ওল্ড ট্রাফোর্ডে ইডেন (প্রায়) ফিরিয়ে এনেও আনতে পারলেন না ব্রাথওয়েট
ওল্ড ট্রাফোর্ড
নিউজিল্যান্ড ২৯১/৮, ৫০ ওভার (উইলিয়ামসন ১৪৮*, কটরেল ৪/৫৮)
ওয়েস্ট ইন্ডিজ ২৮৬ অল-আউট, ৪৯ ওভার
নিউজিল্যান্ড ৫ রানে জয়ী
এমন ম্যাচকে কীভাবে বর্ণনা করবেন আপনি? এমন ইনিংসকে এত অল্প কয়েক শব্দে কীভাবে ধারণ করবেন আপনি?
তিন বছর আগের ইডেন গার্ডেনসে তিনি মেতেছিলেন উল্লাসে। কমেন্ট্রিতে ইয়ান বিশপের ‘রিমেমবার দ্য নেম’ ঢুকে গেছে ক্রিকেটীয় লোকগাঁথায়। ম্যানচেস্টারের ওল্ড ট্রাফোর্ডে সেই দিনটা ফিরিয়ে এনেছিলেন তিনি। প্রায়। তবে শেষটা আর ইডেনের মতো হলো না এবার, আটকে গেল ওই প্রায় শব্দটায়। উলটো তাকেই পেতে হলো সান্ত্বনা। একপাশে উল্লাসে মত্ত নিউজিল্যান্ডের পাশে নুয়ে পড়লেন কার্লোস ব্রাথওয়েট! যে ম্যাচটা অসম্ভবের হাত থেকে প্রায় ছিনিয়ে এনেছিলেন তিনি, সেটাতেই শেষটা করতে পারলেন না। আরেকটি থ্রিলারে নিউজিল্যান্ড পার হলো মাত্র ৫ রানের ব্যবধানে!
যখন সব আশা শেষ হয়ে গিয়েছিল প্রায়, তখনই নিজের প্রথম আন্তর্জাতিক সেঞ্চুরিটা করার উপলক্ষ্য বেছে নিলেন ব্রাথওয়েট। ৫ ওভার বাকি থাকতে পড়লো ওয়েস্ট ইন্ডিজের নবম উইকেট, তখনও জয় থেকে তারা ৪৭ রান দূরে। ৪৬তম ওভারে ট্রেন্ট বোল্টের কাছ থেকে নিতে পারলেন ৭ রান। বোল্টের ওভার শেষ তখন। এলেন ফার্গুসন। সে ওভারেও ৭। ফার্গুসনের ওভারও শেষ। এলেন ম্যাট হেনরি। ব্রাথওয়েট ফিরে গেলেন তিন বছর আগে ইডেনের সেই দিনে, ওয়ার্ল্ড টি-টোয়েন্টির সেই ফাইনালে। প্রথম বলে ডাবলস, এরপর টানা তিন ছয়। ছয়গুলো মনে করিয়ে দিল সেই দিনটা, যেন হেনরির ওপর এসে ভর করেছেন বেন স্টোকস। ৫ম বলে চার, শেষ বলে সিঙ্গেল নিয়ে স্ট্রাইক রাখলেন নিজের কাছে।
যে ম্যাচটা নিউজিল্যান্ড প্রায় জিতে গিয়েছিল, সেটা প্রায় ছিনিয়ে আনলেন। এলেন জিমি নিশাম। প্রথম চার বলে দুই, যেটিতে পূর্ণ হলো তার সেঞ্চুরি। পঞ্চম বল ডট। ব্রাথওয়েটের সামনে তখন দুইটি অপশন-- সিঙ্গেল নিয়ে স্ট্রাইক রাখা, অথবা পুরো ইনিংসের মতো অতিমানবীয় কোনো স্ট্রোকে গৌরবের দিকে এগিয়ে যাওয়া। ব্রাথওয়েট বেছে নিলেন দ্বিতীয়টি। সেটাও প্রায় পার হয়ে গিয়েছিলেন, তবে সীমানার ইঞ্চি ব্যবধানে বলটা ছোঁ মেরে হাতে পুরলেন ট্রেন্ট বোল্ট! উল্লাসে মাতলো নিউজিল্যান্ড। একপাশে নুয়ে পড়লেন ব্রাথওয়েট!
ক্রিকেট? নাকি জীবন!/এএফপি
ওল্ড ট্রাফোর্ডের ম্যাচের দ্বিতীয় ইনিংসের গল্পটা কয়েক ধাপে বদলেছে। শেই হোপ ও নিকোলাস পুরান শুরুতেই ফেরার পর চাপে পড়া ওয়েস্ট ইন্ডিজ এগিয়ে গিয়েছিল ক্রিস গেইল ও শিমরন হেটমায়ারের ফোরজি স্টাইলের ব্যাটিংয়ে। সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল নিউজিল্যান্ডের পিচ্ছিল ফিল্ডিং। এক গেইলকেই মিচেল স্যান্টনারের এক ওভারে দুইবার জীবন দিয়েছিলেন হেনরি ও কলিন মানরো। তবুও গেইল সেঞ্চুরি পর্যন্ত যেতে পারলেন না, ডি গ্র্যান্ডহোমকে তুলে মারতে গিয়ে লং-অনে ধরা পড়লেন ৮৪ বলে ৮৭ রান করে। তার আগেই ওয়েস্ট ইন্ডিজের ইনিংসে শুরু হয়েছে নাটকীয় ধস।
যে ধসের মূলে ছিল লকি ফার্গুসনের এক ওভার। প্রথমে পেস কমিয়ে আনলেন নাটকীয়ভাবে-- পুরো ইনিংসেই যেটা করেছেন তিনি। তাতেই কুপোকাত টানা দ্বিতীয় ফিফটি করা হেটমায়ার, ক্রসব্যাটে খেলতে গিয়ে হলেন বোল্ড। ঠিক পরের বলেই কট-বিহাইন্ড জেসন হোল্ডার! ফার্গুসনের পর বোল্টের আরেক ওভারে আরেকদফা পিছিয়ে গেল ওয়েস্ট ইন্ডিজ। এবার অ্যাশলি নার্স শর্ট বলে কট-বিহাইন্ড। প্রথম ইনিংসে চোট পেয়ে উঠে যাওয়া লুইস অবশেষে এলেন সাতে, তবে ৩ বল খেলেও রানের খাতা খোলা হলো না তার।
২২ ওভারে ২ উইকেটে ১৪২ রানে থাকা ওয়েস্ট ইন্ডিজ ২৭তম ওভারের আগেই বনে গেল ৭ উইকেটে ১৬৪ রানে! গেইল-হেটমায়ারের ব্যাটিংয়ের সময় মনে হচ্ছিল, ম্যাচ দ্রুত শেষ করার তাড়া আছে তাদের। কেমার রোচ ও শেলডন কটরেলকে নিয়ে ব্রাথওয়েট এরপর লড়াই করলেন আরও ৮১ রান তুলে। রোচ হেনরির বলে উইকেটের পেছনে ক্যাচ দিলেন, স্টাম্প হারালেন কটরেল। এরপর শেষ ব্যাটসম্যান ওশ্যান থমাস। ৪১ রানের জুটিতে যার অবদান-- তিনি খেলেছেন ৪ বল, মানে তিনি টিকে ছিলেন ৪ বল।
এরপরই ব্রাথওয়েটের অতিমানব হয়ে ওঠা। প্রায়।
টানা দ্বিতীয় সেঞ্চুরি করেছেন নিউজিল্যান্ড অধিনায়ক কেন উইলিয়ামসন/আইসিসি
এর আগে প্রথম ইনিংসে গল্প ছিল দুজনের। একদিকে শেলডন কটরেলের সেই স্যালুট। অন্যদিকে ধীরস্থির কেন উইলিয়ামসন। ওল্ড ট্রাফোর্ডে নিউজিল্যান্ড-ওয়েস্ট ইন্ডিজের ‘ক্ল্যাসিক’ ওয়ানডে ইনিংসের চিত্রের প্রায় পুরোটা জুড়েই ছিলেন এ দুজন। উইলিয়ামসন করেছেন টানা দ্বিতীয় সেঞ্চুরি, শেষ পর্যন্ত আউট হয়েছেন ওই কটরেলের বলেই, পাননি ড্যাডি সেঞ্চুরিটা। কটরেল নিয়েছেন ৪ উইকেট, সঙ্গে একটি রান-আউট আর তিনটি ক্যাচ। ক্ল্যাসিক ওয়ানডের নিয়ম মেনেই নিউজিল্যান্ড ৩০ ওভার শেষে ১৪৪ রানের স্কোরটা প্রায় দ্বিগুণ করে তুলেছে ২৯১ রান।
উইলিয়ামসনের সেঞ্চুরির সঙ্গে ফিফটি করেছেন টেইলর, তবে বাকিরা শুধু সমর্থনই দিয়ে গেছেন। ওয়েস্ট ইন্ডিজের বোলিংয়ের চিত্রটাও মোটামুটি একই- কটরেল উইকেট নিয়েছেন, রোচ করেছেন ইকোনমিক্যাল বোলিং, তবে বাকিরা ছিলেন মোটামুটি খরুচে। শেষদিকে নিউজিল্যান্ডের ক্যামিও বলতে ছিল নিশামের ২৩ বলে ২৮ রানের ইনিংসই।
উইলিয়ামসন আরেকবার প্রমাণ করেছেন, সময়ের অন্যতম সেরা ব্যাটসম্যান কেন তিনি। ওয়ানডে যখন দ্রুতগতিতে এগিয়ে যাচ্ছে, তিনি তার ইনিংস গড়ছেন সেই পুরোনো ধাঁচেই। অপেক্ষা করে থাকো, সিঙ্গেল নিতে থাকো, সুযোগ পেলে বাউন্ডারি মারো। ১৪টি চারের সঙ্গে মেরেছেন একটি ছয়, সেটিও এসেছে একেবারে শেষধাপে গিয়ে, যখন ইনিংসের গতি বদলানোর কাজটাও করতে হচ্ছিল তাকেই!
কটরেল, স্যালুটের পর! /আইসিসি
টসে জিতে ফিল্ডিং নেওয়ার সার্থকতা প্রথম ওভারেই জেসন হোল্ডারকে এনে দিয়েছিলেন কটরেল। প্রথম বলেই ইনসুইঙ্গিং ইয়র্কারের জবাব দিতে পারেননি মার্টিন গাপটিল, ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে নিউজিল্যান্ডের শেষ বিশ্বকাপ ম্যাচে যার ছিল ডাবল সেঞ্চুরি। অবশ্য উইকেটটা ওয়েস্ট ইন্ডিজ পেয়েছে রিভিউ নিয়ে, বল ভাঙছিলই গাপটিলের লেগস্টাম্প। কলিন মানরোর উইকেটে অবশ্য রিভিউয়ের দরকার পড়েনি, কটরেলের সে ওভারেই আরেকটি ইয়র্কারে স্টাম্প হারিয়েছেন তিনি।
এরপর প্রায় ৩৪ ওভার উইকেটের দেখা পায়নি ওয়েস্ট ইন্ডিজ। রস টেইলরের সঙ্গে কেন উইলিয়ামসন গড়েছেন আরেকটি ১৫০-পেরুনো জুটি। ধীরগতিতে এগিয়েছেন দুজন, একদিক থেকে স্পিনার অ্যাশলি নার্স ও কার্লোস ব্রাথওয়েট, অন্যদিক থেকে তিন পেসারকে দিয়ে করিয়েও উইকেটের দেখা পায়নি ওয়েস্ট ইন্ডিজ। সেই ব্রেকথ্রুটা তাদের এনে দিয়েছেন ক্রিস গেইল। ৬৮ বলে ৭ চারে ফিফটি করেছিলেন টেইলর, সেই তিনি ডাউন দ্য গ্রাউন্ডে এসে তুলে মারতে গিয়ে মিড-অফে ধরা পড়েছেন হোল্ডারের হাতে।
টম ল্যাথাম ও জিমি নিশামের সঙ্গে এরপর যথাক্রমে ৪৪ বলে ৪৩ ও ২৮ বলে ৪১ রানের জুটি ছিল উইলিয়ামসনের। পরের দ্রুতগতির জুটিতেও গিয়ার বদলেছেন উইলিয়ামসনই। শেষ পর্যন্ত কটরেলকে তুলে মারতে গিয়েই উইকেটকিপার শেই হোপের হাতে ক্যাচ দিয়েছেন, ১৫৪ বলে ১৪৮ রান করে। এর আগে ফিরেছেন ল্যাথাম, টপ-এজড হয়ে ক্যাচ দিয়েছিলেন বোলার কটরেলের হাতেই। শেষ ওভারে রান-আউট করেছেন কলিন ডি গ্র্যান্ডহোমকে, পাঁচ উইকেট অবশ্য পাওয়া হয়নি তার।
হোল্ডার নিজের বদলে ভরসা রেখেছিলেন ব্রাথওয়েটের ওপর, শেষ দুই বলে দুই উইকেট নেওয়ার আগে তিনি গুণেছেন ৫৮ রান, মোট ৬ ওভারে।
সেসব পুষিয়ে দিয়েছিলেন ব্রাথওয়েট। ওল্ড ট্রাফোর্ডে ফিরিয়ে এনেছিলেন ইডেন গার্ডেনস। প্রায়। কিন্তু মাঝে মাঝে এই প্রায় শব্দটাই হয়ে ওঠে পার্থক্য।