ভারতীয় বংশোদ্ভূত কিউই স্পিনার আজাজ প্যাটেলের মুম্বাইয়ের মাঠে দশে দশ!
ইতিহাস গড়লেন আজাজ প্যাটেল! মুম্বাইয়ে জন্ম নেওয়া প্যাটেল মুম্বাইয়ের মাঠেই ভারতের বিপক্ষে ইনিংসে নিয়েছেন ১০ উইকেট, আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে যা কেবল তৃতীয় ঘটনা।
প্রথম দিনটাও একান্তই আজাজের হয়ে থাকতে পারত। তবে বাধ সেধেছিলেন মায়াঙ্ক আগারওয়াল, সেই তিনি ফিরলেন ১৫০ রানে, আজাজের শিকার হয়েই! হয়ে গেল সাতে সাত; ক্রিকেট পরিসংখ্যানবিদরা ততক্ষণে শুরু করে দিয়েছেন তার বোলিং ফিগারের বিশ্লেষণ। ভারতের মাটিতে এর আগে বিদেশি বোলারদের মধ্যে ইনিংসে সর্বোচ্চ ৮ উইকেট পেয়েছেন দুজন। দুজনেই আবার তাসমানের ওপারের। ন্যাথান লায়ন ও জেসন ক্রেজার পাশে নিজের নাম লেখানোর পথে তখন প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়ালেন আরেক প্যাটেল।
অক্ষর প্যাটেল উইকেটে এসে ছিলেন স্বচ্ছন্দ। তবে মায়াঙ্ক ১৫০ ছোঁয়ার পরে আবারও আলোচনায় ফেরেন আজাজ। দারুণ খেলতে থাকা মায়াঙ্ক হয়ত কিছুটা ক্লান্তির বশেই ব্যাকফুটে ডিফেন্ড করতে গেলেন। আজাজের তীক্ষ্ণ ঘূর্ণি ব্যাটের কানায় চুমু খেয়ে চলে যায় উইকেটকিপার টম ব্লান্ডেলের হাতে। মায়াঙ্ক ফিরলেন, সেই সাথে আজাজের দশে দশের সম্ভাবনার পালে লাগল জোর হাওয়া।
অন্য প্রান্তে অক্ষর অবশ্য এরপর টেস্টে নিজের প্রথম ফিফটি তুলে নেন। তবে দিনটা যে শুধুই নিজের করে রাখবেন বলেই পণ করেছিলেন আজাজ। অঙ্গীকারবদ্ধ আজাজ ঠিকই ফেরালেন অক্ষরকে; এলবিডব্লিউর ফাঁদে পড়ে তিনি ফিরলেন ৫২ রানে।
অক্ষর ফেরার পর টেইলএন্ডারদের পেয়ে যেন আজাজ পাচ্ছিলেন ১০ উইকেটের সুবাস। ক্রিকেটের ইতিহাসের পাতায় নিজেকে অমর করে রাখতেও তাই আর বেশি সময় নিলেন না। পরের ওভারেই জয়ন্ত যাদবকে ফেরালেন রচিন রবীন্দ্রর ক্যাচে। কানপুর টেস্ট বাঁচিয়েছিলেন ভারতে জন্ম নেওয়া এই দু’জন। রবীন্দ্রর কাচেই মোহাম্মদ সিরাজকে ফেরালেন আজাজ, গড়লেন ইতিহাস। ওয়াঙ্খেড়ের মাটিতে মুম্বাইয়ের ছেলে গড়ল এক ইনিংসে ১০ উইকেটের কীর্তি।
আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ইতিহাসে এটি মাত্র তৃতীয় ঘটনা হলেও একটা জায়গায় আজাজ প্রথম; প্রতিপক্ষের মাটিতে এটাই প্রথম ইনিংসে এক বোলারের ১০ উইকেট পাওয়ার ঘটনা। অবশ্য নিউজিল্যান্ডের হওয়া খেলা আজাজ তো ছিলেন ঘরে ফেরার আমেজেই; উপলক্ষটাও স্মরণীয় করে রাখতেও ভুল করেননি তাই।
আরও পড়ুন: আন্তর্জাতিক ও প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেট ইতিহাসে ইনিংসে ১০ উইকেট নিয়ে আরও ঘটনা
এরকম কিছু যে তিনি করে বসতে পারেন তার ইঙ্গিত কিন্তু দিয়েছিলেন দিনের শুরুতেই। দ্বিতীয় দিনে নিজের করা প্রথম ওভারেই এলবিডব্লিউর ফাঁদে ফেললেন ঋদ্ধিমান সাহাকে। পরের বলেই অসাধারণ অফ ব্রেকে গুঁড়িয়ে দিলেন রবিচন্দ্রন আশ্বিনের স্টাম্প। হয়ে যায় ছয়ে ছয়! আশ্বিনকে করা বলে টার্ন এতটাই নিখুঁত ছিল যে, ব্যাটসম্যান বুঝতেই পারেননি তিনি বোল্ড আউট হয়েছেন। কট বিহাইন্ড দেওয়া হয়েছে ভেবে তিনি নিচ্ছিলেন রিভিউ।
দ্বিতীয় দিনের শুরুটা যেমন করেছিলেন জোড়া আঘাত হেনে তেমনই প্রথম দিনেও ভারতের ইনিংস এলোমেলো করে দিয়েছিলেন এক ওভারেই জোড়া আঘাতে। ৮০ রানের ওপেনিং জুটি ভেঙ্গেছিলেন শুবমন গিলকে ফিরিয়ে। পরের ওভারে এসে আজাজের ভাসিয়ে দেওয়া বলে বেরিয়ে এসে খেলতে গেলেন ফর্মহীনতায় ভুগতে থাকা চেতেশ্বর পুজারা। পড়ন্ত ফর্মের প্রতিফলন হিসেবেই যেন বল তার ব্যাট ফাঁকি ফিয়ে পেরিয়ে গেল, ভেঙে দিল স্টাম্প।
পুজারার বিদায়ে উইকেটে আসলেন ভিরাট কোহলি, যার নিজের ২০২১ সালটাও খুব একটা ভালো যাচ্ছিল না। ঐ ওভারের শেষ বলেই রানের খাতা খোলার আগেই ফিরলেন তিনিও। তবে সেই আউট নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোতে রীতিমত ঝড় উঠে গিয়েছে। এলবিডব্লিউর সেই আবেদনে আম্পায়ার আউট দেওয়ার পর রিভিউ নেন কোহলি। রিপ্লেতে দেখা যায় বল প্রায় একই সময়ে ব্যাট ও প্যাডে লেগেছে। কোথায় আগে লেগেছে তা ঠাহর করা মুশকিল বটে। থার্ড আম্পায়ার নিতিন মেনন মাঠের সিদ্ধান্তই বহাল রাখেন। আজাজ পেয়ে যান তার সবচেয়ে বড় শিকার।
গত ম্যাচেই দারুণ অভিষেক হওয়া শ্রেয়াস আইয়ারের সাথে জুটি গড়ে এরপর ভারতের ইনিংস স্থিতিশীল করার চেষ্টা করেন মায়াঙ্ক। সেই চেষ্টায় আবারও বাধ সাধেন আজাজ। ওয়াঙ্খেড়ের পিচে অন্য সবার চেয়ে আলাদা বোলার মনে হচ্ছিল তাকে। নিয়মিত টার্ন ও বাউন্স আদায় করে নেওয়া আজাজ আবারও পেলেন বাউন্সের দেখা। তাতেই বিচলিত হয়ে কিছুটা অপ্রস্তুত শট খেলতে গিয়ে উইকেটের পেছনে ক্যাচ দিয়ে ফেরেন শ্রেয়াস।
সেই যে শ্রেয়াসকে ফিরিয়ে চারে চার হয়েছিল তার, এরপর তো আজ ইতিহাস রচনা করেই ফেললেন। সেই ১৯৯৬ সালে সপরিবারে এই মুম্বাই ছেড়ে পাড়ি জমিয়েছিলেন নিউজিল্যান্ডে। তবে মুম্বাইয়ের মাটি, বাতাসের ঘ্রাণ যে তিনি ভুলেননি সেটাই মনে করিয়ে দিলেন ক্রিকেট বিশ্বকে। ভারতের মাটিতে কোনও সফরকারী বোলার হিসেবে সেরা বোলিং ফিগারের রেকর্ড (১০/১১৯) গড়ার পাশাপাশি ইনিংসে ১০ উইকেটের এই অমর কীর্তি গড়ে ভারতের সাথে তার নামটাও জুড়ে দিলেন চিরতরেই।