• চ্যাম্পিয়নস লিগ
  • " />

     

    আলফনসো ডেভিস রুপকথা : ঘানার শরণার্থী শিবির থেকে বায়ার্নের বিশ্বমঞ্চে

    আলফনসো ডেভিস রুপকথা : ঘানার শরণার্থী শিবির থেকে বায়ার্নের বিশ্বমঞ্চে    

    বার্সেলোনার বিপক্ষে বায়ার্ন মিউনিখের ‘সেই’ ম্যাচে তখন ঘড়ির কাঁটায় ৬৩ মিনিট চলছে। বায়ার্ন তখন ৪-২ গোলে এগিয়ে। কাতালানদের বক্সের বাম প্রান্তে বার্সেলোনা রাইট ব্যাক নেলসন সেমেদো এবং বায়ার্ন লেফটব্যাক আলফনসো ডেভিস মুখোমুখি অবস্থায়। অভিজ্ঞতায় ডেভিসের চেয়ে যোজন যোজন এগিয়ে পর্তুগিজ সেমেদো। ১৯ বছরের ডেভিসের সামনে সেমেদোর অভিজ্ঞতার ভান্ডার কোনো কাজে আসলো না। বলের সামনে দুইজন মুখোমুখি থাকা অবস্থায় হালকা বলের ওপর দিয়ে পা ঘোরালেন ডেভিস, চোখের পলকেই ডান বুটের বাইরের অংশের ছোঁয়ায় বল সেমেদোর থেকে দূরে নিয়ে গেলেন। তারপর বাম পাশের বাইলাইন ধরে ভোঁ দৌড়। প্রায় বাধাহীনভাবে বার্সেলোনার গোলপোস্টের কাছে পৌঁছে গেলেন তিনি, সেখান থেকে নিঃস্বার্থভাবে কাটব্যাক করলেন গোলের একেবারে সামনে থাকা কিমিখের উদ্দেশ্যে। পাতে তুলে দেওয়া সেই বল ট্যাপ করে জালে পাঠাতে কোনও ভুল করেননি কিমিখ।

    বায়ার্ন টিনএজার ডেভিসের ক্যারিয়ারে এটিই নিঃসন্দেহে এখন পর্যন্ত সেরা মুহূর্ত। দুর্দান্ত সেই অ্যাসিস্টের পর পুরো দল যখন তাকে ঘিরে ধরল তখন টিভি সেটের সামনে বসা তার বাবা ডেভিয়া ডেভিস এবং ভিক্টোরিয়া ডেভিস নিশ্চয়ই আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েছিলেন। কারণ ডেভিসের এই পর্যন্ত আসার পেছনের গল্পটা যে বড় নির্মম আর হতাশায় ভরা।

     


    ২০০০ সালে বিশ্ব যখন নতুন শতাব্দীকে বরণ করে নিচ্ছে, লাইবেরিয়ায় তখন ভয়ংকর গৃহযুদ্ধ চলছে। দেশটি থেকে হাজারো শরণার্থী তখন আশ্রয় নিয়েছে প্রতিবেশী ঘানার বুদুবুরাম অঞ্চলে। ওই ক্যাম্পে আশ্রয় নিয়েছিলেন ডেভিসের বাবা মাও। ডেভিসের জন্মও সেখানে। ২০০০ সালের ২ নভেম্বর। বুদুবুরাম শরণার্থী ক্যাম্প তখন লাইবেরিয়া থেকে যুদ্ধ অতিক্রম করে আসা লোকজনে ঠাসা, সেই ক্যাম্পের পরিবেশ যেন তখন জেলখানাকেও হার মানায়।

    শরনার্থী ক্যাম্প সুখের জায়গা নয়। সদ্যোজাত সন্তান নিয়ে দেশে যে ফিরে যাবেন সেই উপায়ও নেই, সদ্য ভূমিষ্ঠ শিশুকে নিয়ে ঝুঁকি নেওয়া যায় না। “লাইবেরিয়ায় মানুষের লাশ অতিক্রম করে খাবার আনতে যেতে হত। সেখানে খুবই ভয়ংকর অবস্থা ছিল।”- এতোগুলো বছর পর স্কাই স্পোর্টসকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন ডেভিসের মা। 

    ঘানায় শরণার্থী ক্যাম্পে থাকা ডেভিস প্রথম কয়েক বছর স্কুলে যেতে পারেননি, পর্যাপ্ত খাবার জুটত না অনেক সময়। তবুও ডেভিসের বাবা-মা সবসময় নিজেরা না খেয়ে থাকলেও ডেভিসকে যেন একেবারে উপোস থাকতে না হয় সেই চেষ্টা করেছেন। বাবা মায়েরা যা করেন আর কী! ডেভিসের বাবা ডেভিয়ার সেই দুঃস্মৃতির দিনগুলো যতবার মনে পড়ে, ততবার আঁতকে ওঠেন নতুন করে, “ঘানায় আমরা নিরাপদ ছিলাম। তবে সেখানে বসবাস করা কঠিন ছিল। আমরা সবসময় দুশ্চিন্তায় চিন্তায় দিন কাটাতাম। আমাদের শুধু যুদ্ধক্ষেত্রেই নয়, ক্যাম্পেও ক্ষুধার সঙ্গে লড়তে হয়েছে। আমি এবং আমার স্ত্রী শুধু পানি খেয়ে ঘুমিয়ে যেতে পারতাম, কিন্তু আলফোনসো সেটা পারত না। তাই তার জন্য প্রতিদিনই আমাদের কিছু না কিছু খাবার যোগাড় করতে হত।”

    বুদুবুরামের শরণার্থী কাম্পে জীবনের মৌলিক চাহিদাগুলো পূরণ করতে না পারা সেই পরিবার থেকেই নিজের প্রতিভার গুণে বিশ্বমঞ্চে উঠে এসেছেন ডেভিস। স্ট্যামফোর্ড ব্রিজে চেলসির রক্ষণে আতঙ্ক ছড়িয়েছেন তিনি, ‘বিশ্বের সেরা ক্লাবকে’ ধসিয়ে দিতেও সামনে থেকে লড়েছেন। তবে সাফল্যের অনন্য উচ্চতায় উঠে গেলেও নিজের কঠিন অতীতকে ভুলে যাননি তিনি। খুব কম বয়সেই জীবন-মুদ্রার দুই পিঠই দেখা হয়ে গেছে তার। তাই অতি আড়ম্বরের মাঝেও নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে অসুবিধা হয় না এই ডেভিসের।


    ঘানায় পাঁচ বছর শরণার্থী ক্যাম্পে কাটানোর পর  ভাগ্য ফিরেছিল ডেভিস পরিবারের। একটি শরণার্থী পুনর্বাসন প্রক্রিয়ার আওতায় কানাডায় যাওয়ার সুযোগ পান ডেভিস ও তার পরিবার। আর কানাডাতেই প্রথম ফুটবলে হাতেখড়ি হয় তার। স্কুল পড়ুয়া ডেভিস এডমন্টন শহরের বেশ কয়েকটি ক্লাবে খেলার পর এডমন্টন স্ট্রাইকার্সে এসে থিতু হন। ছেলের দল এডমন্টন স্ট্রাইকার্সকে সাহায্য করতে তখন দলটির কোচের দায়িত্ব নিয়েছিলেন আইটি পেশাজীবী নিক হুসেহ।

    স্কাই স্পোর্টসের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে ডেভিসকে নিয়ে স্মৃতির ঝাঁপি খোলেন হুসেহ, “আলফনসো সবসময়ই শান্তশিষ্ট ছিল। কানাডায় আসার পর তার বাবা-মা সারাদিন কাজে ব্যস্ত থাকত। তাই তখন সে স্কুল থেকে এসে তার ছোট ভাই-বোনের দেখাশুনা করত। টিনএজে পদার্পণের আগেই সে তার ভাই-বোনের ডায়পার বদলে দিত, তাদের জন্য দুধ গরম করাসহ আরও অনেক কাজ করত। ১১ বছর বয়সেই সে শিখে গিয়েছিল কীভাবে স্বনির্ভর এবং দায়িত্বশীল হতে হয়।”

    ডেভিসের বাবা-মা কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকায় সপ্তাহের পাঁচদিনই হুসেহ-র বাসায় কাটত তার। সেখানে ভাই-বোনের দেখাশোনা করেই সময় কেটেছে ডেভিসের। ধীরে ধীরে সেই খাঁচা থেকে বের হয়ে আসেন ডেভিস। শৈশব থেকেই বাবা-মায়ের শিখিয়ে দেওয়া নীতিবাক্যগুলো অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলেছেন তিনি, “আমি সবসময় ওর সঙ্গে কথা বলতাম। খারাপ বন্ধুদের সঙ্গে মিশবে না। কখনো খারাপ মানুষ হবে না। সে যদি একান্তই অসৎ সঙ্গে পড়ে যায়, সেটা তার ওপর। তবে আমাদের বিশ্বাস সে কখনো তেমন কিছু করবে না।”- বাবার বিশ্বাস অটুট রেখেছেন ডেভিস।

    কৈশোরে কাঁধে চেপে বসা দায়িত্ববোধ ফুটবল মাঠে  কাজে লেগেছে তার। ১৪ বছর বয়সে অ্যালবার্টা অঞ্চলে গতি এবং ফুটবল শৈলীর কারণে বেশ নামডাক কুড়িয়ে ফেলেছিলেন ডেভিস। শেখার প্রবল আগ্রহই তাকে এতদূর নিয়ে এসেছে বলে মনে তার কৈশোরের কোচ হুসেহ, “সে স্পঞ্জের মতো ছিল। তাকে যাই বলতাম তার সবই সে যেন নিজের পরিপক্ব মস্তিস্ক দিয়ে শুষে নিত। এরপর অন্য সবার চেয়ে দ্রুত সেটা শিখত এবং কাজেও লাগাত।”

    ডেভিসের প্রতিভার খবর দেশ-বিদেশে ছড়িয়ে পড়তে এরপর খুব বেশি সময় লাগেনি। কানাডার ক্লাব ভ্যাঙ্কুভার হোয়াইটক্যাপস ১৪ বছর বয়সী ডেভিসকে নিজেদের আবাসিক অ্যাকাডেমি স্কিমের আওতায় তাকে ভ্যাঙ্কুভারে নিয়ে যেতে চায়। তবে তারা বাবা-মা প্রথমে ছেলেকে দূরে পাঠাতে অনীহা জানান, ছেলে দূরে গিয়ে অসৎ সঙ্গে পড়ে যায় কিনা সেটি নিয়েই ছিল তাদের ভয়। তবে বাবা-মাকে আশ্বস্ত করে শেষ পর্যন্ত ভ্যাঙ্কুভার যাওয়ার অনুমতি পান ডেভিস।


    বিভিন্ন বড় বড় ক্লাবের এজেন্টরা তখন থেকেই তাকে বিভিন্ন উপহার পাঠানো শুরু করে দিয়েছিল ডেভিসের বাসায়। অল্প বয়সেই তাই এজেন্টেও দরকার হয়ে পড়ে ডেভিসের জন্য। কৈশোরের কোচ হুসেহকেই ডেভিসের এজেন্ট এবং স্থায়ী মেন্টর হওয়ার প্রস্তাব দেন তার মা। সেই প্রস্তাব গ্রহণ করা হুসেহ এখনো ডেভিসের সঙ্গেই রয়েছেন।

    ভ্যাঙ্কুভারের হয়ে খেলার সময় ডেভিসকে নিয়ে বেশ আগ্রহী হয়ে ওঠে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের উত্তর আমেরিকা অঞ্চলের স্কাউট হোর্হে আভিয়াল। হামেস রদ্রিগেজ, ফ্রেডি আডু এবং ক্রিশ্চিয়ান পুলিসিচের মতো খেলোয়াড়দের তিনিই খুঁজে বের করেছেন। হোয়াইটক্যাপসের একাডেমিতে আসার পর থেকেই তার দিকে নজর রেখেছিলেন আভিয়াল।

    মাত্র ১৫ বছর ৩ মাস বয়সে ভ্যাঙ্কুভারের হয়ে উত্তর আমেরিকার লিগ ফুটবলের দ্বিতীয় বিভাগ ইউএসএলে প্রথম গোল করেন ডেভিস। এই প্রতিযোগিতার সবচেয়ে কমবয়সী গোলদাতাও হয়ে যান তিনি। আর ইউএসএলে ডেভিসের খেলা দেখে মুগ্ধ হয়ে যান আভিয়াল, “শুধু তার ফুটবল প্রতিভাই নন, তার ব্যক্তিত্বও আমাকে মুগ্ধ করেছিল। আমি দেখেছিলাম সে শিখতে চায়। সাধারণত তার বয়সী অন্যদের মাথায় পোর্শে গাড়ির স্বপ্ন ঘুরঘুর করতে থাকে। অন্যরা তারকা হতে চায়, তবে সে শুধু শিখতে চায়। আর এমনটা সচরাচর দেখা যায় না।”

    “যখন আমি একজন খেলোয়াড়ের ব্যাপারে নিশ্চিত হই, তখনই আমি আমাদের বসদের তার ব্যাপারে জানিয়ে দেই। আমি শুরু থেকেই বুঝেছিলাম সে বিশেষ একজন খেলোয়াড়, আর ধীরে ধীরে ইউনাইটেডও তার ব্যাপারে আগ্রহী হয়ে ওঠে।”

    তবে ততদিনে ভ্যাঙ্কুভারও ডেভিসের বিশেষ প্রতিভা সম্পর্কে নিশ্চিত হয়ে গেছে। ১৫ বছর বয়সেই ডেভিস পেয়ে যান প্রথম পেশাদার চুক্তি। ভ্যাঙ্কুভারের জার্সি গায়ে এরপর এমএলএসের ইতিহাসে সবচেয়ে কমবয়সী খেলোয়াড় হিসেবে অভিষেক হয়ে যায় তার। এমএলএসে তার প্রথম কোচ কার্ল রবিনসনও তার প্রশংসায় পঞ্চমুখ, “আমি খেলোয়াড় এবং ম্যানেজার হিসেবে ক্যারিয়ারে হাজারো খেলোয়াড় দেখেছি। তবে তাকে দেখলেই আপনি বুঝে যাবেন যে সে বিশেষ একজন ফুটবলার। আমার কাছে মনে হয়েছিল তার ভালো সুযোগ আছে। ১৫ বছর বয়সে সে প্রথম সিনিয়রদের অনুশীলনে আসে। যেখানে নিয়মিত আন্তর্জাতিক ফুটবল খেলা এবং বিশ্বকাপজয়ী খেলোয়াড়রাও ছিল। তবে তাতে একটুও অসুবিধা হয়নি তার। সে নিজে নিজেই সবকিছু করত, আমাকে কিছু বলতে হত না। তার ব্যাপারে এটাও একটা বিশেষ দিক।”

    এমএলএসে ডেভিস নিয়মিত খেলা শুরু করার পরই তাকে ৩ সপ্তাহের জন্য ক্যারিংটনের অনুশীলনের আমন্ত্রণ জানায় ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড। তবে ডেভিস তখনও ‘তৈরি’ নয় জানিয়ে ইউনাইটেডের প্রস্তাব ফিরিয়ে দেয় ভ্যাঙ্কুভার। এমএলএসে তার প্রতিভার খবর ততোদিনে জানাজানি হয়ে এছে ইউরোপেও। ইউনাইটেড ছাড়াও আরও বেশ কিছু ক্লাবের কাছ থেকেও প্রস্তাব পেয়ে যান ডেভিস। এর ভেতর বায়ার্নের প্রস্তাবটাই মনে ধরেছিল তার এজেন্ট হুসেহর, “আমি দুয়েকটি ক্লাবের সঙ্গে কথা বলছিলাম। তবে বায়ার্নের লোকদের সঙ্গে কথা বলে বুঝতে পারি, এটাই আলফনসোর জন্য সেরা গন্তব্য হবে।”

    “আমার কাছে এমন কিছু প্রস্তাব ছিল, যেগুলো যে কেউই গ্রহণ করত। তবে আমি দেখলাম বায়ার্নের স্কোয়াড বেশ ছোট। ফ্র্যাঙ্ক রিবেরি আর আরিয়েন রবেনও অবসর নেওয়ার পথে ছিল। তাই বায়ার্নই আমার কাছে আলফনসোর জন্য ভালো হবে মনে হয়েছিল। একটি ইংলিশ ক্লাব আমাকে প্রস্তাব পাঠিয়েছিল, আমি তাদের পরিকল্পনার কথা জানতে চেয়েছিলাম। তারা বলেছিল ডেভিসকে ক্লাবে দ্বিতীয় দলের সঙ্গে যুক্ত করবে অথবা তাকে ধারে খেলতে পাঠিয়ে দেবে। কারণ তারা ডেভিস ইংল্যান্ডে ওয়ার্ক পারমিট পাবে নাকি সেই ব্যাপারে নিশ্চিত ছিল না।”

    মূলত ডেভিসকে নিয়ে বায়ার্নের পরিষ্কার পরিকল্পনার বিষয়টিই হুসেহকে জার্মান ক্লাবটির সঙ্গে চুক্তি করতে উদ্বুদ্ধ করেছিল, “কিন্তু বায়ার্নের সঙ্গে শুধু একটি ফোনকলে আলোচনা হয়নি। তারা ডেভিসকে নিয়ে তাদের পরিকল্পনা জানাতে পাওয়ার পয়েন্ট প্রেজেন্টেশন তৈরি করেছিল। প্রধান স্কাউট মার্কো নেপ্পে এবং স্পোর্টিং ডিরেক্টর হাসান সালিহামিদজিচ মিলে সেটি আমাদের দেখিয়েছিলেন। তারা দেখিয়েছিল মাঠের কোন জায়গায় ডেভিস খেলবে। এছাড়া তাদের ছোট স্কোয়াডের ব্যাপারেও জানায় তারা। বছরে বায়ার্ন কমবেশি ৫০টি ম্যাচ খেলে, আর দলের সব খেলোয়াড়ই কমপক্ষে ৮০ ভাগ ম্যাচ খেলে বলেও জানিয়েছিল তারা।”

    আর এখানেই ডেভিসকে দলে টানার দৌড়ে বায়ার্নের কাছে হেরে যায় ইউনাইটেড। “যখন হোসে মরিনহো সেখানে (ওল্ড ট্রাফোর্ড) ছিলেন, তিনি তাকে দলে চেয়েছিলেন। তবে সেটা আর হয়নি। তারা শুধু অপেক্ষাই করে গিয়েছে। আর আমার মনে হয় না তাদের বায়ার্নের মতো একই ধরনের দূরদর্শিতা এবং আস্থা ছিল।”

    ২০১৯ সালের জানুয়ারিতে বায়ার্নে আসার পর ক্লাবে প্রথম আধা মৌসুমে বুন্দেসলিগায় মাত্র ৭৪ মিনিট খেলার সুযোগ পেয়েছিলেন ডেভিস। এমএলএসে নিয়মিত খেলে আসা ডেভিসের জন্য সময়টা কঠিন ছিল। তবে হুসেহ তখন তাকে ধৈর্য্য ধরতে বলেন এবং বায়ার্নে থাকতে উদ্বুদ্ধ করেন। আর সেই কঠিন সময়ের পর বায়ার্নে তার সুসময় এসেছে। ২০১৯-২০ মৌসুমের শুরুর দিকে বায়ার্নের দুই ডিফেন্ডার নিকলাস সুলে এবং লুকাস হার্নান্দেজ চোট কপাল খুলে দেয় ডেভিসের। ডেভিড আলাবা তখন বনে যান সেন্টারব্যাক, ডেভিসের সহজাত পজিশনটি ফাঁকা হয়ে যায়। গতি আর শারীরিক সক্ষমতার মাধ্যমে সেই জায়গাটিকে নিজের করে নেওয়াটাই ছিল তার সামনে মূল চ্যালেঞ্জ।

    বায়ার্নের সাবেক কোচ নিকো কোভাচ তাকে প্রথম লেফটব্যাক পজিশনেই নিয়মিত সুযোগ করে দিয়েছিলেন। কোভাচ চলে যাওয়ার পর তার উত্তরসূরি হানসি ফ্লিকও ডেভিসের ওপর আস্থা রাখেন। ডেভিস ফ্লিকের অধীনে খেলেছেন প্রায় সবগুলো ম্যাচ। আর নিয়মিত খেলার ফলে দলের গতি ও খেলার ধরনের সঙ্গে মানিয়ে নিতে পেরেছেন তিনি, সাথে আত্মবিশ্বাসও বেড়েছে। আর সেসবের ফলই দেখা গেছে চেলসি এবং বার্সেলোনার মতো ইউরোপিয়ান জায়ান্টদের বিপক্ষে তার নির্ভীক পদচারণায়।

     


    স্ট্যামফোর্ড চেলসির বিপক্ষে মার্চে তার অসাধারণ পারফরম্যান্সের পর তার জন্য ইউরোপের অন্য বড় ক্লাবগুলোর আনাগোনা শুরু হতে পারে বলে বুঝতে পেরেছিল বায়ার্ন। নতুন চুক্তির প্রস্তাবও পেয়ে যান তখন ডেভিস। আপাতত ২০২৫ সাল পর্যন্ত জার্মান ক্লাবের সঙ্গে থাকার কথা তার। অ্যালিয়াঞ্জ অ্যারেনায় তার এত ডেভিসের উথান হয়েছে চোখের পলকে। এতো দ্রুত সবকিছু বদলে যাবে সেটা আঁচ করতে পারেননি হুসেহও, “এতটা দ্রুততার সঙ্গে এত কিছু হবে সেটা আশা করিনি। আমি জার্মান পত্রিকায় পড়েছি, বায়ার্নে নাকি এটাই সালিহামিদজিচের (বায়ার্নের স্পোর্টিং ডিরেক্টর) সেরা সাইনিং। ছোটবেলা থেকে ডেভিসকে কোচিং করিয়েছি। এখন মাঠ এবং মাঠের বাইরে তাকে সাহায্য করে যাচ্ছি, এটা আমার জন্য অন্য যেকোনো কিছুর চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ।”

    চেলসির বিপক্ষে তার পারফরম্যান্সের পর সাবেক বায়ার্ন ও জার্মান কিংবদন্তি এবং বর্তমানে ক্লাবের বোর্ড সদস্য অলিভার কান ডেভিসের প্রশংসা করেছেন, “সে অনেক প্রতিভাবান খেলোয়াড়, দলে তার উপস্থিতি অনেক কার্যকর। আমি নিশ্চিত আমরা আরও অনেকদিন তার খেলা উপভোগ করতে পারব।” কয়েকদিন আগেই শৈশবের আদর্শ লিওনেল মেসির বিপক্ষে খেলেছেন এবং দোর্দণ্ড প্রতাপে জিতেছেনও। একসময় শরণার্থী হিসেবে ক্যাম্পে দিন কাটানো ডেভিস এখন জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক শুভেচ্ছাদূত হতে যাচ্ছেন। 

    তবে এত প্রশংসা আর প্রাপ্তিকে মোটেও বড় করে দেখেন না ডেভিস, “আমার বাবা-মা যা করেছে সেজন্য আমি তাদের প্রতি কৃতজ্ঞ। বছরের পর বছর তারা আমাদের পরিবারকে একটি নিরাপদ পরিবেশ এবং নিরাপদ দেশে নিয়ে আসতে চেষ্টা করেছে। আর তারা সেটা করতে পেরেছে বলে আমি অনেক খুশি। আপনি যখন একদম নিচ থেকে উঠে আসবেন, আর কিছু অর্জনের পথে ধাবিত হবেন, তখন আপনার নম্র মানসিকতাটা ধরে রাখতে হবে।”