অলৌকিক এক ম্যাচে ইংল্যান্ডকে চ্যাম্পিয়ন বানিয়ে জিতে গেল ক্রিকেট
ফাইনাল, লর্ডস
নিউজিল্যান্ড ২৪১/৮, ৫০ ওভার
ইংল্যান্ড ২৪১ অল-আউট ৫০ ওভার
ইংল্যান্ড সুপার ওভারে জয়ী (সুপার ওভারে ইংল্যান্ড ১৫, নিউজিল্যান্ড ১৫; ইংল্যান্ড জয়ী বাউন্ডারি সংখ্যায়)
এটি যেন এ জগতের কোনও ম্যাচ নয়। এ ম্যাচ অলৌকিক। এ ম্যাচ এক জীবনের। অইন মরগানের। কেন উইলিয়ামসনের। বেন স্টোকসের। জিমি নিশামের। মার্টিন গাপটিলের। জস বাটলারের। ইংল্যান্ডের। নিউজিল্যান্ডের। লর্ডসের। আপনার। আমার। সবার। যারা ক্রিকেট দেখেন, তাদের। যারা দেখেন না, তাদেরও।
এরকম কিছু কখনও দেখেনি ক্রিকেট। যদি বলা হয়, লর্ডসে এদিন ক্রিকেট পূর্ণতা পেলো, তাহলে অত্যুক্তি হবে না বোধহয়। যদি বলা হয়, এদিন পূর্ণতা পেলো আপনার আমার জীবন, হয়তো আপনি আপত্তি করবেন না। আজকের এই ক্ষ্যাপাটে অথচ অনিন্দ্যসুন্দর দিনে সেই ঝুঁকিটা নেওয়া যায়। যেদিন ১০০ ওভারের ক্রিকেট দুই দলকে আলাদা করতে পারলো না, যেদিন সুপার ওভার দুই দলকে আলাদা করতে পারলো না। নিতে হলো সর্বোচ্চ বাউন্ডারি সংখ্যার সহায়তা। আর তাতে ঠিক হলো বিশ্বচ্যাম্পিয়ন। এটুকু বললেও আদতে কিছুই বলা হয় না এদিন। এদিন আদতে ইংল্যান্ডকে চ্যাম্পিয়ন করে দিয়ে জিতে গেল ক্রিকেট।
সুপার ওভারে নিউজিল্যান্ডের প্রয়োজন ছিল ১৬ রান, ১৫ যথেষ্ট হতো না তাদের। জফরা আর্চার, বিশ্বকাপের ঠিক আগে যার অভিষেক হয়েছে, যিনি এই ওয়ানডে ক্যারিয়ারে কখনও ১৬ রান দেননি এক ওভারে, তার কাঁধে পড়লো দায়িত্ব। প্রথম বল লাইন ধরে করতে গিয়ে করে ফেললেন ওয়াইড, পরের বলে ব্লকহোল, তবে এলো ডাবলস। ক্রিজের অনেক গভীরে গিয়ে ব্যাটিং করা নিশাম এরপরের বলটা পড়ে ফেললেন আগেভাগে, মিডউইকেট দিয়ে ছয়। এরপরের দুই বলে ডাবলস, তবে প্রথমটি এলো জেসন রয়ের মিসফিল্ডে, পরেরটির থ্রো নন-স্ট্রাইক প্রান্তে হলে হতে পারতো অন্য কিছু। আর্চার ঠিক লেংথটা খুঁজে পেলেন পঞ্চম বলে, নিশাম সেটিতে সিঙ্গেলের বেশি নিতে পারলেন না। শেষ বলে প্রয়োজন ২। এক হলে সুপার ওভার হবে টাই, তবে মূল ম্যাচে বাউন্ডারি সংখ্যায় জিতে যাবে ইংল্যান্ড।
আর্চার, ইংল্যান্ডের নতুন গতিতারকা, যার টুইট যেন বলে দিতে পারে সবকিছু। তবে আজকের দিনের নাটক হয়তো বলতে পারতো না তার পাগলাটে টুইটারের টাইমলাইন। তার সামনে গাপটিল, পুরো টুর্নামেন্টে যিনি হারিয়ে খুঁজেছেন নিজেকে। ব্লকহোলের বলটা মিডউইকেটের দিকে ঠেললেন তিনি, যেখানে ছিলেন রয়, একটু আগে যিনি মিসফিল্ড করেছিলেন। এবার থ্রো গেল বাটলারের কাছে, বলটা ধরে ঝুঁকে পড়ে যিনি ভাঙলেন স্টাম্প। গাপটিল তখন ক্রিজের একটু বাইরে। ওই ব্যবধানেই নিউজিল্যান্ড হয়ে গেল রানার্স-আপ।
এর আগে সুপার ওভারের প্রথমে স্টোকস আর বাটলারকে পাঠিয়েছিল ইংল্যান্ড। ট্রেন্ট বোল্ট বোলিংয়ে, যার শেষ ওভারে ১৫ রান তুলতে পারলে জিতে যেতে পারতো ইংল্যান্ড। সুপার ওভারে ইংল্যান্ড তুললো সেই ১৫ রানই, স্টোকস-বাটলারের দুই চারে।
সুপার ওভারের শেষ বলে রান-আউট গাপটিল/আইসিসি
ফাইনালে রানতাড়ায় ইংল্যান্ডকে প্রায় ডুবন্ত অবস্থা থেকে উদ্ধার করেছিলেন এ দুজনই। লর্ডসের কঠিন উইকেটে শুরুতে ম্যাট হেনরি, মাঝে কলিন ডি গ্র্যান্ডোম ও শেষে লকি ফার্গুসনের তোপে পড়েছিল তারা। ৮৬ রানে ৪ উইকেট যাওয়ার পর স্টোকস ও বাটলার গড়েছিলেন ১১০ রানের জুটি। যখন রান-রেট বাড়ছে, একে একে ফিরেছেন রয়-বেইরস্টো-রুট-মরগান, দুজন দাঁড়িয়ে গেলেন।
ইনিংসের প্রথম বলেই আম্পায়ারস কলে বেঁচেছিলেন জেসন রয়, এদিন আম্পায়াররাও ছিলেন আলোচনায়। এরপর ডাউন দ্য গ্রাউন্ডে এসে লেংথ মেরে খেলেছেন, তিনটি বাউন্ডারি হয়েছে, তবে শেষ পর্যন্ত হেনরির শেষ মুহুর্তে সুইং করে বেরিয়ে যাওয়া বলে খোঁচা দিয়ে আউট হয়েছেন তিনি। একদিকে ম্যাট হেনরি চেপে ধরেছিলেন, আরেকদিকে বোল্ট অবশ্য খরুচে ছিলেন একটু। তাকে সরিয়ে কলিন ডি গ্র্যান্ডোমকে আনলেন উইলিয়ামসন, বেইরস্টোর ফিরতি ক্যাচ ছাড়লেন তিনি। রুট অবশ্য কট-বিহাইন্ড হলেন তার বলেই। বেইরস্টো এর আগে ইনসাইড-এজে বেশ কয়েকবার বেঁচে গেলেও ফার্গুসনের লাফিয়ে ওঠা বলে লাফিয়ে উঠে স্টাম্পে বল ডেকে এনেছেন, আগের বলেই মেরেছিলেন বাউন্ডারি, ফার্গুসনের পেসই কাল হয়েছে তার। আর মরগান নিশামের শর্ট বলে আপার কাট করতে গিয়ে ডিপ পয়েন্টে ফার্গুসনের ডাইভিং ক্যাচের শিকার হয়েছেন।
স্টোকস যেন দাঁড়িয়েছিলেন তার জীবনের সব দায় মোচনের। ইডেন গার্ডেনসের। ব্রিস্টলের পানশালার। আর বাটলার দাঁড়িয়ে ছিলেন তার এ জীবনে সব অনুশীলনের ফলটা আনতে। বোল্টের বলে বাটলারের একটা কাট ব্যাকওয়ার্ড পয়েন্টে নাগালের বাইরে গেল গাপটিলের, ইংল্যান্ডের দিকে যেন ফিরে তাকালো অন্য কিছু। তবে সেটা আদতে কিছুই নয়। ৫৩ বলে ফিফটি হলো বাটলারের, সে ওভারেই ৮১ বলে ফিফটি করলেন স্টোকস। ডিপ পয়েন্টে ফার্গুসনের বলে টেনে মারতে গিয়ে ধরা পড়লেন বাটলার, সাউদি নিলেন ডাইভ দিয়ে অসাধারণ এক ক্যাচ। ফিল্ডিংয়ে এদিন অতিমানবীয় ছিল নিউজিল্যান্ড। ইংল্যান্ডের জন্য থাকলেন শুধু স্টোকস, শেষ ৫ ওভারে প্রয়োজন ছিল ৪৬ রানের।
ইংল্যান্ড : বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন!
ওকস পুল করতে গিয়ে টপ-এজড হলেন ফার্গুসনের বলে। এক ওভারকে নিশামকে দিয়ে করাতে হতো উইলিয়ামসনকে, প্লাঙ্কেট আউট হলেন তার বলেই। লং-অফে ক্যাচ নিলেন বোল্ট, ঠিক সীমানার ভেতর। ৯ বলে তখন ইংল্যান্ডের প্রয়োজন ২২ রান। স্টোকস নিশামের ফুললেংথকে টেনে মারলেন, বোল্ট ধরলেনও। তবে ছুঁড়ে দেওয়ার আগেই বাউন্ডারি কুশনে ছুঁয়ে গেল তার পা!
নাটকের শুরু যেন তখন কেবল। পরের বলে সিঙ্গেলের বেশি নিতে পারলেন না স্টোকস, আর্চার শেষ বলে হলেন বোল্ড। এরপর বোল্ট, ডিফেন্ড করার মতো সম্বল ১৪ রান। প্রথম দুই বল স্টোকস দিলেন ডট, এরপর মিডলস্টাম্পের ফুলটস থেকে তুলে মারলেন ছয়! পরের বলেও এলো ছয় রান। তবে যেভাবে এলো, সেটিই এ ম্যাচকে অলৌকিক বানাতে যথেষ্ট!
ডিপমিডউইকেটে খেলে দুই রান নিতে শেষ পর্যায়ে ডাইভ দিয়েছিলেন স্টোকস, গাপটিলের থ্রো তার ব্যাটে লেগে হয়ে গেল ওভারথ্রো, হলো বাউন্ডারি! আর ইউ কিডিং?
স্টোকস শেষ দুই বলে ইংল্যান্ডের শেষ দুই ব্যাটসম্যানের রান-আউটের আত্মত্যাগে নিতে পারলেন দুই রান। ফাইনাল গেল সুপার ওভারে!
ইংল্যান্ডের ইনিংস আর সুপার ওভারের গল্পে হয়তো হারিয়ে গেল নিউজিল্যান্ডের ব্যাটিংয়ের গল্প। আরেকবার শুরুতে ব্যাটিংয়ে নেমে তারা গড়লো এমন এক স্কোর, যাকে যথেষ্টর চেয়ে কম মনে হলেও আদতে সেটি হয়ে উঠল অনেক বেশি!
প্রথম ইনিংস দেখে মনে হবে, শুরুতে ওকস-আর্চার, এরপর মাঝে প্লাঙ্কেট, সঙ্গে উড, শেষে আর্চার-ওকস, আর এখানে ওখানে আদিল রশিদ- ইংল্যান্ডের বোলারদের কেউ এদিন হতাশ করেননি মরগানকে। শুরুতে লাইন-লেংথের সঙ্গে মুভমেন্ট, মাঝের ওভারে ক্রস সিম, আর শেষে স্লোয়ারের বৈচিত্র নিউজিল্যান্ড ব্যাটসম্যানদের থিতু হতে দেয়নি সেভাবে।
প্রথম বলে ওয়াইড দিয়ে শুরু করেছিলেন, তবে সেটা ছিল শুধু গা-গরমই। লর্ডসের উইকেট শুরুতে যা অফার করেছে, ওকস সেটা নিয়েছেন ভালভাবেই। ওদিক থেকে আর্চার ছিলেন স্কেলমাপা, গাপটিলের বিপক্ষে তার বলে একটা কট-বিহাইন্ডের আবেদন নাকচ করেছিলেন আম্পায়ার মারাই এরাসমাস, পরে যা পরিণত হয়েছে দারুণ সিদ্ধান্তে।
প্রথম আঘাতটা ওকসই করেছেন, অন্তত নিকোলসকে ধর্মসেনা এলবিডব্লিউ দেওয়ার পর মনে হচ্ছিল তেমনই। নিপড-ব্যাক ডেলিভারিটা ব্যাকলেগে নি-রোয়ের ওপরে লেগেছিল তার, বল ট্র্যাকিংয়ে সেটা গেছে স্টাম্পের ওপর দিয়ে। গাপটিল আর্চারকে ছয়-চার মেরে দুঃস্বপ্নের বিশ্বকাপ পেছনে ফেলার ইঙ্গিত দিয়েছিলেন, তবে সে পর্যন্তই। ওকসের ভেতরের দিকে ঢোকা বলে এলবিডব্লিউ হয়েছেন, শেষ মুহুর্তে রিভিউ নিয়ে হারিয়েছেন সেটি, পরে যা ভালভাবেই ভুগিয়েছে নিউজিল্যান্ডকে।
নিকোলসের সঙ্গে উইলিয়ামসন করেছেন টিকে থাকার লড়াই। প্রথম ৩০ বলে মাত্র ৯ রান করেছিলেন উইলিয়ামসন, নিকোলসও শুরুতে ছিলেন ধীরগতির। পরে গিয়ার বদলানো শুরু করেছিলেন উইলিয়ামসন, তবে ছিলেন একজন প্লাঙ্কেট। মিডল ওভার, ক্রস সিম- প্লাঙ্কেট যেন এ দুইয়ের রাজা। সঙ্গে লেংথের বৈচিত্র এনেছেন তিনি দারুণভাবে, ইংল্যান্ডকে এনে দিয়েছেন তিনটি গুরুত্বপূর্ণ উইকেট।
প্রথম এজড হয়েছেন উইলিয়ামসন, আত্মবিশ্বাসী ইংল্যান্ড সবচেয়ে বড় উইকেটটা পেয়েছে রিভিউ নিয়ে, শুরুতে আউট দেননি ধর্মসেনা। ফিফটি করে নিকোলস টানছিলেন নিউজিল্যান্ডকে, উইলিয়ামসনের উইকেটের মতোই একই লেংথ থেকে স্টাম্পে ডেকে এনেছেন তিনি। একটা বড় জুটি পেতে মরিয়া হয়ে পড়েছিল নিউজিল্যান্ড।
আদিল রশিদকে ডাউন দ্য গ্রাউন্ডে এসে চড়াও হতে চেয়েছিলেন টেইলর, সুবিধা করতে পারেননি খুব একটা। এরাসমাসের ভুল এলবিডব্লিউ সিদ্ধান্তের শিকার হয়ে ফিরতে হয়েছে তাকে, বল যেতো উইকেটের ওপর দিয়ে। তবে গাপটিল আগেই রিভিউ নষ্ট করায় বাঁচেননি টেইলর।
এরপর আবার আঘাত করেছিলেন প্লাঙ্কেট, আগে থেকেই আক্রমণের মনোভাব নিয়ে থাকা নিশাম হোয়্যাক করতে গিয়ে ধরা পড়েছেন মিড-অনে, এবার ক্রস সিমের বলটা পড়েছিল ফুললেংথে, পড়ে করেছিল হোল্ড। গ্র্যান্ডোম ও ল্যাথাম এরপর আউট হয়েছিলেন ওকসের বলে, হেনরি বোল্ড হয়েছিলেন আর্চারের বলে।
সেই আর্চার ম্যাচশেষে, মানে সব শেষে, মাটিতে বসে চাপড় দিচ্ছিলেন।
হয়তো আনন্দের আতিশয্যে। হয়তো তখন আপনি-আমি চাপড়াচ্ছিলাম দেওয়াল। অথবা টেবিল। অথবা অন্য কিছু। কেন?
সেটি জানা নেই। অলৌকিক কোনও কিছুর ব্যাখ্যা করতে যাওয়ার কোনোও মানে নেই।