• ফুটবল, অন্যান্য
  • " />

     

    ডিয়েগো, আপনি এবার বিশ্রাম নিন...

    ডিয়েগো, আপনি এবার বিশ্রাম নিন...    

    ডিয়েগো ম্যারাডোনার মুখে কথা আটকাত না। ঠোঁটকাটা স্বভাব যাকে বলে। পোপ জন পলের আমন্ত্রণে ভ্যাটিকান সিটিতে গিয়েছিলেন একবার ম্যারাডোনা। সে গল্প পরে নিজের মুখেই বলেছিলেন তিনি, “ভ্যাটিকানে গিয়ে দেখলাম সোনায় মোড়ানো ছাদ, এরপর পোপ বললেন গীর্জা কর্তৃপক্ষ নাকি অনাহারী শিশুদের ভবিষ্যত নিয়ে চিন্তিত! আমি বললাম, ছাদটা বিক্রি করে দিন না। কিছু একটা তো করুন!”

    সর্বোচ্চ ধর্মগুরুর সামনে গিয়েও ম্যারাডোনা ছিলেন ম্যারাডোনার মতোই। উদ্দীপনায় ম্যারাডোনার রক্ত টবগগে থাকত সবসময়, স্বভাবে তিনি ছিলেন বিদ্রোহী। সাম্রাজ্যবাদ তার দুই চোখের বিষ, দক্ষিণ আমেরিকার বিশ্বায়ন চেয়েছিলেন তিনি। ফুটবলারের বাইরে আরও পরিচয় ছিল তার। ফিদেল কাস্ত্রোর বন্ধু ছিলেন তিনি। ম্যারাডোনার হাতে স্বদেশী চে গেভেরার উলকিও আছে। ম্যারাডোনা সত্যিকার অর্থে ছিলেন বিদ্রোহী।

    কী সহজে ‘অতীত কালে’ লেখা হয়ে গেল কথাগুলো। ছিলেন, বলতেন, করতেন…

    ম্যারাডোনাকে নিয়ে শঙ্কা ছিল সবসময়। ম্যারাডোনা এর আগেও মৃত্যুকে ফাঁকি দিয়েছেন। আপনি যতবার ভেবেছেন এই বুঝি শেষ, ম্যারাডোনা ফিরে এসে আপনাকে চমকে দিয়েছেন। দুটো বাড়তি কথা বলে কখনও আপনার হাস্যরস বাড়িয়েছেন, কখনও বা বিরক্তি ধরিয়েছেন। নভেম্বর মাসের শুরুর দিকেও একবার মৃত্যু ফাঁকি দিয়ে এসেছিলেন ম্যারাডোনা। এরপর আপনি এমন কিছুর জন্য প্রস্তুত ছিলেন না। মৃত্যুর জন্য কেউ প্রস্তুত থাকে না। ম্যারাডোনা চলে গেছেন, মুহুর্তেই অতীত হয়ে গেছেন। অমোঘ সত্যের কাছে ম্যারাডোনা হার মেনেছেন। এবারও আপনাকে চমকেই দিয়েছেন তিনি। ম্যারাডোনার চলে যাওয়া আপনাকে মনে করিয়ে দিয়েছে, কিংবদন্তীদের ভালোটা মনে রাখে লোকে। অন্যপুরীর হিসেব অবশ্য অজানাই। কিন্তু এই পুরীতে ম্যারাডোনা বেঁচে গেছেন, আরও কোটি কোটি মানুষকে বাঁচার প্রেরণা যুগিয়ে গেছেন।



    ম্যারাডোনা আপনাকে আর চমকে দেবেন না। একদল সাংবাদিকের কাজই ছিল ম্যারাডোনার সঙ্গে আঠার মতো লেগে থাকা। ম্যারাডোনাও সেটা উপভোগ করতেন। ম্যারাডোনা হাল আমলের ইনস্টাগ্রাম ইনফ্লুয়েনসারদের মতো আলোচনায় থাকতে ভালোবাসতেন। ম্যারাডোনা জানতেন, এই তার নিয়তি। বহু আগেই এসব মেনে নিয়েছিলেন তিনি।

    ম্যারাডোনার জীবনে ফুরসত মেলেনি এতোটুকুও। এক মানুষ দুই সাংঘর্ষিক চরিত্র নিয়ে ঘুরেছেন। এক সত্ত্বার নাম ডিয়েগো। অন্য সত্ত্বা তার ম্যারাডোনা। আপনি যাকে চেনেন সেটা ম্যারাডোনা। যেটা সহজে দেখতে পান না সে এক ছোকড়া, তার নাম ডিয়েগো। তার বসত বুয়েনস আইরেসের ভিলা ফুয়েরিতো বারিহো বস্তিতে। তার বিদ্রোহের শুরু যেখান থেকে, শেকড় যেখানে। ওই জায়গা অস্বীকার করলে ডিয়েগোও হয় না, ম্যারাডোনাও হয় না।

    বস্তিরও ধরন থাকে। বুয়েনস আইরেসের সবচেয়ে ‘নিকৃষ্ট’ বস্তিটাই কপালে জুটেছিল ম্যারাডোনার। পাকা রাস্তা নেই, বিশুদ্ধ পানির সরবারহ নেই, নেই কোনো শৌচাগারও। ওই বস্তিতে চার মেয়ের পর পঞ্চম সন্তানের জন্ম ডন ডিয়েগো সিনিয়রের ঘরে। তার নাম ডিয়েগো ম্যারাডোনা। অভাবের  সংসারে ম্যারাডোনার বাবা বাড়ি ছাড়তেন সূর্য ওঠারও আগে। আর ফিরতেন রাত করে। ক্লান্ত শরীরে বাড়ি ফিরতেন শুধু ঘুমুতে। বাবার সঙ্গে ম্যারাডোনার সখ্যতা আর গড়ে ওঠেনি তাই। ম্যারাডোনা ছিলেন মায়ের ছেলে।

    অমন জায়গায় বাঁচতে হলে অবলম্বন দরকার হয়। ম্যারাডোনার সেই অবলম্বন ছিল এক চর্মগোলক, নাম তার ফুটবল। ম্যারাডোনা বল নিয়েই থাকতেন, একা একাই খেলতেন। বস্তির বাকি ছেলেরাও ফুটবল খেলত, কিন্তু তাদের খেলার ধরন ম্যারাডোনার মনে ধরত না। ম্যারাডোনা তখন থেকেই ঠোঁটকাটা। নিজের অপছন্দ লুকিয়েও রাখতেন না। বাকিদের সঙ্গেও তাই গভীর বন্ধুত্ব হয়নি কখনও ম্যারাডোনার। ঠোঁটকাটা লোকের বন্ধুর চেয়ে শত্রু থাকে বেশি।

    জীবন কী, সেটা ম্যারাডোনা শিখেছিলেন ওই বস্তিতে। সবকিছুর বিনিময়ে বস্তি থেকে মুক্তি চেয়েছিলেন তিনি। ফুটবলকে পেশা হিসেবে নেওয়ার সময়ও তার লক্ষ্য ছিল সেটিই। মাত্র ১৫ বছর বয়সে আর্জেন্টিনোস জুনিয়র্সের সঙ্গে প্রথম পেশাদার চুক্তির পর ম্যারাডোনা বুঝে নিয়েছিলেন একটি ফ্ল্যাট। ক্লাবের কাছ থেকে পাওয়া ফ্ল্যাটে পুরো পরিবার নিয়ে উঠেছিলেন। ম্যারাডোনা তখন আকাশের চাঁদ হাতে পেয়েছেন। ৭ ভাইবোন আর বাবা-মাকে মাথার ওপর ছাদ দিতে পেরেছেন, তার যেন আর কিছুই চাওয়ার নেই!

    ম্যারাডোনার দায়িত্ব সেখানেই শেষ হতে পারত, ডিয়েগোতে ফেরত যেতে পারতেন তিনি। কিন্তু মেধা তো লুকিয়ে রাখা যায় না। ম্যারাডোনাও তরতর করে উঠতে থাকলেন স্বপ্নের সিঁড়ি ভেঙে ওপরের দিকে। ডিয়েগো সত্ত্বাটাকে আড়াল করেই। ম্যারাডোনা না হলে তো বস্তিতেই থাকতে হত, সেই ম্যারাডোনা সত্ত্বা এখন চাইলেও আর বিসর্জন দেওয়া যায় না। ডিয়েগো থেকে ম্যারাডোনা র্রূপান্তর চলতে থাকল। বোকা জুনিয়র্স হয়ে বিশ্ব রেকর্ড ফি তে বার্সেলোনায় পাড়ি জমালেন ম্যারাডোনা।

    বিশ্বের সবচেয়ে দামী ফুটবলারের ট্যাগ গায়ে সাটলে আপনার ব্যক্তি জীবন বলে আর কিছু থাকবে না। ম্যারাডোনারও ছিল না। বার্সেলোনার দুইটি বছরও ভালো যায়নি তার। শান্তি না থাকলে কিছু থাকে না। বার্সেলোনায় শান্তিই ছিল না ম্যারাডোনার। চোট সমস্যার পর বিলবাওয়ের ঘটনা ম্যারাডোনার বার্সেলোনার ক্যারিয়ারের সমাপ্তি ঘন্টা বাজিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু ম্যারাডোনার কদর কমেনি তখনও। চাইলেই ইউরোপের বড় ক্লাবগুলোয় যেতে পারতেন। ইতালি তখন নামকরা ফুটবলারদের আখড়া। ম্যারাডোনা সেখানেই গেলেন। কিন্তু দুই মিলান, জুভেন্টাসে না গিয়ে ম্যারাডোনা গেলেন অখ্যাত নেপলসে। যে শহরের ক্লাব নাপোলির অর্জন মোটে দুইবার দুইটি কাপ শিরোপা জয়। ম্যারাডোনার নামের সঙ্গে বড্ড বেমানান। নাপোলি তার জন্য আরেকবার বিশ্বরেকর্ড গড়েছিল। কিন্তু ম্যারাডোনা আসলে নেপলসে গিয়েছিলেন শান্তি খুঁজতে।

    নাপোলিতে কী চান আপনি? সাংবাদিকের প্রথম প্রশ্নের পর ম্যারাডোনার জবাব, “আমি চাই একটু শান্তি। বার্সেলোনায় আমি সুখ খুঁজে পাইনি। একটু শান্তি দরকার।”

    ম্যারাডোনা নাপোলির কাছে চেয়েছিলেন একটি বাড়ি, পেয়েছিলেন বাসা, চেয়েছিলেন ফেরারি, পেয়েছিলেন ফিয়াত। এরপরও নাপোলিতে সুখে ছিলেন ম্যারাডোনা। যে শান্তির খোঁজে তিনি এসেছিলেন সেটা পেয়েছিলেন নেপলসে। ম্যারাডোনার মতো মানুষদের বোধ হয় প্রতিষ্ঠিত জায়গায় সুখ জোটে না। নিচের সারির কোনো ক্লাবকে চ্যাম্পিয়ন করার মাহাত্ম্য যতোখানি টানে, বড় ক্লাবের শিরোপা বোধ হয় ততোখানি তৃপ্তি দিতে পারে না। নাপোলিতে ম্যারাডোনা বোধ হয় সে কারণেই সুখ খুঁজে পেয়েছিলেন।

    ছিয়াশির বিশ্বকাপে ম্যারাডোনা মেক্সিকো গিয়েছিলেন মাথার ওপর এক দুশ্চিন্তা নিয়ে। ম্যারাডোনা ভালোবাসতে জানতেন। ক্লদিয়ার সঙ্গে সুখের সময়ই কাটছিল তার। কিন্তু ডিয়েগো তো ভুলে ভরা মানুষ। ডিয়েগো ফেরেশতা নন। নেপলসের সুন্দরী রমনীদের সঙ্গে সময় কাটানোর লোভ ডিয়েগো সামলাতে পারেন না। অন্য এক নারীর গর্ভে ম্যারাডোনার সন্তান- এই খবর জেনে মেক্সিকো গিয়েছিলেন ম্যারাডোনা বিশ্বকাপ খেলতে।

    ম্যারাডোনা বিশ্বকাপ জিতে নন্দিত হলেন, নিন্দিত হলেন হ্যান্ড অফ গড গোলের কারণে। ইংলিশ মিডিয়া এখনও ম্যারাডোনা বলতে হ্যান্ড অফ গডকেই বোঝে। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে কোয়ার্টার ফাইনালের হাত দিয়ে করা গোলটি ম্যারাডোনার, আর গোল অফ দ্য সেঞ্চুরি ডিয়েগোর। অমন বিশুদ্ধতম গোল ফুটবল আর দেখেনি। বিশ্বকাপ জিতে ইতালিতে ফিরতে সেই ঘটনা নিয়ে আবারও অস্বস্তিতে ম্যারাডোনা। তখন বান্ধবীর কাছে কেঁদে-কেটে অস্বীকার করেছেন নিজের কৃতকর্ম। কিন্তু ম্যারাডোনা ভালো করেই জানেন জন্ম নেওয়া সে ছেলে তার নিজেরই। ডিয়েগো যা খুশি তাই করতে পারে, কিন্তু ম্যারাডোনা ভুল করতে পারেন না! বান্ধবীর সামনেও সেই থেকে ডিয়েগো হয়ে গেলেন ম্যারাডোনা। সে সম্পর্ক টিকে ছিল বহুদিন, কিন্তু পরিণত আর সুখের হয়নি। ম্যারাডোনার কোনো সমাপ্তিই সুখের হয়নি।


    ম্যারাডোনা ততোদিনে মাদকাসক্ত হয়ে পড়েছেন। নাপোলির গডফাদারের সঙ্গে উঠ-বস তার। সপ্তাহান্তে ফুটবল খেলেন। আর বাকি দিনগুলো মজে থাকেন পার্টিতে। প্রত্যাশার চাপ ফাঁকি দেওয়ার ওই একটা উপায়ই জানা ছিল ম্যারাডোনার। কোকেন, পার্টি আর নারী।

    ম্যারাডোনা অখ্যাত নাপোলিকে লিগ জিতিয়েছিলেন দুইবার। ইউয়েফা কাপও জিতিয়েছিলেন। ক্যারিয়ারে একটানা সবচেয়ে বেশি খেলেছেন নাপোলিতে। ওই শহরে যীশুর চেয়েও ম্যারাডোনার ছবি বেশি আছে বলে একটা বচন চালু আছে। ম্যারাডোনা নাপোলি ছেড়ে গিয়েছিলেন একরকম রাতের অন্ধকারে পালিয়ে, ট্যাক্স ফাঁকির মামলার হাত থেকে বাঁচতে। ম্যারাডোনা ওই শহরে সুখ খুঁজে পেয়েছিলেন, কিন্তু সেই শহরেই আর ফেরা হয় না ম্যারাডোনার। এখনও নাপোলির রাস্তায় প্রতিদিন নতুন করে ম্যারাডোনার ম্যুরাল আঁকা হয়। শুধু মানুষ ম্যারাডোনাটাই ফিরতে পারেন না। আর কোনোদিন পারবেনও না।

    ফুটবল ছাড়ার পরও সুখ জোটেনি ম্যারাডোনার কপালে। নানান কারণে নিয়মিত শিরোনাম হয়েছেন। মাদকাসক্তি থেকে আসলে কখনই আর বের হওয়া হয়নি তার। ব্যস্ততাকে ফাঁকি দিয়ে কয়েক মুহুর্ত হারিয়ে যেতে চেয়েছিলেন, এরপর অভ্যাসে পরিণত হয়ে গেছে সেটা। ম্যারাডোনা যে মাত্র ৬০ বছর বয়সেই চলে গেলেন, তার পেছন তার অনিয়ন্ত্রিত জীবনের দায়টাই তো বড়।

    এর মাঝেও ডিয়েগো হয়ে বেঁচে ছিলেন ম্যারাডোনা। বস্তির কথা কখনও ভোলেননি তিনি। ভোলেননি শেকড়ের কথা। ভ্যাটিকান সিটির সোনায় বাধানো ছাদ দেখে তাই অনাহারী শিশুর কথা মনে পড়ে তার। খাবার, পানি, বিদ্যুৎবিহীন জীর্ণ ঘরটার কথা মনে পড়ে। যেখান থেকে উঠে এসে বিশ্বকে ছুঁয়ে গিয়েছিলেন তিনি। তার বিদায় আরও একবার বিশ্বকে ছুঁয়ে গেল। তবে ম্যারাডোনা বোধ হয় কাঙ্খিত সেই ছুটি পেলেন। যে বিশ্রামটুকুর জন্য বুয়েনস আইরেস, বার্সেলোনা, নাপোলিতে হন্যে হয়ে ঘুরেছিলেন ডিয়েগো নামের ম্যারাডোনা- সেটা মিলল মরণে।

    ডিয়েগো, আপনি বিনোদন দিয়েছেন, বিনোদন পেয়েছেন। সঙ্কটে সঙ্কটে কাটিয়ে দিয়েছেন এক জীবন, অনেক হয়েছে, এবার একটু বিশ্রাম করুন। সে জন্যই তো এতো কিছু?