• এএফসি কাপ
  • " />

     

    মামুনুলের ৮৮ মিনিটের গোলে চেন্নাইনকে হারিয়ে আশা বাঁচিয়ে রাখল আবাহনী

    মামুনুলের ৮৮ মিনিটের গোলে চেন্নাইনকে হারিয়ে আশা বাঁচিয়ে রাখল আবাহনী    

    ম্যাচ শেষের বাঁশি বাজতেই আবাহনী কোচ মারিও লেমোস হাঁটা ধরলেন অ্যাথলেটিক ট্র্যাক ধরে। সাদা শার্টের ওপরে বিব পরতে হয়েছে তাকে ডাগ আউটে। হাঁটতে হাঁটতে ট্র্যাক পার করে আবাহনী গ্যালারির সামনে গিয়ে থামলেন। বিব খুলে ফেলেছেন। দুই হাত উঁচু করে মাঠে আসা শ'খানেক সমর্থকদের সঙ্গে উদযাপন করলেন লেমোস। ইউরোপিয়ান ফুটবলে গত সপ্তাহেও মাউরিসিও পচেত্তিনো, ইয়ুর্গেন ক্লপদের উদযাপন দেখেছেন নিশ্চয়ই। ঢাকার মাঠেও যে এমন দৃশ্য দেখা যাবে সেটা কে জানত! এমন ম্যাচের পর অবশ্য খুব বেশি অপ্রত্যাশিতও ছিল না লেমোসের উদযাপন। দ্বিতীয়ার্ধের দারুণ এক ফিরে আসায় ভারতের চেন্নাইন এফসিকে ৩-২ গোলে হারিয়েছে ঢাকা আবাহনী লিমিটেড।


     

    তাতে এএফসি কাপের গ্রুপ ই তে চেন্নাইনের সমান ৭ পয়েন্ট নিয়ে দুইয়ে উঠে গেছে লেমোসের দল। এই ম্যাচটা হেরে গেলে টুর্নামেন্ট থেকে বিদায়টাই নিশ্চিত হয়ে যেত, অঘোষিত ফাইনাল জিতে তাই পরের রাউন্ডে যাওয়ার আশা ভালোভাবেই টিকিয়ে রাখল আবাহনী। 

    ২-২ গোলে সমতায় থাকা ম্যাচে ৮৮ মিনিটে জয়সূচক গোলটি করেছেন মামুনুল ইসলাম। একাদশে ফিরেই সাবেক বাংলাদেশ অধিনায়ক করেছেন বাজিমাত। কর্নার থেকে চেন্নাইন বল ক্লিয়ার করেছিল, ডিবক্সের ডান কোণায় সেই বলটাই পেয়েছিলেন মামুনুল। এরপর ডান পায়ের শটে দুর্দান্ত এক গোল করে আবাহনীকে জয়ের স্বপ্ন দেখাতে থাকেন তিনি। ইনজুরি সময়ে গোলরক্ষক শহিদুল আলমও গণেশ ধানপালের হেড ঠেকিয়ে দিয়ে আর পথ হারাতে দেননি দলকে। দারুণ জয়ে তাই প্রথমবারের মতো দ্বিতীয় রাউন্ডে যাওয়ার স্বপ্ন দেখছে আবাহনী।

    ইনজুরির কারণে এমনিতেই শঙ্কা ছিল। আবাহনীর সেই শঙ্কাটা সত্যি প্রমাণ হতে সময় লেগেছিল মাত্র ৬ মিনিট। আইজ্যাক ভানমালসামির কর্নারটা নিয়েছিলেন ফারপোস্টে। সেখানে ফাঁকায় ছিলেন ভিনিথ। বল মাটিতে পড়ার আগেই শট করলেন তিনি, কিছু বুঝে ওঠার আগেই গোল খেয়ে বসলো আবাহনী।

    চার জনের নিয়মিত ব্যাকলাইনে আবাহনীর পরিবর্তন ছিল একটাই। সাদ উদ্দিন নেমেছিলেন রাইটব্যাক পজিশনে। আর রায়হান খেলেছেন সেন্টারব্যাক পজিশনে মাসিহ সাইঘানির সঙ্গে। মিডফিল্ডেও ছিল পরিবর্তন। সোহেল রানা, মামুনুল ইসলামরা সুযোগ পেয়েছিলেন একাদশে। কিন্তু সেই অভিজ্ঞতা শুরুতে কাজেই আসেনি আবাহনীর।

    গোল হজমের পর অবশ্য প্রথমার্ধ পুরোটাই নিয়ন্ত্রণ করেছে তারা। যদিও অ্যাটাকিং থার্ডে গিয়েই নিরাশ হয়ে ফিরতে হয়েছে ঘরের দলকে। ২০ মিনিটে গোলে প্রথম শটটা নিয়েছিলেন বেলফোর্ট। চেন্নাইন গোলরক্ষক কারানজিত সিং অবশ্য গড়বড় পাকিয়ে ফেলেছিলেন শটটা সেভ করতে গিয়ে, কিন্তু সেখান থেকে কর্নারের বেশি কিছু আর পাওয়া হয়নি আবাহনীর। কিছুক্ষণ পর ওয়ালি ফয়সালের ক্রস থেকেও ভাগ্য খুলতে পারত আবাহনীর। সানডে সিজোবা সে দফায় হতাশ করেছেন দূর্বল হেড করে। ওই হতাশাটা ভোলার সুযোগ পেয়েছিলেন সানডে। ৩৩ মিনিটে মিডফিল্ড থেকে দ্রুত ফ্রি কিক নিয়ে ওয়ান টু খেলে ডিবক্সের ভেতর ঢুকে পড়েছিলেন আবাহনী স্ট্রাইকার। পরে মাইনাস করার চেষ্টা করলেও প্রতিপক্ষ ডিফেন্ডারের গায়ে লেগে সিক্স ইয়ার্ড বক্সের ডান কোণায় বল পান সানডে। সামনে ছিলেন শুধু গোলরক্ষক কারানজিত। কিন্তু সানডে তখন মারলেন বারপোস্টেরও অনেক ওপর দিয়ে।

    একাদশে ফেরা সাদ উদ্দিনও বাজিমাত করতে পারতেন। বামপ্রান্ত থেকে ওয়ালি ফয়সালের দুর্বল ক্রসে দিকনিশানাহীন হেড করেছিলেন নাবিব নেওয়াজ জীবন। ফারপোস্টে এগিয়ে আসা সাদ উদ্দিনও হয়ত আশা করেননি বলটা পেয়ে যাবেন। তাই ভালো জায়গায় চলে আসা বলটা আর পেলেনও না ডিবক্সের ভেতর। আরও একবার আবাহনী হতাশ হলো। ভাগ্যের কাছে? নাকি চেষ্টার অভাবে?

    বিরতির পর বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামের লোডশেডিং আবাহনীর  সম্ভাব্য ভবিষ্যতটা ফোরশ্যাডো করে গেল আরেকবার। ঘুটঘুটে অন্ধকারে খেলা শুরু হতে দেরি হলো তিন মিনিট। খেলা শুরুর পর আইজ্যাক ডিবক্সের ঠিক বাইরে থেকে শট মারলেন, সেটা ক্রসবারে লেগে চলে গেল মাঠের বাইরে। হাপ ছেড়ে বাঁচল আবাহনীও। এরপর অবশ্য ঝকঝকে আলোতে ঝলকানি দেখাল আবাহনীই। ৬০ মিনিটে মিডফিল্ড থেকে পাওয়া থ্রু পাস ডিবক্সের ভেতর গিয়ে রিসিভ করেন জীবন। নিজেই শট নিতে পারতেন। বা অথবা ক্রস করতে পারতেন সানডেকে। পরেরটাই বেছে নিয়েছিলেন। কিন্তু অমন জায়গা থেকেও যে ক্রসটা জীবন করলেন, সেটাও মাথার ওপর দিয়ে গেল সানডের।

    অনেক হতাশার পর অবশেষে ৬৪ মিনিটে কপাল খোলে আবাহনীর। নিজের অর্ধ থেকে মাসিহ সাইঘানির লং বলটাই জাদুর মতো কাজে দিল। ডিবক্সের ভেতর বল রিসিভ করে ডিফেন্ডারের চ্যালেঞ্জ উপেক্ষা করে বেলফোর্ট  মারলেন নিজের দুর্বল ডান পায়েই। কোণাকুণি ফিনিশে গোল করে স্টেডিয়ামের শ'খানেক সমর্থকদের উদযাপনের মুহুর্ত এনে দেন বেলফোর্ট।    

    এরপর ম্যাচে এগিয়ে যেতেও আর সময় নেয়নি আবাহনী। ডিবক্সের ডান কোণায় ফ্রি কিক পেয়ে যায় ঘরের দল। সাইঘানির ফ্রি কিক নিতে আসাটাই ছিল চমক। কিন্তু আরও বড় চমক জমা রেখেছিলেন তিনি। সেখান থেকেই মারলেন দুর্দান্ত এক ফ্রি কিক, ক্রস বারে লেগে সেটা ঢুকে গেল চেন্নাইনের জালে।

    পিছিয়ে থাকা ম্যাচে এগিয়ে যেতে যেমন সময় লাগেনি, সাইঘানির ফ্রি কিকটাও মলিন হয়ে যেতে সময় নেয়নি। ৭০ মিনিটে ম্যাচের প্রথম বদলি করিয়েছিলেন চেন্নাইন কোচ। মাঠে নেমেই খানজেমবাম থই ডিবক্সের ভেতর ঢুকে পড়লেন বল নিয়ে।  গোলরক্ষক শহিদুল আলম, ডিফেন্ডার রাহহান দুইজনই প্রথমে বল ক্লিয়ার করতে পারতেন। কিন্তু ভুল করলেন। সেটাই কাল হলো আবাহনীর। জটলার পর বল পেয়ে আইজ্যাক এবার ফাঁকা বারে গোল দিয়ে আবাহনীর উৎসব দিলেন থামিয়ে। ৭১ মিনিটের ২-২ সমতা ম্যাচে।

    এরপর বেলফোর্টের একটি হেড চেন্নাইন গোলরক্ষক ঠেকিয়ে দিলে আবাহনীকে হতাশ হতে হয়েছিল আরেকবার। তবে  আবাহনীর হার না মানা মনোভাব শেষ পর্যন্ত কাজ করেছে টনিকের মতো। গ্রুপের অন্য ম্যাচে মানাং মার্সিয়াংদির সঙ্গে মিনার্ভা পাঞ্জাব ড্র করাতেও লাভ হয়েছে আবাহনীর। তাদের দ্বিতীয় রাউন্ডে যাওয়ার লড়াইটা তাই আপাতত চেন্নাইন এফসির সঙ্গেই। শেষ দুই ম্যাচে আবাহনীর প্রতিপক্ষ মানাং মার্সিয়াংদি ও মিনার্ভা পাঞ্জাব। প্রথম ম্যাচটি হোম, আর শেষটি ভারতের মাঠে।

    সেসব হিসাব নিকাশ মেলানোর আগে অবশ্য বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়াম পেল দারুণ এক মুহুর্ত। কোচ উদযাপন করে মাঠ ছেড়েছিলেন আগেই। খেলোয়াড়রা মাঠ ছাড়লেন আরও পরে। কোচের মতো তারাও সমর্থকদের কাছে গেলেন, দর্শক আর আবাহনী খেলোয়াড়দের উদযাপন মিলেমিশে তখন অদ্ভুত এক আবহ স্টেডিয়ামে। এমন দৃশ্য তো কালেভদ্রে দেখা যায় এই দেশে!