নাটকীয় জয়ে এএফসি কাপে আবাহনীর ইতিহাস
গৌহাটির ইন্দিরাগান্ধী স্টেডিয়ামে এক পাশে হেলে পড়া সূর্যের মতো মাঠেও নিভে যেতে বসেছে আবাহনীর স্বপ্ন। ৫ মিনিট ইনজুরি সময়ের তৃতীয় মিনিটে নাবিব নেওয়াজ জীবন যখন কর্নার নিতে যাচ্ছেন, তখনও চেন্নাইন এফসিই আবাহনীকে টপকে উঠে যাচ্ছিল এএফসি কাপের নক আউট পর্বে। জীবন কর্নারটা নিলেন ফারপোস্টে ক্রেভেন্স বেলফোর্ট সেখান থেকে হড করে বল ফেললেন গোলের সামনে। আবাহনীর আফগান ডিফেন্ডার মাসিহ সাইঘানি করলেন আরেক হেড, গোল! মিনার্ভা পাঞ্জাবকে ৯৩ মিনিটের ওই গোলে হারিয়েই প্রথমবারের মতো এএফসি কাপের নক আউট পর্বে উঠে গেছে আবাহনী।
সাইঘানির গোলে প্রথম ম্যাচে জয় পেয়েছিল আবাহনী, চেন্নাইনের বিপক্ষে তার গোলে ফিরেছিল সমতায়। এরপর গ্রুপের চতুর্থ ম্যাচে চেন্নাইনকে হারিয়েই স্বপ্ন বাঁচিয়ে রেখেছিল আবাহনী। সেই সাইঘানিই আরও একবার হয়ে গেলেন আবাহনীর ত্রাতা। ইন্টার জোনাল সেমিফাইনালের প্লে-অফে আবাহনীর প্রতিপক্ষ অবশ্য ঠিক হয়নি এখনও।
শেষ ম্যাচের আগে আবাহনীর সমীকরণ ছিল চেন্নাইন এফসির ম্যাচের ফল অনুরূপ কিছু পাওয়া। দুই দলের পয়েন্ট সমান হয়ে গেলে হেড টু হেড অ্যাওয়ে গোলে এগিয়ে থাকায় চেন্নাইন এফসি চলে যেত পরের রাউন্ডে। মানাং মার্সিয়াংদির বিপক্ষে ৩-২ গোলে জয় পেলেও শেষ পর্যন্ত সেটা যথেষ্ট হয়নি চেন্নাইনের। ১১ পয়েন্ট নিয়ে তারা হয়েছে দ্বিতীয়, আর ৫ ম্যাচে ৪ জয় এক ড্র ও এক হারে ১৩ পয়েন্ট নিয়ে ই গ্রুপের একমাত্র দল হিসেবে প্লে অফ নিশ্চিত হয়েছে আবাহানীর।
গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচে আবাহনী কোচ থমাস লেমোসের হাতে ছিল না স্ট্রাইকার সানডে চিজোবা। ভিসা জটিলতায় ভারতেই যাওয়া হয়নি তার দলের সঙ্গে। একটাই পরিবর্তন ছিল একাদশে। ফয়সাল এসেছিলেন, আর সাদউদ্দিন এদিন খেলেছেন স্ট্রাইকারের ঠিক পেছনে। শুরুটাও একেবারে মন্দ ছিল না আবাহনীর। প্রথমার্ধে বেশ কয়েকটি সুযোগ তৈরি করেছিল তারা। এর মধ্যে একবার বেলফোর্ট ডিবক্সের ভেতর ভালো জায়গায় বল পেয়েও শট নিতে গিয়ে পায়ে লাগাতে পারেননি। আরেকবার তার থ্রু পাস ধরে এগিয়ে গিয়েছলেন জীবন, তিনিও প্রথম সুযোগে শট নিতে না পারায় ভালো একটা আক্রমণ থেকে খালি হাতে ফেরে আবাহনী। প্রথমার্ধে পাঞ্জাবের আক্রমণ তেমন একটা ভোগাতে পারেনি, সাইঘানি-বাদশাদের। আবাহনীই ছিল বেশি উজ্জ্বল। প্রথমার্ধে আবাহনীর অন টার্গেটে শট ছিল দুইটি। সোহেল রানা আর জীবনের শট দুইটি ঠেকাতে অবশ্য পাঞ্জাব গোলরক্ষককে বেগ পেতে হয়নি একবারেই। তবে তিনি হাপ ছেড়ে বেঁচেছেন ৩৮ মিনিটে। ডিবক্সের বাইরে থেকে মামুনুল ইসলামের বাম পায়ে নেওয়া দুর্দান্ত এক শট অল্পের জন্য গেছে বারপোস্টের ওপর দিয়ে।
গোলশূন্য প্রথমার্ধ শেষেও তাই আশার আলো দেখছিল আবাহনী। আর একই সময়ে শুরু হওয়া আরেক ম্যাচে চেন্নাইন এফসির গোলশূন্য থাকার খবরও তখন স্বস্তি যোগাচ্ছিল লেমোসের দলকে। কিন্তু দ্বিতীয়ার্ধে আবাহনী যখন রঙ হারালো তখন ভাগ্যও যেন মুখ ফিরিয়ে নিল। ৫৪ মিনিটে সিক্স ইয়ার্ড বক্সের মাথায় থাকা জুয়েল রানা দারুণ এক সুযোগ হাতছাড়া করলেন গোল করার। আর ঠিক তখনই অন্য ম্যাচে এগিয়ে গেল চেন্নাইন। ৬৬ মিনিটে আরেকবার গোল করে চেন্নাইন ব্যবধান বাড়িয়ে করল ২-০। ততোক্ষণে আবাহনী জেনে গেছে, জয় ছাড়া আর পথ নেই তাদের।
কিন্তু ৭১ আর ৭৯ মিনিটে দুই গোল দিয়ে মানাং প্রায় অসম্ভব কাজটাই করে ফেলেছিল। ২-২ গোলে সমতা তখন নেপালে। তাই গোলশূন্য থাকলেও তখন আবাহনীই যেত পরের রাউন্ডে। কিন্তু ভয়টা চড়িয়ে দিল তখন পাঞ্জাব। ৮০ মিনিটে কর্নার ক্লিয়ার করতে পারেনি আবাহানী ডিফেন্ডাররা। ডিবক্সের বাইরে থেকে শট করেই আবাহনীর বারপোস্ট কাঁপিয়ে দিল তারা। এরপর ৮৪ মিনিটে আবাহনী গোলরক্ষক শহীদুল আলম সোহেল করলেন অমালাজাকে ঠেকিয়ে দিলে করলেন দুর্দান্ত এক সেভ। দুই মিনিট পর যেন নিজেকেই ছাড়িয়ে গেলেন আবাহনী অধিনায়ক। পয়েন্ট ব্ল্যাংক রেঞ্জ থেকে মইনুদ্দিন খানের নিশ্চিত গোল হতে যাওয়া শট নেয়ার পোস্টে ঠেকিয়ে দিয়ে দলকে ম্যাচে টিকিয়ে রাখলেন আবাহনী অধিনায়ক।
কিন্তু এএফসি কাপে তো আবাহনীর এবারের যাত্রাটা রোমাঞ্চ আর নাটকীয়তায় ভরপুর। শেষ ম্যাচ বাদ যাবে কেন? ৮৮ মিনিটে আরেকবার গোল দিয়ে তখন এগিয়ে গেছে চেন্নাইন এফসি। আর শেষদিকে চাপে পড়ে যাওয়া আবাহনীর গোল পাওয়ার সম্ভাবনা প্রায় মিলিয়ে গিয়েছিল তখন গুয়াহাটির মাঠে। কিন্তু হারার আগে হেরে না যাওয়াও লেমোসের আবাহনীর অভ্যাস হয়ে দাঁড়িয়েছে এবার। নাটকের শেষ অঙ্কে তাই আবাহনীই নায়ক। ম্যাচশেষে প্রায় অন্ধকার নেমে আসা গুয়াহাটিতেও তাই আশার রেখা দেখেছে আবাহনী। ম্যাচশেষে আবাহনীর খেলোয়াড়দের উন্মত্ত উদযাপনটাও তাই আরও একবার স্বপ্ন দেখাতেই প্রেরণা যোগাবে দেশের ফুটবলকে।