এশিয়ার 'ক্রিকেট বিদ্রোহ'-শেষ পর্ব
ফুটবলের মত ক্রিকেটে মহাদেশীয় শ্রেষ্ঠত্ব প্রকাশের কোন বালাই নেই। প্রত্যেক মহাদেশে আইসিসির পূর্ণ সদস্যই যে মাত্র হাতে গোণা! ক্রিকেট পাগল উপমহাদেশীয়রা তাই দুনিয়ার একমাত্র মহাদেশীয় ক্রিকেট টুর্নামেন্ট নিয়ে বড়াই করতেই পারে! দু'বছর বাদে আবার দুয়ারে এশিয়া কাপ। প্রথা ভেঙ্গে টি-টোয়েন্টি ফরম্যাটে আসা এই টুর্নামেন্ট শুরুর প্রাক্কালে চলুন ঘুরে আসা যাক এর ইতিহাস থেকে। ৩২ বছরের পুরোনো এই টুর্নামেন্টে কালের ধুলো কম পড়েনি আসলে। আজ থাকছে শেষ পর্ব।
আরো পড়ুনঃ
এশিয়ার ক্রিকেট "বিদ্রোহ"- প্রথম পর্ব
এশিয়ার ক্রিকেট "বিদ্রোহ"- দ্বিতীয় পর্ব
কলিযুগ...
সূর্যের প্রথম আভার মতো বাংলাদেশের ক্রিকেটে টেস্ট মর্যাদা এনেছিল অনেক রঙ্গিন ছোপ, তবে সেটা কেবল মাঠের বাইরে, মাঠের খেলায় ঐ রঙ কেবল কলঙ্কের কালি হয়েই লেগেছে। ২০০০ সালের এশিয়া কাপের পরপরই বাংলাদেশের টেস্ট মর্যাদা পায়, সেই মর্যাদা বাংলাদেশ তখন পাবার যোগ্য ছিল কিনা এই প্রশ্ন এখনো যে উঠে তাঁর মূলে তো ঐ সময়ের পারফরম্যান্সই দায়ী। সেসব ইতিহাস কারো অজানা নয়, দেশের ক্রিকেটপ্রেমীরা এখনো ভুলেননি একের পর হারের লজ্জা হজম করার সেসব দিনগুলোর ইতিবৃত্ত। সিরিজ শুরুর আগে ‘প্রতিপক্ষ কে খাটো করে দেখছি না’ খোঁচা খাবার গঞ্জনাও এদেশের ক্রিকেটপ্রেমীদের মেনে নিতে হয়েছে, শুনতে হয়েছে কুলীন টেস্টদলগুলোর অপমানসূচক কথাবার্তাও। টেস্ট মর্যাদা লাভের প্রথম কয়টি বছর তাই বাংলাদেশের ক্রিকেটের জন্য ঘোর অমানিশার রাত! চার বছর বিরতির পর মাঠে গড়ানো এশিয়া কাপে হংকং এর বিরুদ্ধে জয়টা এজন্যেই হয়তো বাংলাদেশের ক্রিকেটপ্রেমীদের বেশ আলোড়িত করেছিল। হারের অন্ধকার মিছিলে ওটাই তখন ছিল একরত্তি দীপশিখা!
২০০৪ সালের এশিয়া কাপ বাংলাদেশ ক্রিকেটের একটা যুগ সন্ধিক্ষণ! পরের বছরগুলোয় বাংলাদেশের ক্রিকেট যাদের হাত ধরে অল্প অল্প হলেও এগিয়েছে, তাঁদের দলে আসা শুরু সেই টুর্নামেন্ট থেকেই। একজন আব্দুর রাজ্জাক ওয়ানডেতে বাংলাদেশের স্পিন আক্রমণের রাজ হবেন - সেটার পূর্বাভাস তিনি ঐ টুর্নামেন্টের প্রথম ম্যাচেই দিয়েছিলেন। হংকং এর বিরুদ্ধে ম্যাচটাই ছিল তাঁর অভিষেক ম্যাচ, তাতে মাত্র ১৮ রান দিয়ে ৩ উইকেট। বল করেছিলেন পুরো দশ ওভার। হংকং এর বিরুদ্ধে মাত্র ২২১ রান করলেও বাংলাদেশের জয় ছিলো ১১৬ রানের।
হংকং এর মত সহযোগি দেশের বিরুদ্ধেও যে বাংলাদেশের ব্যাটিং কেঁপেছে, পরের ম্যাচে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ১৮১ রানে অলআউট হওয়ায় তাই আর বিস্ময়ের কি আছে? দুটো ম্যাচেই অবশ্য বাংলাদেশের প্রাপ্তি ছিল- তখন কোনো বাংলাদেশি ব্যাটসম্যানের পরপর দুই ম্যাচে ফিফটি পাওয়াই যে ছিল অনেক বড় ঘটনা। জাভেদ ওমর বেলিম সেটা করে স্বাভাবিকভাবেই দেশের দৈনিকগুলোর খেলার পাতায় বেশকিছুদিন শিরোনাম হয়ে ছিলেন!
হংকং এর বিরুদ্ধে প্রথম ম্যাচটা অবশ্য আরেকটা কারণে ইতিহাসে ঢুকে আছে! মোহাম্মদ রফিক যে ঐ ম্যাচে তাঁর দশ ওভার কোটার বাইরেও আরো দুইটি বল অতিরিক্ত করেছিলেন! আম্পায়াররা ওভার সংখ্যা গুলিয়ে ফেলেছিলেন, অধিনায়ক হাবিবুল বাশারও তাই। শেষ উইকেটটা রফিকের ওই ওভারে না পড়লে হয়তো ইতিহাসে ৫০ ওভারের ক্রিকেটে একজন বোলারের বোলিং কার্ডে ১১ ওভার বল করার কথা লেখা থাকত! অবশ্য এমনিতেও ওই ম্যাচে রফিকের বোলিং কার্ড কম আকর্ষনীয় নয়। ১০.২ ওভার বল করে ২১ রানে ২ উইকেট। সাথে ৩টা মেডেন। এই যুগে এমন ভুল, ভাবা যায়?
চিত্রনাট্যক্রম...
২০০৪ আর ২০০৮ এর টুর্নামেন্ট দু'টো ছিল ছয় দলের। সহযোগি দেশ হিসেবে দুটি আসরেই খেলেছিল সংযুক্ত আরব আমিরাত আর হংকং। অঘটন তো পরে; সহযোগি দেশগুলো কোন প্রতিদ্বন্দ্বিতাই গ্রুপ পর্বের খেলাগুলোয় করতে পারেনি। সুপার ফোরের দ্বিতীয় রাউন্ডটা তাই ছিল আক্ষরিক অর্থেই অনুমেয়। আসল টুর্নামেন্ট ছিল সেটাই।
আগের সব এশিয়া কাপের মত এখানেও ছিল একই চিত্রনাট্য। বাংলাদেশ এখানে অনাহূত, ‘ফাইটিং স্কোর’ গড়ে হিমালয় উঁচু প্রতিপক্ষের সামনে বাধা সৃষ্টি করাই তখন ছিল মাঠে নামার উদ্দেশ্য। এই হিসেবটা বাদ দিলে অবশ্য টুর্নামেন্টটাকে বেশ উপভোগ্যই বলতে হয়- ফাইনালে যাবার ত্রিমুখী লড়াইটা ঐ এশিয়া কাপেই আগের সব বারের চাইতে ভাল জমেছিল। ভারত-পাকিস্তান-শ্রীলঙ্কা তিন দলই জিতেছিল দুটি করে ম্যাচ। কিন্তু বোনাস পয়েন্টের মারপ্যাঁচে পরে পাকিস্তান আর ফাইনালে যেতে পারেনি। ভারতকে ৫৯ রানে হারিয়ে এবং শ্রেয়তর রানরেট নিয়েও এশিয়া কাপের চিরদুর্ভাগা পাকিস্তান তাই ফাইনালে ছিল দর্শক!
ঐ সময়টা ভারতের জন্যে ফাইনালে হেরে যাবার যুগ! সৌরভ গাঙ্গুলির ‘টিম ইন্ডিয়া’ তখন প্রবল বিক্রমে একেকটা টুর্ণামেন্টের ফাইনালে উঠে আর এরপর খেই হারিয়ে ফেলে। শ্রীলঙ্কার সাথে ফাইনালটাও ছিলো এরকমই। শ্রীলঙ্কাকে মাত্র ২২৮ রানে বেঁধে রেখেও ভারত ২০৩ রানের বেশি করতে পারেনি!
২০০৮ সালে আবারও ফাইনালে ভারত-শ্রীলঙ্কা; ভারতকে দুমড়ে মুচড়ে হারিয়েও বোনাস পয়েন্টের গোলকধাঁধায় পাকিস্তান ফাইনালে পুনরায় দর্শক। ঘরের মাঠে ফাইনাল না খেলতে পারার যাতনা পাকিস্তানকে ঐ আসরে নিশ্চিতভাবেই পুড়িয়েছে।
ঐ আসরটা অনেকদিক থেকেই অনন্য ছিল। পাকিস্তানে প্রথমবারের মত এশিয়া কাপ খেলতে গিয়েছিল ভারত। পাকিস্তানের শেষ কোনো আন্তর্জাতিক টুর্ণামেন্ট আয়োজনও তো সেটাই। ২০০৯ সালের সন্ত্রাসী হামলার পর তো আন্তর্জাতিক ক্রিকেটই সেখানে বন্ধ হয়ে যায়!
আধুনিক স্পিন যাদুকরদের সূচনালগ্ন হিসেবেও আপনি ঐ আসরকে মনে রাখতে পারেন! সাইদ আজমলের অভিষেক ঐ টুর্নামেন্টেই, প্রথম ম্যাচেই পেয়েছিলেন ভারতকে হারানোর স্বাদ। তবে নিশ্চিতভাবেই ঐ টুর্নামেন্টের আবিষ্কার অজন্তা মেন্ডিস। সুপার ফোরের ম্যাচে ভারতের বিপক্ষে এই মেন্ডিসকে শ্রীলঙ্কা খেলায়ইনি। সেই মেন্ডিসই ফাইনালে মাত্র ১৩ রান দিয়ে নিলেন ছয় উইকেট; তাও মাত্র ৮ ওভার বল করে। ক্যারম বলের ক্যারিশমা দিয়ে একাই ধ্বসিয়ে দিলেন ভারতকে।
পরের এশিয়া কাপ আবারো ফেরত গেলো ৪ দলের টুর্ণামেন্টের পুরোনো কাঠামোতে। যথারীতি বাংলাদেশ জঘন্যভাবে সব ম্যাচ হারল, ভারত-শ্রীলঙ্কা আবারো ফাইনাল খেললো এবং এবার ভারত কাপ জিতল।
কাছে অথবা দূরে...
আগের আসরে জঘন্যভাবে ম্যাচ হারার দায়ভারটা কি সুন্দরভাবেই না ফিরিয়ে দিয়েছিল বাংলাদেশ! কিন্তু ২০১২ সালের এশিয়া কাপটাকে আপনি কিভাবে মনে রাখবেন? চার বছর হয়ে গেছে, তবুও চোখ বন্ধ করে দেখুন- স্মৃতির আয়নায় ঐ এশিয়া কাপের সবক'টা স্মৃতি এখনো কত পরিষ্কার। তামিমের টানা চারটি অর্ধশতক, ভারতের বিপক্ষে মুশফিকের সেই উত্তাল ঝড়ের সাথে সাজঘরে সাকিব আল হাসানের বুনো চিৎকার; কিংবা শ্রীলঙ্কাকে বিহ্বল করে দেয়া নাসির-মাহমুদউল্লাহর সেই ষষ্ঠ উইকেট জুটি - সব ছাপিয়ে ঐ এশিয়া কাপ নিশ্চিতভাবেই আপনি মনে রেখেছেন মুশফিকের হুহু কান্নার সাথে, নাসির-সাকিবের ঠোঁট চেপে চোখের পানি আটকানো দৃশ্যের মাঝে। ক্রিকেট রোমাঞ্চের পুরো পসরা নিয়ে বসেছিল ঐ টুর্নামেন্ট।
প্রত্যেক দল চোখে চোখ রেখে লড়াই করেছে ঐ আসরেই, টেন্ডুলকার পেয়েছেন তাঁর শততম শতক, বিরাট কোহলি খেলেছেন এখন পর্যন্ত তাঁর ক্যারিয়ার সেরা ইনিংস। এগারোটি আসরের মধ্যে সবচাইতে উপভোগ্য ফাইনাল হয়েছে এই টুর্নামেন্টেই। এত বড় একটা টুর্নামেন্টের সেরাও হয়েছিলেন একজন বাংলাদেশি - সাকিব আল হাসানের ঐ কৃতিত্বটা এখনো কোন বাংলাদেশি আর করে দেখাতে পারেননি।
আগের আসরের সেই অদম্য বাংলাদেশই পরের আসরে হারলো আফগানিস্তানের কাছে। গ্রুপ পর্বের সব ম্যাচ হেরে তলানিতে থেকে শেষ করল ২০১৪ সালের এশিয়া কাপের টুর্নামেন্টটা। গত টুর্নামেন্টের কথা তাই বাদই থাক। কি দরকার হৃদয় খুঁড়ে অহেতুক বেদনা জাগানোর?
২০১০ এর বাজে পারফরম্যান্সের পরই কিন্তু ২০১২ এর অমন উন্মত্ত পথচলা। গত টুর্নামেন্টটাও ভাল যায়নি বাংলাদেশের, সেটা অবশ্য ২০১৪ সালের কথা। মাঝখানে রূপকথার মত ২০১৫ গিয়েছে। ধ্বংসস্তূপ থেকে ফিনিক্স পাখির আকাশযাত্রাও ঘটেছে এ বছর। পরিসংখ্যানও বলে এখনই কিন্তু বাংলাদেশের সময় কিছু হিসেব চুকিয়ে দেয়ার। আজই শুরু নতুন ফরম্যাটের নতুন এশিয়া কাপ। বাংলাদেশ, পারবে কি এবার?