মাজিয়ার মার্জনা পেল না 'শ্লথ আবাহনী'
ঘরের মাঠে ম্যাচ। এএফসি কাপে দক্ষিণ এশিয়ার চ্যাম্পিয়ন তারা। আরও একবার এএফসি কাপে খেলতে হলে মালদ্বীপের ক্লাব মাজিয়াকে টপকাতে হবে আবাহনীর। কিন্তু আবাহনীর সেই তৃষ্ণাটা কই? মাজিয়া ইট মারলে, জবাবে পাটকেল মারল আবাহনী। একই ঘটনা দুই অর্ধে ঘটল দুইবার। তাই ম্যাচ ড্র ২-২ গোলে। অ্যাওয়ে গোল ঠেকানোর বদলে আবাহনী হজম করেছে দুইটি। দ্বিতীয় লেগে মালেতে একরকম জিততেই হবে আবাহনীকে। ৩-৩ বা ৪-৪ গোলের নাটকীয় ড্র হলেও পরের রাউন্ডে উঠবে আবাহনীক। সেরকম নাটক আশা করার সুযোগ কই? ওর চেয়ে বরং জয়ের সমীকরণই তো সহজ!
বড় ম্যাচে যে ধরনের বড় পারফরম্যান্স দরকার ছিল- সেটাই খুঁজে পাওয়া যায়নি আবাহনীর খেলায়। এই আবাহনী বড্ড শ্লথ, জয়ের ক্ষুধাও নেই। বিরক্তি ধরানো উদ্দেশ্যহীন ব্যাকপাস, গতিহীন কাউন্টার অ্যাটাক- এই আবাহনী অচেনা। গত বছর এএফসি কাপে ঘরের মাঠে একটি ম্যাচও হারেনি আবাহনী। দিনশেষে কেবল ওই সান্ত্বনাটুকুই সঙ্গী হয়েছে আবাহনীর, ধারাটা চালু থেকেছে।
আবাহনী মাজিয়ার বিপক্ষে খেলতে নেমেছিল ৩৬ দিন বিশ্রামে থাকার পর। মাজিয়া ঘরোয়া লিগে খেলছে নিয়মিত। দীর্ঘ বিরতিতে থাকা একটি দল আর খেলতে থাকা আরেকটি দলের খেলোয়াড়দের মেজাজে তেমন পার্থক্য হওয়ার কথা- তেমনটাই দেখা গেল বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামে।
আবাহনী কোচ মারিও লেমোসও ম্যাচ শেষে এই কথাগুলোই বললেন ঘুরিয়ে ফিরিয়ে। দলের কাছ থেকে তার প্রত্যাশা ছিল আরও বেশি, “আমার কাছে খেলা দেখে মনে হয়েছে রহমতগঞ্জের বিপক্ষে খেলছি আমরা। আমরা যে বড় একটা ম্যাচ খেলতে মাঠে নেমেছি সেটা মনে হলো না। আমি খেলোয়াড়দেরও একই কথা বলে এসেছি।”
আবাহনীর খেলায় যে ছন্দ ছিল সেটা সবচেয়ে বেশি স্পষ্ট হয়েছে মাজিয়ার করা দুইটি গোলেই। মাজিয়া মূলত খেলছিল কাউন্টার অ্যাটাকে। কানাডিয়ান স্ট্রাইকার কর্নেলিয়াস এজিকিইয়েল বিপদ সংকেত বাজিয়ে গিয়েছিলেন প্রথম ২০ মিনিটেই। আবাহনী ডিফেন্ডারদের ছিন্ন ভিন্ন করে ঢুকে গিয়ে গোলরক্ষক শহীদুল আলমের হাতে ধরা পড়ে আর গোল পাওয়া হয়নি তখন তার। সেই গোল ৪২ মিনিটে করেও অবশ্য স্কোরশিটে নাম তোলা হয়নি কর্নেলিয়াসের। ইব্রাহিম মাহুদি বল নিয়ে ঢুকে গেলেন ডান প্রান্ত ধরে। তাকিয়ে তাকিয়ে দেখলেন সেটা রায়হান আর মেলসন। বাইলাইনের কাছাকাছি গিয়ে উড়িয়ে মারলেন ক্রস, গোলের সামনে থাকা কর্নেলিয়াস ফাঁকা বারে বল ঠেলে দিয়েছিলেন। বল অবশ্য লাইন অতিক্রম করেছিল আরও আগেই। গোলটাও তাই পেলেন ইব্রাহিমই।
মাজিয়ার দ্বিতীয় গোলে আরও হতাশ হওয়ার কথা লেমোসের। এর আগে এক গোল খেয়ে প্রথমার্ধের যোগ করা সময়েই সেটা শোধ করে দিয়েছিলেন ব্রাজিলিয়ান ডিফেন্ডার মেলসন ভেরিয়াতো। রায়হানের লম্বা বল বক্সের ভেতর বুক দিয়ে নামিয়ে বাম পায়ের হাফ ভলিতে চোখ ধাঁধানো এক গোল করেছিলেন মেলসন। বিরতিতে আবাহনী গিয়েছিল তাই সমতায় থেকে।
কিন্তু দ্বিতীয়ার্ধেও হুশ ফেরেনি আবাহনীর। হুশ ফিরল আরেক গোল হজম করে। যে গোলটি আবাহনীকে আসলে দ্বিতীয় লেগের আগেই পিছিয়ে দিয়েছে অনেকখানি। ৬৩ মিনিটে বক্সের বাইরে থেকে করা মাজিয়ার জোরালো শট প্রথমে ঠেকিয়ে দিয়েছিলেন সোহেল। কিন্তু রিবাউন্ডে আর রক্ষা হয়নি তার। কর্নেলিয়াস জায়গামতো ছিলেন, গোল দিয়েই উদযাপনে মেতে উঠলেন তিনি।
লেমোসের কাছে এই দুইটি গোলেরই কোনো ব্যখ্যা নেই, “আমরা সহজ দুইটি গোল খেলাম। এই পর্যায়ে এমন গোল হজম করলে ভালো করা কঠিন।” মাজিয়া কোচ সেকুলোভস্কি অবশ্য বলছেন অন্যকথা। তার হিসেবে, আরও তিন-চারটি গোল পেতে পারত মাজিয়া। যদিও সেকুলোভস্কির সঙ্গে ম্যাচের পরিসংখ্যানের মিল নেই। ওই দুইটি সুযোগ বাদে মাজিয়া আবাহনীর রক্ষণে ভীতি চড়াতে পেরেছে কমই।
জিততে না পারার জন্য আবাহনী দুষতে পারে কেবল নিজেদেরই। ম্যাচের শুরুটা ধীর গতিতে করলেও আধ ঘন্টা পেরুনোর পর কিছুটা ধার বেড়েছিল আবাহনীর আক্রমণে। সানডে চিজোবার হেড লাগল বারপোস্টে, সাদের ক্রস থেকে নিখুঁত হতে পারলেন না নাবিব নেওয়াজ জীবনও। প্রথমার্ধে আবাহনীকে ধারালো মনে হলো ওই দুই, তিন মিনিট।
লেমোস নিজেও ভুল করলেন। জীবন এদিন খেললেন উইংয়ে। সেই কৌশল কাজে দেয়নি আবাহনীর। বেলফোর্ট-সানডেদের সঙ্গে তার বোঝাপড়াও হলো না জীবনের, আবাহনীর ‘ত্রয়ীও তাই ত্রাতা হতে পারলেন না। জীবন পুরো ম্যাচে গোলেই শট করতে পারেননি। দ্বিতীয়ার্ধে মামুনুল, এডগারদের মিডফিল্ডও দ্বিধা-দ্বন্দে ভুগলেন বেশিরভাগ সময়। বেলফোর্ট দ্বিতীয়ার্ধে গোলবঞ্চিত হয়েছেন গোললাইন ক্লিয়ারেন্সে। শেষে রক্ষা করলেন অবশ্য সানডে। রায়হান হাসানের লম্বা থ্রো পুঁজি করে বক্সের ভেতর বেলফোর্ট বল বাড়িয়ে দিয়েছিলেন সানডেকে। ৮০ মিনিটে সমতায় ফিরল আবাহনী। কিন্তু ক্ষতি যা হওয়ার তা তো আগেই হয়েছে গেছে আবাহনীর।
গতবারের এএফসি কাপে আবাহনীর দেখা মিলল শেষ দশ মিনিটে। কিন্তু তাতেও পুঁজি করার মতো আত্মবিশ্বাস সঙ্গী হলো না আর। মালেতে ১২ তারিখ দ্বিতীয় লেগের আগে লেমোসের হাতে তাই বড় চ্যালেঞ্জ। এই দলটাকে তার আগে ঘষে-মেজে ঠিকঠাক করতে হবে লেমোসকে। তিনিও স্পষ্ট করে বলে দিয়েছেন, এই পারফরম্যান্স থাকলে পরের লেগে কোনো সুযোগই নেই আবাহনীর।
ম্যাচ শেষে মাজিয়া কোচ সেকুলোভস্কি মাঠেই একবার খেলোয়াড়দের নিয়ে দাঁড়িয়ে গেলেন। পুরো দল এক করে হয়ত ভুল-ভ্রান্তিই ধরিয়ে দিলেন কয়েক মিনিটের বৈঠকে। এর পর সংবাদ সম্মেলনে এসে বললেন, কাজ এখনও শেষ হয়নি তাদের। দুই অ্যাওয়ে গোলেও তৃপ্ত নন তিনি। লেমোসের আবাহনী চাইলে শিখতে পারে এখান থেকেই। এশিয়ার সর্বোচ্চ পর্যায়ে সাফল্যবুভুক্ষ না হলে উন্নতি আসবে কোথা থেকে!