• ক্রিকেট, অন্যান্য
  • " />

     

    ছবি কথা কয় : সময়ের আপেক্ষিকতায় শুরু কিংবা শেষ

    ছবি কথা কয় : সময়ের আপেক্ষিকতায় শুরু কিংবা শেষ    

    ছবিতে মুহুর্ত থমকে দাঁড়ায় বা বন্দী হয়ে থাকে। ছবি মানে গল্প। ছবি সে গল্পের অনেক কিছু বলে, অনেক কিছু বলে না। তবে সে ছবির সঙ্গে জড়িয়ে যায় সেসব গল্প। আমাদের নতুন সিরিজে ছবি নিয়ে গল্প বলার চেষ্টা করেছি আমরা, হয়ত সে গল্প এ ছবিতে আছে, কিংবা নেই। অথবা স্রেফ আমরা দেখি না।


    সে এক দীর্ঘ রাত। 

    আপনি জানেন, সর্বোচ্চ হয়তো ঘন্টাখানেকের ব্যাপার। যা হওয়ার, এর মাঝেই হবে। এমন কিছু হতে পারে, যা আগে কখনো হয়নি। অথবা এমন কিছু হতে পারে, বাংলাদেশ যা চায়নি, আগেও না, এখনও না। অথচ সে জন্য অপেক্ষা করতে হবে পুরো একটা রাত। 

    প্রায় ১৪ মাস পর টেস্ট খেলছে বাংলাদেশ, কোভিড বা এ ধরনের কোনো ঘটনা ছাড়াই। নিজেদের ৯৪তম টেস্ট, ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ৯ম। এর আগে ৭টি টেস্ট জিতেছে বাংলাদেশ। কিন্তু সেসব জিম্বাবুয়ে (সত্যি বলতে, সে জিম্বাবুয়ে যে সেই জিম্বাবুয়ে নয়, সেটা তো সবাই জানেন, জিম্বাবুয়ে নিজেরাও জানে) ও ফ্লয়েড রেইফারের নেতৃত্বাধীন ‘জোড়া-তালির’ ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে। 

    টেস্ট জিততে ২০টি উইকেট নিতেই হবে আপনাকে, এর কোনো বিকল্প নেই। কিন্তু ২০ উইকেট নিলেই আপনি টেস্ট জিতবেন না। কথাটা উচ্চতর গণিতের অন্বয়-ফাংশন কিংবা রসায়নের ক্ষার-ক্ষারকের মতো। এর আগে ৮ বার প্রতিপক্ষের ২০ উইকেট নিয়ে বাংলাদেশ জিতেছে ৭ বার, ড্র হয়েছে একবার। তবে সেগুলির একটিও শীর্ষ ছয় দলের বিপক্ষে নয়। 

    ইংল্যান্ডকে প্রথমবারের মতো দুইবার অল-আউট করেছে ৯ম বারের দেখায়। এর আগে ৮ বারই বাংলাদেশ হেরেছে, ওপরের পরিসংখ্যানে এটি পরিস্কার। সেই দীর্ঘ রাতটা পেরিয়ে চট্টগ্রামের জহুর আহমেদ চৌধুরি স্টেডিয়ামে যখন সাব্বির রহমান ও তাইজুল ইসলাম আবারও ব্যাটিং করতে নামবেন, তখন বাংলাদেশের প্রয়োজন পড়বে ৩৩টি রান। ইংল্যান্ডের ২টি উইকেট। ৩৩, ২-- প্রথম সংখ্যাটার সাথে নতুন কিছু জড়িত, পরেরটি ঘটলে চট্টগ্রাম হয়ে যাবে ‘এ যুগের ফতুল্লা, কিংবা আগের চট্টগ্রাম, অথবা মুলতান’। 

    ২০১৬ সালের ২৩ অক্টোবরের রাতটা দীর্ঘ না হয়ে পারে না।  

    ****

    দীর্ঘ মানেই যে এককের হিসেবে অনেক হতে হবে, তা নয়। আপেক্ষিকতা বলে তো একটা ব্যাপার আছে। কখনও ৭০-৮০ মিটারের পথটা শেষ হতে চায় না, কখনও কয়েক কিলোমিটারের পথ ফুরিয়ে আসে নিমিষেই। কোন পরিস্থিতিতে আছেন, নির্ভর করছে তার ওপর। 

    সাব্বিরের কাছে বোধহয় ১৯ অক্টোবর রাতটাও দীর্ঘ ছিল, ২৩ অক্টোবরের মতোই।  

    অভিষেক টেস্টের ‘চাঁদরাত’ তো দীর্ঘ মনে হতেই পারে-- রোমাঞ্চ, উত্তেজনা আরও কতোকিছু খেলা করছিল হয়ত তার সঙ্গে। চট্টগ্রামে নিজের প্রথম ইনিংসে আটে নেমে সাব্বির করেছিলেন ৩২ বলে ১৯। সঙ্গে বোলিং করেছিলেন ৩ ওভার। 


     
    অভিষেক টেস্টের চতুর্থ ইনিংসে প্রথম ফিফটি করা বাংলাদেশী ব্যাটসম্যান হয়ে গেছেন সাব্বির, সব মিলিয়ে ৯ম।


    ২য় ইনিংসে ২৮৬ রানের লক্ষ্যে বাংলাদেশ ৫ম উইকেট হারিয়েছিল ১৪০ রানে। মুশফিকুর রহিমের সঙ্গে তার জুটির সময় মনে হচ্ছিল, লক্ষ্যটার কলার চেপে ধরেছে বাংলাদেশ, এখন শুধু একটা হ্যাঁচকা টান দিয়ে নিয়ে আসার অপেক্ষা। সে কলার ফসকে গেল, গ্যারেথ ব্যাটির দারুণ এক ডেলিভারিতে মুশফিক ফিরলেন। বাংলাদেশ অধিনায়ক সাব্বিরকে ফেলে গেলেন ৮৭ রানের জুটির পর। 

    আরেক অভিষিক্ত মেহেদি হাসান মিরাজ ও কামরুল ইসলাম রাব্বিও বেশিক্ষণ থাকলেন না। ইংল্যান্ডের কাছে যে পথটা দীর্ঘ মনে হচ্ছিল, সেটিই হুট করে কমে এলো অনেকটা। সেদিনই ‘খেল খতম’ হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা উঁকি দিচ্ছিল। তাইজুল ইসলাম একরাশ স্বস্তি দিলেন সাব্বিরকে। তার আগেই অভিষেক টেস্টের চতুর্থ ইনিংসে প্রথম ফিফটি করা বাংলাদেশী ব্যাটসম্যান হয়ে গেছেন সাব্বির, সব মিলিয়ে ৯ম। 

    ৫.২ ওভার পার করলেন দুজন সেদিন। চট্টগ্রামে কমে আসা আলোয় শুধু স্পিনারদের দিয়ে বোলিং করানোর অপশনটা নিলেন না ইংল্যান্ড অধিনায়ক অ্যালেস্টার কুক, সামনে তাই থাকলো সেই দীর্ঘ রাত। 

    ****

    কুকের টেস্ট অধিনায়কত্বের অভিষেক বাংলাদেশের বিপক্ষে, ২০১০ সালের মার্চে। ‘শিক্ষানবীশ’ অধিনায়ক হিসেবে অ্যান্ড্রিউ স্ট্রাউসকে বিশ্রাম দিয়ে পাঠানো হয়েছিল তাকে। এরপর ২০১৬ সালে যখন আবার কুক এলেন, ততদিনে তিনি পাকাপাকি অধিনায়ক। 

    ২৪ অক্টোবর, টেস্টের পঞ্চম দিন সকালে কুক ওপেন করালেন স্টুয়ার্ট ব্রডকে দিয়েই, আগেরদিন লম্বা স্পেল করেছেন যিনি। দ্বিতীয় নতুন বল নেওয়ার সুযোগ থাকলেও নিলেন না, ভরসা রাখলেন রিভার্স সুইংয়ের ওপর, বেন স্টোকস যেটি পাচ্ছিলেন। 

    ৩২ বল খেলে ফেলা সাব্বির তখন তাইজুলের ওপর ভরসা রাখছিলেন, ব্রডের করা ৮১তম ওভারের শেষ বলে সিঙ্গেল নিয়ে স্ট্রাইক নিজের কাছে রাখলেন তাইজুল। দিনের চতুর্থ ওভার করতে এলেন স্টোকস। প্রথম বলটা আড়াআড়ি খেলতে গিয়ে মিস করলেন তাইজুল, বল তার প্যাডে ফ্লিক করে গেল পেছনে। আম্পায়ার কুমার ধর্মসেনার নট-আউটের সিদ্ধান্তটা রিভিউ করলো ইংল্যান্ড, স্টোকসের জোরাজুরির কারণেই বলতে গেলে। 

    এমনিতে ইংল্যান্ডের রিভিউ ছিল না, তবে ৮০ ওভার পেরিয়ে যাওয়াতে তখনকার নিয়মে দুটি নতুন রিভিউ পেয়েছিল তারা। যে রিভিউটা জুয়া বলে মনে হচ্ছিল, কাজে লেগে গেল সেটিই। তাইজুল ফিরলেন। সে মাসেই ডিআরএসের নিয়ম বদলে গিয়েছিল। আগে এলবিডব্লিউর ক্ষেত্রে আম্পায়ারের সিদ্ধান্ত বদলাতে হলে বলের অর্ধেকের বেশি অংশ লাগতে হতো অফস্টাম্পের অর্ধেক থেকে লেগস্টাম্পের অর্ধেকের মাঝের অংশে। নতুন নিয়মে সে পরিধি বেড়ে অফস্টাম্পের শেষ থেকে লেগস্টাম্পের শেষ পর্যন্ত হয়েছিল। আগের নিয়ম থাকলে তাইজুল আউট হতেন না। 

    শেষ ব্যাটসম্যান শফিউল ইসলাম এসে প্রথম বলটা ফ্লিক করতে গিয়ে মিস করে গেলেন। পরের বলটা পা বাড়িয়ে খেলতে গিয়ে মিস করলেন, এবার ধর্মসেনা আউট দিলেন। শফিউল রিভিউ করলেন, সেটি র‍্যালি করে আম্পায়ারকে জানালেন সাব্বির। চট্টগ্রাম টেস্টে সেটি ২৬তম রিভিউ। 

    ধর্মসেনার মতে, শফিউল শট অফার করেননি। ফলে ইমপ্যাক্ট বাইরে থাকলেও সেটিতে কিছু যায় আসবে না। 

    ****

    ডিআরএসের সে সংক্ষিপ্ত সময়টা তখন আপেক্ষিকতায় দীর্ঘ। 

    সাব্বির ব্যাটের ওপর ভর দিয়ে বসে পড়েছেন, পাশে দাঁড়িয়ে শফিউল, আর দ্বাদশ ব্যক্তি শুভাগত হোম। একপাশে ইংল্যান্ড, মাঝে ধর্মসেনা। সবার চোখ জায়ান্ট স্ক্রিনে। হক-আই ততক্ষণে দেখিয়ে দিয়েছে, শফিউলকে দেওয়া আউটের সিদ্ধান্ত বদলাচ্ছে না। ইংল্যান্ড মেতেছে উল্লাসে, ধর্মসেনা একটু পর আনুষ্ঠানিকতা সারবেন। 


    ©ফিলিপ ব্রাউন/গেটি ইমেজ


    ৪.৩ ওভার, খেল খতম। সাব্বির একপাশে দাঁড়িয়ে থাকলেন, এরপর বসে পড়লেন, তার কিছু করার থাকলো না। ধর্মসেনা বেলস ফেলে দিয়ে একটা স্টাম্প উপড়ে ফেললেন, ম্যাচ শেষের সঙ্কেত জানাতে। ইংল্যান্ড উল্লাস শেষ করলো। সাব্বির উঠলেন না। মাটিতে ঠেস দিয়ে রাখা ব্যাটটা নিয়ে এবার ঠেকালেন হেলমেটে, সব ভার যেন চালান করে দিতে চাচ্ছিলেন মাটিতে। ৬৪ রানে অপরাজিত তিনি, তবে তার আর কিছু করার নেই।

    স্টুয়ার্ট ব্রড দুহাতে পিঠ চাপড়ে দিয়ে গেলেন। অ্যালেস্টার কুক এসে সান্ত্বনা দিলেন। সাব্বির উঠলেন না। জো রুট এলেন। হাতটা মাথায় রাখলেন, এরপর বসে পড়লেন তিনিও। সাব্বিরের মাথা নীচু, রুট তাকে কিছু বলছেন-- দারুণ ম্যাচ, এটিই জীবনের শেষ নয়, অসাধারণ খেলেছেন-- এমন কিছু, অথবা অন্য কিছু হবে হয়তো। 

    তবে সাব্বিরের কানে কিছু ঢুকছিল কিনা, নিশ্চিত নয়। ততক্ষণে হয়তো অনুভূতিশূন্য হয়ে গেছেন তিনি। খানিকবাদে হাত মেলাতে মেলাতে কুক আরও কিছু বললেন তাকে।

    ****

    সাব্বিরকে আলাদা করা যাচ্ছে না। 

    গোল হয়ে দাঁড়িয়ে উল্লাসে মেতেছেন বাংলাদেশের ক্রিকেটাররা, মিরপুরে ইতিহাস গড়েছেন তারা। চট্টগ্রাম থেকে মিরপুর, তিন দিন পর শুরু হওয়া দ্বিতীয় টেস্টে ইংল্যান্ডকে হারিয়ে দিয়েছে বাংলাদেশ। 

    এবার স্টিভেন ফিনকে এলবিডব্লিউ দিলেন ধর্মসেনা, ইংল্যান্ডের রিভিউ ছিল না। ৯ম টেস্টে ২২ রানের ব্যবধানে আটকে যাওয়া বাংলাদেশ ১০ম টেস্টে জয়ে পেয়েছে ১০৮ রানে। 

    চট্টগ্রামে হতাশায় নুয়ে পড়া সাব্বিরকে রুটের সান্ত্বনা দেওয়ার ছবিটা যেন মুলতানে পাকিস্তান, ফতুল্লায় অস্ট্রেলিয়া বা চট্টগ্রামে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে আশা জুগিয়েই হারার সময়ের আরেকটি রূপ হয়ে এলো।শীর্ষপর্যায়ের পূর্ণশক্তির দলের বিপক্ষে টেস্ট জয়ের অপেক্ষা যখন দীর্ঘায়িত হয়েছিল আরেকটু। 

    মিরপুরে ইংল্যান্ডকে হারানোর পর বাংলাদেশ শ্রীলঙ্কা, অস্ট্রেলিয়া, ওয়েস্ট ইন্ডিজকেও হারিয়েছে। সাব্বির আর রুটের ছবিটা তাই শুধুই স্পিরিট অফ ক্রিকেটের হয়ে থাকলো না আর, সেটি হয়ে গেল একটা সময়ের শেষ, অথবা অন্য আরেকটা সময়ের শুরুরও প্রতিক।


    ছবি কথা কয়- 'শচীন হু?'

    ওয়ার্ন, কেপি, হ্যাম্পশায়ার ও স্লিপ-কর্ডন