বাংলাদেশের আশার প্রদীপ প্রায় নিভিয়ে হেরে গেল ভারত
ইংল্যান্ড ৫০ ওভারে ৩৩৭/৭ (বেইরস্টো ১১১, স্টোকস ৭৯, রয় ৬৬; শামি ৫/৬৯, বুমরা ১/৪৪)
ভারত ৫০ ওভারে ৩০৬/৫ (রোহিত ১০২, কোহলি ৬৬, পান্ডিয়া ৪৫; প্লাংকেট ৩/৫৫, ওকস ২/৫৮)
ফলঃ ইংল্যান্ড ৩১ রানে জয়ী
বিরাট কোহলি আর রোহিত শর্মা চেষ্টা করেছিলেন অনেকক্ষণ। পারেননি। ঋশভ পান্ট করেছিলেন একটু, আর হার্দিক পান্ডিয়া্র ওপর আশা টিকে ছিল অনেকটা। পারেননি দুজনের কেউ। মহেন্দ্র সিং ধোনি অবশ্য চেষ্টাও করেননি। কিছুতেই তাই কিছু হলো না। বাংলাদেশের আশার ফানুস প্রায় ফুটিয়ে দিয়ে ভারতকে হারিয়ে দিল ইংল্যান্ড। আশা কমে গেল পাকিস্তানেরও, আর বিশ্বকাপ থেকে বিদায় নিয়ে নিল শ্রীলংকা। সেমির টিমটিমে প্রদীপ জ্বালিয়ে রাখতে শেষ দুই ম্যাচে জয়ের তাই বিকল্প নেই বাংলাদেশের; ভারতের সঙ্গে হারাতে হবে পাকিস্তানকেও।
শেষদিকে যখন ওভারপ্রতি ১০-১১ রান করে লাগে, ভারতকে ম্যাচে রেখেছিলেন পান্ডিয়া। ৩৩ বলে ৪৫ রান করে পান্ডিয়ার আউটের পর ম্যাচটা প্রায় অসম্ভবই হয়ে গিয়েছিল ভারতের জন্য। তবে আরও আশ্চর্যজনকভাবে ধোনি আর যাদব তেমন কোনো চেষ্টাও করলেন না জেতার। শেষ ৫ ওভারে মাত্র তিনটি চার ও একটি ছয় মেরেছে, যখন দরকার ছিল আরও বড় কিছুর। ৪৭ ওভার শেষে ম্যাচের ফলও একরকম জানা হয়ে গেছে।
কাজটা অবশ্য সহজ ছিল না। জিততে হলে রেকর্ড গড়তে হতো ভারতকে। সেটার পথে ভারতের শুরুটা হয়েছিল দুঃস্বপ্নের মতো। লোকেশ রাহুল প্রথম ৮ বলে কোনো রান নিতে পারলেন না রোহিত। ক্রিস ওকসের করা ইনিংসের তৃতীয় বলটা ছিল আরেকটু মন্থর গতির, সেটি লেগ সাইডে খেলতে গিয়ে রাহুলের হলো লিডিং এজ। শুন্য রানে রাহুল ফিরলেন, ভারত হারাল প্রথম উইকেট। রোহিত শর্মার ক্যাচ যদি ধরতে পারতেন রুট, ওই ওভারেই আরেকটি উইকেট হারাতে পারত ভারত।
বিরাট কোহলি আর রোহিত শর্মাকে একদমই খেলতে দিচ্ছিলেন না ওকস-আর্চার। প্রথম ১০ ওভারে মাত্র ২৮ রান যোগ করলেন দুজন , এই বিশ্বকাপে পাওয়ারপ্লেতে যা সর্বনিম্ন। মার্ক উড আসার পর একটু হাত খেলতে শুরু করলেন কোহলি। তবে রান রেট তখনই উঠে গিয়েছিল সাতের ওপর, খানিক পর যেটা হয়ে গেল আট।
তারপরও রোহিত আর কোহলির চাকাটা ঘুরছিল না ঠিকঠাক। ১০০ রান এলো ২২ ওভারে গিয়ে, কোহলির ফিফটিও হয়ে গেল। রোহিত অবশ্য তখনও যেন নিবিষ্ট দর্শকের মতো পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছেন। আদিল রশিদের ওভারে ঠিক করলেন, কিছু একটা দরকার। দুই চার মারলেন, খুব দ্রুতই পৌঁছে গেলেন ফিফটিতে।
তবে নিজের জাতটা চিনিয়েছেন আরও কয়েক ওভার পর। স্টোকসের বলে পর পর তিনটি চার মারলেন, তিনটিই জায়গা পেয়ে যাবে যে কোনো ক্রিকেট কোচিং ক্লাসে। প্রতি ওভারেই এক দুইটি চার আসছিল, রান রেট আট থেকে তাই বাড়ছিল না আর। কোহলিও যখন মনে হচ্ছে টুর্নামেন্টের প্রথম সেঞ্চুরি পেয়ে যাবেন, প্লাংকেটের অফ স্টাম্পের বাইরের বলে ক্যাচ তুলে দিলেন পয়েন্টে। এজবাস্টনের গ্যালারি স্তব্ধ, ইংল্যান্ড পেল লাইফলাইন।
পান্ট এলেন চারে, প্রথম তিন বলের মধ্যে দুই বার রান আউট হতে হতেও বেঁচে গেছেন। ওদিকে রোহিত খেলে যাচ্ছেন তার মতোই। ৬৫ বলে ফিফটির পর ১০০ করতে খেললেন ১০৬ বল, যার মানে দ্বিতীয় ফিফটি পেলেন ৪১ বলে। শেষ পর্যন্ত ওকস এসেই ফেরালেন রোহিতকে। এরপর পান্ট ৩২ রান করে ওকসের দুর্দান্ত ক্যাচে আউট হয়ে গেলেন। রান রেট বাড়তে শুরু করেছিল, তবে পান্ডিয়া ছিলেন বলেই সম্ভব মনে হচ্ছিল। সেটা আর হলো না।
তার আগে ইংল্যান্ডের জয়ের ভিত গড়ে দিয়েছিলেন দুই ওপেনারই। জেসন রয় ও জনি বেইরস্টো শুরুতে একটু নার্ভাসই ছিলেন। প্রথম ১০ ওভারে এসেছিল ৪৭ রান, দুজনের মানদন্ডে কমই। কিন্তু চাহাল-পান্ডিয়া আসার পর দুজন খুঁজে নিলেন নিজেদের জোন। ১৫.৩ ওভারে উঠল ১০০ রান, পরের ৫০ রান এলো পাঁচ ওভারেরও কমে। কুলদীপ-চাহাল-পান্ডিয়াদের একের পর এক মাঠের ওপারে আছড়ে ফেলছিলেন। যেভাবে খেলছিলেন, তাতে দুজনকে ফেরানোর জন্য অসাধারণ কিছুর দরকার ছিল। সেটা এমন একজনের কাছ থেকে এলো, এই ম্যাচে যিনি একাদশেই ছিলেন না। ক্যাচ ধরতে গিয়ে চোট পেয়ে লোকেশ রাহুল উঠে গিয়েছিলেন মাঠ থেকে বদলি হিসেবে নেমেছিলেন রবীন্দ্র জাদেজা। কুলদীপের বলটা টাইমিংও করেছিলেন জেসন রয় ঠিকঠাক, লং অন বরাবর চার হয়ে যাবেই মনে হচ্ছিল। কিন্তু কোত্থেকে চিলের মতো উড়ে মাটিতে পড়ার ঠিক আগে ছোঁ মেরে বল লুফে নিলেন জাদেজা। ৫৭ বলে ৬৬ রান করে আউট রয়।
বেইরস্টো সেঞ্চুরি করার পরেই একটু স্লথ হয়ে গিয়েছিলেন, ১৯ বলে করেছিলেন ১১ রান। মোহাম্মদ শামি আক্রমণে এলেন, অফ স্টাম্পের বাইরে বলটা একটু স্লোই ছিল। বেইরস্টো কাট করতে গিয়ে ডিপ পয়েন্টে ক্যাচ দিলেন পান্টকে।
মরগান এলেন, প্রথম ৮ বলে নিতে পারলেন ১ রান। আগের ম্যাচে স্টার্কের বাউন্সারে ক্যাচ মরগানের ক্যাচ দেওয়াটা নিশ্চয় মনে ছিল শামির। আরও একটা বাউন্সার দিলেন, পুল করতে গিয়ে সেই ডিপ ফাইন লেগেই ক্যাচ দিলেন। ২০৭ রানের মধ্যে ৩ উইকেট হারাল ইংল্যান্ড, দারুণভাবে ম্যাচে ফিরল ভারত। ৩০ ওভারের পর থেকেই আসলে খোলসে ঢুকে গিয়েছিল ইংল্যান্ড, পরের ৭ ওভারে রান উঠল মাত্র ১৪। মোট ১০ ওভার ধরে কোনো বাউন্ডারি পায়নি ভারত। শেষ পর্যন্ত চাহালকে চার মেরে স্টোকস শেকলটা ভাঙলেন।
শামি তখন একদিক দিয়ে দুর্দান্ত বল করা শুরু করেছেন, এমনকি চাহাল-কুলদীপও যেন একটু নিয়ন্ত্রণ ফিরে পেয়েছেন নিজেদের ওপর। যে কুলদীপ প্রথম ৪ ওভারে ৪৬ রান দিয়েছিলেন, পরের ৪ ওভারে তিনি দিলেন ২৬ রান। মরগান ও স্টোকস একটু সময় নিলেন থিতু হতে। গা ঝাড়া দিয়ে উঠলেন চাহালের ওভারে। সুইচ হিট করে ছয় মারলেন স্টোকস, পরের ওভারে মারলেন আবারও। ১০ ওভারে ৮৮ রান দিয়ে শেষ করলেন চাহাল, ওয়ানডে ক্যারিয়ারে কখনো এর চেয়ে বেশি রান দেননি। ৪০ ওভার শেষে ২৪৫ রান তুলল ইংল্যান্ড।
এরপরের ১০ ওভারের গল্পটা স্টোকস আর বুমরার। একদিকে টানা বল করে গেছেন বুমরা, তার ওভারে রান নিতে হিমশিম খেয়েছে ইংল্যান্ড। আর অন্যদিকে চাহাল, পান্ডিয়া আর শামিদের শাসন করে গেছেন স্টোকস। রুট রান নিতে একটু সংগ্রাম করছিলেন, ৫৪ বলে ৪৪ রান করে ৪৫তম ওভারে গিয়ে আউট হয়ে গেলেন শামির বলে। ক্রিজে এলেন ওই মুহূর্তে সবচেয়ে বিপজ্জনকদের একজন জস বাটলার। শামির এক ওভারে চার-ছয় মারলেন, শেষ পর্যন্ত পুল করতে গিয়ে শামিকেই ক্যাচ তুলে দিলেন ৮ বলে ২০ রান করে। স্টোকস ৩৮ বলে এর মধ্যেই পেয়ে গেছেন ফিফটি, তার ব্যাটেই এগিয়ে চলছিল ইংল্যান্ড। পরে ওকসকেও ফেরালেন শামি, তার আগে আফ্রিদির পর বিশ্বকাপে মাত্র দ্বিতীয় বোলার হিসেবে পেয়ে গেছেন টানা চার ম্যাচে অন্তত তিন উইকেট।
তবে স্টোকস ছিলেন বলেই ইংল্যান্ড ৩৪০ এর স্বপ্ন দেখছিল। শেষ পর্যন্ত শেষ ওভারে বুমরাকেই দিয়ে এলেন উইকেট, তার আগে করেছেন ৫৪ বলে ৭৯। বুমরার ৫ ওভারে ৫৬ রান তোলার পরও শেষ ১০ ওভারে ইংল্যান্ড করেছে ৯২। সেটা এনে দিয়েছে ৩৩৮, দিন শেষে জয়ের জন্য যা হয়ে গেছে যথেষ্ট।