• লা লিগা
  • " />

     

    ক্ষুদে ব্লাঙ্কোদের দুনিয়া

    ক্ষুদে ব্লাঙ্কোদের দুনিয়া    

    বুত্রাগুয়েনো, রাউল, গুতি, ক্যাসিয়াস। কোনো মিল খুঁজে পাচ্ছেন এঁদের মধ্যে? এঁরা সবাই মাদ্রিদের একাডেমি ‘লা ফ্যাব্রিকা’ থেকে উঠে এসেছেন। সিনিয়র দলে নিজেদের প্রমাণ করে তাঁরা এখন ক্লাবের ইতিহাসে পাকাপাকি জায়গা করে নিয়েছেন। বুত্রাগুয়েনো, সাঞ্চিস, মিচেলদের আর রাউল, ক্যাসিয়াস, গুতিদের সময় দুটিকে বলা হয় রিয়ালের একাডেমির স্বর্ণযুগ। রিয়ালের ইতিহাসে এই দুই সময়ের মত এত প্রতিভাবান ও পারফরম্যান্সের জোরে মূল একাদশে জায়গা করে নেওয়া খেলোয়াড় আসে নি। এরপর মাঝে অনেক সময় কেটে গেছে। হেসে, কারভাহাল ছাড়া উল্লেখযোগ্য আর কেউই সিনিয়র দলে উঠে আসতে পারেনি। কিন্তু রিয়াল মাদ্রিদ কাস্তিয়ার বর্তমান দলের পারফরম্যান্স আর তাদের প্রতিভা রিয়াল সমর্থকদের মনে আশা জাগিয়েছে, আবার হবে তারুণ্যের জয়জয়কার; অন্য জায়গা থেকে কেনা তরুণ খেলোয়াড়দের নয়, নিজস্ব একাডেমির তরুণদের।

     

    রিয়ালের এই দলটির নাম কিন্তু আগে রিয়াল মাদ্রিদ কাস্তিয়া ছিল না। আগে স্প্যানিশ ফুটবল ফেডারেশনের নিয়ম অনুযায়ী সিনিয়র আর রিজার্ভ দলের নাম ভিন্ন থাকত না। এজন্য 'রিয়াল মাদ্রিদ দেপোর্তিভা', 'রিয়াল মাদ্রিদ বি' হয়ে ০৪-০৫ মৌসুমে দ্বিতীয় বিভাগে উন্নীত হওয়ার পর নাম পরিবর্তন হয়ে হয় রিয়াল মাদ্রিদ কাস্তিয়া আর আগের স্টেডিয়ামের নাম বদলে নাম রাখা হয় আলফ্রেডো ডি স্টেফানো স্টেডিয়াম।

     

    ১৩-১৪ সিজনটি ছিল রিয়ালের জন্য মিশ্র অনুভূতির। একদিকে রিয়াল মাদ্রিদ সিনিয়র দল তাদের সোনার হরিণ ‘লা ডেসিমা’ জিতলো অবশেষে, আর অন্যদিকে কাস্তিয়ার অবনমন ঘটলো তৃতীয় ডিভিশনে! ১৪-১৫ সিজনে রিয়ালের মূল দলের অ্যাসিস্ট্যান্ট কোচের দায়িত্ব ছেড়ে কাস্তিয়ার দায়িত্ব গ্রহণ করেন জিদান। অতঃপর তাঁর হাত ধরেই শুরু হয় কাস্তিয়ার নবযুগের সূচনা।

     

    কাস্তিয়ার বর্তমান দলের অধিকাংশেরই  এই দলে অভিষেক হয়েছে জিদানের হাত ধরে। গোলকিপার রুবেন, আবাদ; ডিফেন্ডার তেহেরো, লিয়েনহার্ট, আবনার, হাইমে; মিডফিল্ডার তোররো, ইয়োরেন্তে, মুনোজ, ফেবাস ও জিদানের নিজের ছেলে এনজো; ফরোয়ার্ড লাইনে লাজো, মারিয়ানো, মায়োরাল এবং বিশ্বের বড় বড় ক্লাবগুলোর সাথে রীতিমত যুদ্ধ করে সাইন করানো নরউইজিয়ান বিস্ময়বালক মার্টিন ওদেগার্ডকে নিয়ে কাস্তিয়ার দলটিকে আমূল বদলে ফেলেন তিনি। জিদানের সঠিক দিকনির্দেশনায় দ্রুত ভাল ফলাফলও পেতে থাকে তারা। এক মৌসুম পরেই দ্বিতীয় বিভাগে ফেরত আসে কাস্তিয়া। জিদানের পর রামিস কোচ হয়ে আসলেও এখনো তারা ৪-২-৩-১ ফরমেশনে খেলা অব্যাহত রেখেছে। গোলকিপার রুবেন এখন প্রায় প্রতি ম্যাচেই সিনিয়র দলের ম্যাচ-ডে স্কোয়াডে থাকার ফলে আলফনসো হেরেরো খেলেন কিপার হিসেবে। ডিফেন্সে থাকেন তেহেরো, লিয়েনহার্ট, রেগুইলন, আবনার।

     

    লিয়েনহার্টদের ঠিক সামনে ডিফেন্সিভ মিড হিসেবে খেলেন মাদ্রিদ লেজেন্ড পাকো গেন্তোর ভাতিজা মার্কোস ইয়োরেন্তে, অ্যালেক্স ফেবাস অথবা এনজো জিদান। এনজোকে ক্ষেত্রবিশেষে ‘নাম্বার টেন’ রোলেও খেলতে দেখা যায়। উইং-এ আছেন ওদেগার্ড, লাজো। আর বোরহা মায়োরাল এখন সিনিয়র দলের সাথে থাকার ফলে তার পরিবর্তে স্ট্রাইকার হিসেবে খেলেন ডমিনিকান রিপাবলিকের মারিয়ানো দিয়াজ। ‘ছোটদের চ্যাম্পিয়ন্স লিগ’ নামে পরিচিত উয়েফা ইয়ুথ লিগে রিয়াল মাদ্রিদ অনূর্ধ্ব-১৯ দলে এই দল থেকে সর্বোচ্চ চারজন খেলতে পারে। এই সীজনে অনুর্ধ্ব-১৯ এর সাথে খেলেছেন ফেবাস, লাজো, মায়োরাল, লিয়েনহার্ট। তাদের ও বাকিদের পারদর্শীতায় রিয়াল এই সীজনে ইয়ুথ লিগের সেমিফাইনালে যেতে পেরেছে।

     

    এর মধ্যে লিয়েনহার্ট, ইয়োরেন্তে, মায়োরাল, মারিয়ানো, ওদেগার্ড, জিদানপুত্র এনজো, ফেবাস ও তোররোর ওপরেই আলোটা বেশি অন্য সবার থেকে। লিগের প্রতি সপ্তাহে প্রকাশিত ‘টিম অফ দ্যা উইক’-এ এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বেশিবার জায়গা পেয়েছে কাস্তিয়ার খেলোয়াড়রা- সেটা তাদের সামর্থ্য ও প্রতিভার কথাই  জানান দিচ্ছে। আর লিগের টপস্কোরার মারিয়ানো। তাদের এই দলগত ও একক পারফরম্যান্সের কারণে কাস্তিয়া এখন সেগুন্দা ডিভিশন বি এর গ্রুপ-২ তে দ্বিতীয় স্থানে আছে। কাস্তিয়ার কোচ হয়েই জিদান দলের ক্যাপ্টেন্সি দেন তাঁর ছেলে এনজোকে। খেলোয়াড়ি জীবনে সবসময়ই নিজের দলকে সামনে থেকে নেতৃত্ব দেওয়া জিদান যে তাঁর ছেলেকেও ফুটবল মাঠে দলনেতা হিসেবে দেখতে চাইবেন, এতে বিস্ময়ের কিছু নেই। এনজোর মুভমেন্ট, বল কন্ট্রোল আর ড্রিবলিং স্কিল যেন জিদানকেই মনে করিয়ে দেয়।

     

    কাস্তিয়ার মাঝমাঠের আরো তিন সেনানী ইয়োরেন্তে, ফেবাস ও তোররোও  নিজেদের জাত চেনাচ্ছেন। ইয়োরেন্তে এরইমধ্যে মূল দলের হয়ে খেলেও ফেলেছেন গুটিকয়েক ম্যাচ। তোররোর মত ‘মিডফিল্ড ওয়ার্কহর্স’ এখনকার ফুটবলে দুর্লভ। প্রিয় খেলোয়াড় জাবি আলোনসোর সাথে খেলায় বেশ মিল থাকায় তাকে ‘নতুন আলোনসো’ খেতাব দিয়েছেন মাদ্রিদ সমর্থকেরা। ডিফেন্সে রেগুইলন আর লিয়েনহার্টের অসাধারণ ডিফেন্সিভ জুটিতে এইবার লিগে সবচেয়ে কম গোল খেয়েছে কাস্তিয়া। দীর্ঘদেহী লিয়েনহার্ট হেডে যেমন দক্ষ, তেমনি বল পায়েও সমান স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। ডিফেন্স সামলানোর পাশাপাশি লিয়েনহার্ট প্রায়ই বল পায়ে অ্যাটাকে যোগ দেন।

     

    ফুলব্যাক হিসেবে আবনার, তেহেরোও আছেন ভাল ফর্মে। বাম প্রান্তে হোসে পাবলো লাজোর মত গতিশীল একজন থাকায় কাউন্টার অ্যাটাকেও বেশ ভয়ঙ্কর কাস্তিয়া। ডান প্রান্তে ওদেগার্ডের চোখধাঁধানো ড্রিবলিং ও অসাধারণ থ্রু-বলের নমুনা এই সিজনে অনেকবার দেখা গেছে। মাত্র ১৬ বছর বয়সে নিজের চেয়ে বয়সে ও গড়নে বেশ বড় ডিফেন্ডারদেরকে কাবু করা ওদেগার্ডের খেলায় অনেকেই তরুণ লিওনেল মেসির ছাপ খুঁজে পান।

     

    বোরহা মায়োরাল খুব সম্ভবত এই দলের সবচেয়ে সম্ভাবনাময়দের একজন। রাউলের পর কাস্তিয়ার আর কোনো স্ট্রাইকারই সিনিয়র দল তো দূরের কথা, কাস্তিয়াতেও উল্লেখযোগ্য পারফরম্যান্স দেখাতে পারেনি। কিন্তু মায়োরাল আসার পর থেকেই গোলের পর গোল করে যাচ্ছেন। ছিপছিপে গড়নের ফলে বল শিল্ডিং ও পজেশন ধরে রাখার ক্ষেত্রে অতটা দক্ষ না হলেও গতি ও ড্রিবলিং দিয়ে তা পুষিয়ে নেন। গত তিন মৌসুমেই অনূর্ধ্ব-১৭ ও সেগুন্দা বি-তে লিগের সর্বোচ্চ গোলদাতা হয়েছেন তিনি (২১, ২৪ এবং ১৫ গোল)। পুরষ্কারস্বরূপ সিনিয়র দলে ডাক পেয়েছেন এবং বেনজেমার ইনজুরির ফলে বেশ কিছু ম্যাচও খেলে ফেলেছেন। আর মারিয়ানো তো এই মৌসুমে লিগের সর্বোচ্চ গোলদাতাই। '১৫-'১৬ মৌসুমের শুরুতে 'ফ্রি এজেন্ট' হয়ে যাওয়া মারিয়ানোকে দল নিতে চেয়েছিল লিভারপুল, আর্সেনালের মত বড় ক্লাবগুলো। কিন্তু জিদান রিয়ালের কোচ হওয়ার পরপরই তাঁর পুরনো শিষ্যের চুক্তি ২০২১ সাল পর্যন্ত বর্ধিত করেন।

     

    সাম্প্রতিক ইতিহাসে রিয়ালের একাডেমিতে এত প্রতিভাবান ও প্রতিশ্রুতিশীল স্কোয়াড এসেছে কি না সন্দেহ! মাতা, সোলদাদো, এতো, নেগ্রেদোর মত বিশ্বমানের তারকারা মাদ্রিদ একাডেমির হলেও তরুণ থাকাকালীন সময় সিনিয়র দলে পরিমিত সুযোগ না পাওয়ায় অন্য দলে গিয়ে নিজেদের জাত চিনিয়েছেন, যারা এখন রিয়াল সমর্থকদের কাছে দীর্ঘশ্বাসই হয়ে আছেন। এনজো, ওদেগার্ড, মায়োরালরা ভবিষ্যতে মাতাদের পথে হাঁটবেন নাকি রাউলদের মতো রিয়ালেই আলো ছড়াবেন? উত্তরটা সময়ই বলে দেবে।