপোর্টটা শেষ করে মানসিকভাবে ধাতস্থ হয়েছেন নিজের ভবিষ্যত নিয়ে- বাবার মতো আইনজীবী নয়, ক্রিকেটলিখিয়ে হয়েই জীবনটা কাটিয়ে দিতে পারবেন তিনি। 

    গাভাস্কারের স্ত্রী সেদিন ম্যাচ শেষে শীঘ্রই দেখা পাননি স্বামীর। 


    এরপর কী ঘটেছিল- 
    আয়াজ মেমন ভারতের বিখ্যাত ক্রিকেট-সাংবাদিক, লেখকদের একজন। ভারতের হয়ে আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারটা সন্দিপের শেষ হয়েছিল ১৯৮৬ সালে। ২০০৩ বিশ্বকাপে সেমিফাইনাল খেলা কেনিয়ার কোচ ছিলেন তিনি, পরে ছিলেন ভারতের প্রধান নির্বাচকও। রাজদীপ ক্রিকেটে ক্যারিয়ারটা গড়তে পারেননি, হয়েছেন মিডিয়া ব্যক্তিত্ব। ২০০৮ সালে তার এক টিভি অনুষ্ঠানে হাজির হয়েছিলেন ১৯৮৩ বিশ্বকাপ জেতা ভারত স্কোয়াডের সব সদস্য। মুকুল ইতিহাসবীদ, ঔপন্যাসিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক কলাম লেখক এখন, ১৯৯৪ সালে তার প্রকাশিত প্রথম উপন্যাস লুকিং থ্রু গ্লাসেস সমাদৃত হয়েছিল আন্তর্জাতিক মহলে।

    আর ক্যারিয়ারের সবচেয়ে বড় হতাশা হিসেবে ১৯৮৩ ফাইনালের হারটাকে উল্লেখ করেন জোয়েল গার্নার। ১৯৯৯ সালে ৪১ বছর বয়সে মারা গেছেন ম্যালকম মার্শাল। ১৯৮০ সালে ওয়ানডে অভিষেক হয়েছিল বলে বিশ্বকাপটা জেতা হয়নি তার।