• বাংলাদেশের শ্রীলঙ্কা সফর ২০২১
  • " />

     

    অ্যাওয়ে সেঞ্চুরি- মুমিনুলের দীর্ঘ পথের শুধুই আরেকটি ধাপ

    অ্যাওয়ে সেঞ্চুরি- মুমিনুলের দীর্ঘ পথের শুধুই আরেকটি ধাপ    

    টেস্ট ক্রিকেট নিয়ে কথা উঠলে প্রায়ই বলা হয়, স্কিলের চেয়েও মাঝে মাঝে এখানে মানসিক শক্তি বা দিকটা বড় ব্যাপার। সেই মানসিক দিক দিয়ে অন্যতম বড় একটা পীড়া হতে পারে মাইলফলক। ব্যাটসম্যানদের জন্য সেটি আরও প্রকট হয়ে উঠতে পারে- নব্বই তো আর এমনি এমনি নড়বড়ে বা নার্ভাস নাম নেয় না। মুমিনুল হক বোধহয় নার্ভাসই ছিলেন। 

    থাকারই কথা। ঘরে এক, বাইরে আরেক-- টেস্ট ক্যারিয়ারে মুমিনুল হকের পারফরম্যান্স ‘ছিল’ এমনই। একটা জায়গায় তার বৈপরীত্য ছিল সবার চেয়ে বেশি-- সেঞ্চুরি সংখ্যায়। বিদেশের মাটিতে একটিও নেই, এমন সেঞ্চুরিসংখ্যার রেকর্ডে মুমিনুল ছিলেন সবার আগে-- ঘরে ১০, বাইরে ০। 

    এদিন লাহিরু কুমারার একটু ওভারপিচড ডেলিভারিকে অফস্টাম্পের বাইরে থেকে মিড-অনে দিকে টেনে ডাবলস নিলেন, দেশের বাইরে সেঞ্চুরির সঙ্গে দূরত্বটা সবচেয়ে কমে এলো তার তখন।পাল্লেকেলেতে দ্বিতীয় দিন শুরু করেছিলেন সেঞ্চুরি থেকে ৩৬ রান দূরে দাঁড়িয়ে। নড়বড়ে নব্বইয়ে গেলেন একটা বাউন্ডারিতে। সেখান থেকে সেঞ্চুরিতে যেতে নিলেন ১১ বল। যে ইনিংসে তিনি প্রথমবার খেলেছেন ৩০০ বল (এর আগে সর্বোচ্চ ছিল ২৭৪ বল- ২০১৩ সালে চট্টগ্রামে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ১৮১ রান করতে খেলেছিলেন তিনি), আগেরদিন যেখানে তার সঙ্গী নাজমুল হোসেন শান্ত নব্বইয়ের ঘরে কাটিয়েছিলেন ৩৮ বল, সেখানে এদিন তার ইনিংসের ‘দশক’ ব্যবধান করলে সবচেয়ে কম সময় তিনি কাটিয়েছেন নব্বইয়ের ঘরেই-- হয় মাইলফলক তার মাথায় ছিল না, অথবা সেটি সেরে ফেলতে চেয়েছেন দ্রুতই! 

    অবশ্য এক্ষেত্রে পরেরটি হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি, অন্তত তখনকার শরীরি ভাষা বলছিল তেমন। ৯৭ রানে দাঁড়িয়ে টানা চারটি ডট দিয়েছিলেন, এর মাঝে শেষেরটিতে ডাউন দ্য গ্রাউন্ডে এসেও শেষ-মুহুর্তে লেংথ পড়ে খেলেছিলেন ডিফেন্সিভ শট। ধনঞ্জয়া ডি সিলভার ঠিক পরের বলটিতেই কাট করলেন, মুমিনুল পৌঁছে গেলেন জাদুকরি তিন অঙ্কে। দেশের বাইরে একটিও নেই, কিন্তু সেঞ্চুরিসংখ্যায় সবচেয়ে এগিয়ে-- এ রেকর্ড থেকে মুক্তি মিললো তার। সেটি এখন ভারতের রোহিত শর্মার, দেশে ৭টি সেঞ্চুরি করলেও দেশের বাইরে একটিও নেই তার এখনও। 

    ****

    এদিনের আগেই বাংলাদেশের হয়ে সবচেয়ে বেশি সেঞ্চুরি ছিল মুমিনুলের, কমপক্ষে ৩ হাজার রান করেছেন, বাংলাদেশে এমন ব্যাটসম্যানদের মাঝে সবচেয়ে বেশি গড়ও তার। চল্লিশের ওপর গড়ে ব্যাটিং করা একমাত্র বাংলাদেশীও তিনি। শুধু তাই নয়, জেতা ম্যাচে কমপক্ষে ৫০০ রান করেছেন, এমন ব্যাটসম্যানদের মাঝেও বাংলাদেশীদের মাঝে সবচেয়ে বেশি গড় তার, যৌথভাবে সবচেয়ে বেশি সেঞ্চুরি তার। তবে ক্যারিয়ার-রান ৩ হাজারের ওপর, এই বন্ধনীর মাঝে যেসব বাংলাদেশী ব্যাটসম্যান পড়েন, মুমিনুলের বিদেশে গড় এখনও তাদের মাঝে সবচেয়ে কম।
     

     


    বড় ইনিংস খেলার যে অভ্যাস, বা ‘ফিফটি-সেঞ্চুরি’র কনভার্শন রেট-- সেটিতে মুমিনুল বাংলাদেশী ব্যাটসম্যানদের মাঝে সবচেয়ে এগিয়ে। দেশের মাটিতে ১৭ বার ফিফটি বা এর বেশি রানের ইনিংস খেলেছেন তিনি, এর মাঝে ১০ বারই ছুঁয়েছেন সেঞ্চুরি, টেস্টে জোড়া সেঞ্চুরি করা একমাত্র বাংলাদেশীও তিনি। তবে বিদেশের মাটিতে এর আগে খেলেছিলেন ৬টি ফিফটি-পেরুনো ইনিংস, সেগুলো আটকে গিয়েছিল ৫১ থেকে ৭৭ রানের মাঝেই, এদিনের আগে ২০১৭ সালে পচেফস্ট্রুমে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে সেঞ্চুরির ‘সবচেয়ে’ কাছে গিয়েছিলেন তিনি। 

    এসব পরিসংখ্যানে টেস্টে সবার চেয়ে এগিয়েও থাকলে দেশের ‘সেরা ব্যাটসম্যান’-এর তকমাটা তার কাছ থেকে বেশ দূরে দাঁড়িয়ে থাকে বোধহয় ঘরে-বাইরের এই তারতম্যের কারণেই!  

    ****

    অভিষেকের পর থেকে মুমিনুল হক চোট ছাড়া দলের বাইরে ছিলেন তিনটি টেস্টে- অভিষেকের পর দ্বিতীয় সিরিজের জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে হারারেতে, ২০১৭ সালে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে কলম্বো ও একই বছর ঢাকায় অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে বাংলাদেশের ‘ঐতিহাসিক’ টেস্টে। 

    মূলত ২০১৭ সালের শ্রীলঙ্কা সফর দিয়েই শুরু হয়েছিল মুমিনুল-নাটক। গলে ব্যাটিং-সহায়ক কন্ডিশনে দুই ইনিংস মিলিয়ে করেছিলেন ৭ ও ৫, দুবারই হয়েছিলেন এলবিডব্লিউ। এরপর কলম্বোতে বসে থাকতে হয়েছিল তাকে, দেখেছিলেন শততম টেস্টে বাংলাদেশের জয়। 

    পরের সিরিজে শুরুতে তাকে দলেই নেওয়া হয়নি, তখনকার হেড কোচ চন্ডিকা হাথুরুসিংহে বলেছিলেন, মুমিনুলকে যে প্রক্রিয়ায় বাদ দেওয়া হয়েছে, সেটি শুরু হয়ে গেছে। অবশ্য হাথুরুসিংহের কথা ধোপে টেকেনি, দল ঘোষণার একদিন পরই নাটকীয়ভাবে দলে ফিরেছিলেন মুমিনুল, যদিও প্রথম টেস্টে খেলানো হয়নি তাকে। চট্টগ্রামে খেলেছিলেন, তবে প্রথম ইনিংসে চারে ব্যাটিং করলেও পরের ইনিংসে তাকে নামানো হয়েছিল আট নম্বরে! হাথুরুসিংহে চলে গেছেন, মুমিনুলকে নিয়েও নাটক হয়নি আর। 

    তবে বিদেশের মাটিতে তার পারফরম্যান্স তো ছিলই আলোচনায়। 

    **** 

    ২০১৯ সালে সাকিব আল হাসানের নিষেধাজ্ঞায় হুট করেই ভারত সফরের আগ দিয়ে টেস্ট অধিনায়ক করা হয়েছিল মুমিনুল হককে। ততদিনে ‘টেস্ট স্পেশালিস্ট’ হয়ে গেছেন তিনি, তার আগের বছরে খেলে ফেলেছেন এখন পর্যন্ত ক্যারিয়ারের শেষ ওয়ানডেও। মুমিনুল শুরু থেকেই বলে এসেছেন, অধিনায়কত্বের কারণে বাড়তি চাপ নিতে চান না তিনি। 

    সেটি অন্তত তার ব্যাটিংয়ে সেভাবে প্রভাব ফেলেওনি, ব্যাটিং গড় ক্যারিয়ার-গড় ৪২.৩৩ থেকে বেড়ে হয়েছে ৪৬.৮৩ (অবশ্য এই টেস্টের আগে সেটি ছিল ৩৯.৫৪), ১২ ইনিংসে করেছেন ৩টি সেঞ্চুরি, যার সবকটিই শেষ ৬ ইনিংসে। 

    তবে দেশের মাটিতে চট্টগ্রামের পর মিরপুরেও ওয়েস্ট ইন্ডিজের কাছে হেরেছে বাংলাদেশ, ভারত-পাকিস্তানে ভরাডুবির সঙ্গে। মুমিনুল তাই ছিলেন আলোচনাতেই। এমনকি এ সিরিজ শুরুর আগে ‘চাপ নেই’ বলে এসেছিলেন আরেকদফা। 

    “আমার মনে হয় মুমিনুল তার খেলাটা খুব ভাল বুঝতে পারে। সে খুবই শান্ত স্বভাবের একজন। তার এসব আচার-আচরণই আদতে তাকে খুবই গোছানো একজন টেস্ট ব্যাটসম্যান বানাতে সহায়তা করে। তার প্রস্তুতি নিয়ে সে খুবই নিখুঁত। কঠোর পরিশ্রম করে। তার সামর্থ্য-দূর্বলতা জানে। আমার মনে হয় সে অসাধারণ একজন ব্যাটসম্যান। সে দলকে নেতৃত্ব দেওয়ার সেরা চেষ্টাটাই করে যাচ্ছে। ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে সেঞ্চুরি পেয়েছে, এখানে পেল। আমার ধারণা এখন ১১টি সেঞ্চুরি হলো তার, যেটা অসাধারণ এক অর্জন”, দ্বিতীয় দিনের খেলাশেষে মুমিনুলকে নিয়ে একদফায় যতো প্রশংসা করা যায়, তার সবই করলেন হেড কোচ রাসেল ডমিঙ্গো। 

    মুমিনুলের হয়তো এসব প্রাপ্যও। তবে তিনিও নিশ্চয়ই জানেন, পাল্লেকেলের এই ইনিংসটা শুধু তার বিদেশের মাটিতে সেঞ্চুরি কলামটা পূর্ণ করলো না, একটা রেকর্ড থেকে মুক্তি দিল না, তার ক্যারিয়ারের অনেক ধাপের আরেকটিই শুধু পেরুলেন ২৯-পেরুনো বাংলাদেশ অধিনায়ক। দেশের মাটিতে যা করেছেন, বিদেশের মাটিতেও যে সেরকম অনেক কিছু করার আছে তার।