• অন্যান্য
  • " />

     

    নাইস, গ্যারি!

    নাইস, গ্যারি!    

    রাজ্য ক্রিকেটের মাঠের গ্রাউন্ডসম্যানটাকে দেখুন। মাঠে নিবিড় চিত্তে পিচ মাড়াই করে যাচ্ছেন। আর ওদিক নেটে অনুশীলনে নিবিষ্ট খেলোয়াড়েরা। রাজ্য ক্রিকেটে তখন চলছে টি-টোয়েন্টির মৌসুম। এসিটি (অস্ট্রেলিয়ান ক্যাপিটাল টেরিটোরি) টি-টোয়েন্টি দলের কোচ আবার স্পিন মন্ত্রে বিশ্বাসী; নতুন স্পিনারদের বাজিয়ে দেখায় তাই তার অফুরন্ত আগ্রহ। সেজন্যই বোধহয় তাকে একজন বললেন, ওই গ্রাউন্ডসম্যানের বোলিং দেখতে। সে নাকি বেশ ভালো স্পিনার। শুনে তো কোচ হেসেই দিলেন, বলে কী! বলবয় হলেও একটা কথা ছিল, কিন্তু গ্রাউন্ডসম্যান কি আদতে খেলে নাকি? আরে দেখুনি না, মশাই! শুধু অফস্পিনার শুনেই কোচ ভাবলেন, দুই-তিন বল করতে দিতে আর দোষ কোথায়! হেঁড়ে গলায় ওই গ্রাউন্ডসম্যানক ডেকে বললেন নেটে এসে কয়েকটা বল করতে। পার্ক ২৫ এর সেই পিচ মাড়াইয়ে ব্যস্ত গ্রাউন্ডসম্যান দূর থেকে কিছুটা লজ্জার স্বরে সেই অনুরোধ ফিরিয়ে দিয়ে বললেন, পিচের কাজ ঢের বাকি। কোচও আবার ছাড়বার পাত্র নন। নাছোড়বান্দা কোচের অনুরোধে কিছুটা জবুথবু হয়েই গ্রাউন্ডসম্যান এলেন, করলেন ৩-৪টি বল। সেই দেখে কোচ তো রীতিমত অবাক-একি! এই ছেলে তো দেখি পাকা অফ স্পিনারের মত বল ঘুরায়!

    প্র্যাক্টিস শেষ হতেই কোচ ফোন করলেন তৎকালীন দক্ষিণ অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেট পরিচালক ও জাতীয় দলের নির্বাচক জেমি কক্সকে- নতুন এক ছেলের খোঁজ পেয়েছি। রাজ্য দলে তাকে নেওয়ার অনুরোধ করলে কক্স বাঁধ সাধলেন; অভিজ্ঞতাহীনতার কথা মনে করিয়ে দিলেন। কোচ তখন কক্সকে নিজে এসে তার বোলিং দেখে যাওয়ার অনুরোধ করলেন। কক্স এলেন, দেখলেন, যথারীতি মুগ্ধও হলেন। রাজ্য দলে তাকে ভেড়ানোর ব্যাপারে তবুও সন্দিহান কক্স কোচের ডাকে সাড়া দিলেন। সুসংবাদটা দিতে ঐ ছোকরাকে তখনই ডেকে পাঠালেন কোচ। খবরটা শুনে তো সেই গ্রাউন্ডসম্যানের চক্ষুচড়কগাছ অবস্থা! ছেলে যে শুধুই গ্রাউন্ডসম্যান তা কিন্তু নয়। সে তখন প্রসপেক্ট ক্রিকেট ক্লাবের হয়ে গ্রেড ক্রিকেট খেলে। এমনকি মাস খানেক আগে এই রাজ্য দলের এক ট্রায়াল থেকেও ফিরতে হয়েছে প্রত্যাখ্যানের তিক্ত অভিজ্ঞতা নিয়ে। আর নিয়তির কী বিধান! এভাবেই শেষমেশ রাজ্য দলে ডাক পেলেন তাহলে!

    প্রসপেক্টের হয়ে যে ওই ছেলে খেলে সেটা কোচ তাকে নেটে বল করতে ডাকার আগেই জেনেছিলেন। রাজ্য দলের জার্সি দেওয়ার সময়ও জানিয়ে দিলেন যে শুধু দল ভারী করতে তাকে নেওয়া হয়নি। যেই বলা সেই কাজ। বিগ ব্যাশের মহড়া হিসেবে রাজ্য দল নিয়ে তখন চলছে “বেবি ব্যাশ”। দক্ষিণ অস্ট্রেলিয়ার দ্বিতীয় একাদশের সাথে প্রথম ম্যাচেই ওই তরুণ স্পিনার দারুণ বল করলেন; চার ওভারের কোটা পূর্ণ করে মাত্র ১৪ রান দিয়ে নিলেন ৩ উইকেট। ড্রেসিং রুমে তখন উপস্থিত ছিলেন দক্ষিণ অস্ট্রেলিয়ার আরেক নির্বাচক অ্যান্ড্রু ঝেসারস। মুগ্ধ ঝেসারস ম্যাচ শেষে ওই স্পিনারকে ডেকে নিয়ে সাউদার্ন রেডব্যাকসের দলে ভেড়ানোর ইচ্ছা প্রকাশ করলেন। শুনে তো সেই ছেলে মহাখুশি; কোচও বেজায় খুশি কেননা তিনি একাধারে রেডব্যাকসেরও কোচ। স্পিন-টোটকার অন্ধবিশ্বাসী কোচ বিগ ব্যাশেও নিজের পন্থায় অটল ছিলেন। কোচের সেই টোটকা ঠিকই কাজে লেগে গেল। ২০১০-১১ মৌসুমে বিগ ব্যাশ জিতল সাউদার্ন রেডব্যাকস। আর ওই ছোকরা? ৭ ম্যাচে ১১ উইকেট নিয়ে হলেন টুর্নামেন্টের যৌথ সর্বোচ্চ উইকেট শিকারি। বিগ ব্যাশের ইতিহাসে রেডব্যাকসকে প্রথম শিরোপা জিতিয়ে ইতিহাসের পাতায় স্থায়ীভাবেই নিজের নাম তুলে রাখলেন কোচ-নাম তার ড্যারেন বেরি। ইতিহাসের পাতায় নিজের নাম খোদাই করেছে ঐ ছোকরাও। গ্রাউন্ডসম্যান থেকে অস্ট্রেলিয়ার ব্যাগি গ্রিন-ক্রিকেট রুপকথার এক নায়ক বনে যাওয়া সেই তরুণ ব্যাগি গ্রিন মাথায় খেলে ফেলেছেন ১০০ টেস্ট ম্যাচ, হয়েছেন অস্ট্রেলিয়ার ইতিহাসের সর্বোচ্চ উইকেট শিকারি অফ স্পিনার; আর ছুঁয়েছেন ৪০০ টেস্ট উইকেটের মাইলফলক। আপন গতিতে ছোটা সেই লাজুক অফ স্পিনারের নাম ন্যাথান মাইকেল লায়ন ওরফে “দ্যা গোট”।


                                                                                       *****************

    গ্রাউন্ডসম্যান থেকে রাতারাতি ক্রিকেটার হয়ে যাওয়ার ঘটনাটা রূপকথার উপাখ্যান মনে হতে পারে, লায়নকে ভাগ্যবানও বলতে পারেন অনেকে। তাতে তাহলে পর্দার আড়ালে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলোর কিছুটা হলেও অবমাননা করা হয়ে যায়। প্রকৃতপক্ষে লায়ন কিন্তু ক্রিকেটার হওয়ারই স্বপ্ন দেখতেন। সেই লক্ষেই ঐ চাকরিটা বাগিয়েছিলেন। তবে তার আগে থেকেই নিজের ক্রিকেট নিয়ে কাজ করতেন তিনি।

    নিজেদের আঙিনায় যখন ক্রিকেট খেলতেন ধুরন্ধর বড় ভাই ব্রেন্ডানের সাথে পেরে উঠতে বেগ পেতে হত। ঐ আঙিনা এক দিকে কিছুটা ঢালু ছিল। তো অস্ট্রেলিয়ার ওয়ার্ন-জ্বরে আক্রান্ত ছিলেন ব্রেন্ডানও। সেই সাথে সে বুঝে গিয়েছিল ঢালের অন্য প্রান্ত থেকে লেগ স্পিন কতটা কার্যকর। “সিব্লিং রাইভালরি” তখন পেয়ে বসেছে লায়নকে; যেভাবেই হোক ব্রেন্ডানকে হারাতেই হবে। ও যেহেতু লেগ স্পিন করছে আমি তাহলে বল বিপরীত দিকে ঘোরাবো, দেখি ব্যাটা কী করে- ভাবলেন লায়ন। ডানহাতি অফ স্পিনে অনভ্যস্ত ব্রেন্ডান তখন ঠিকই খাবি খেতে থাকল। শেন ওয়ার্ন হতে চাওয়া আরও এক অস্ট্রেলিয়ান তরুণ না হয়ে ন্যাথান লায়ন নিজের মত করেই নিজের পথ ধরলেন। বয়সভিত্তিক ক্রিকেটেও পেতে শুরু করলেন সাফল্য। বয়সভিত্তিক দলে তিনি ছিলেন অলরাউন্ডার; ব্যাটিংয়ে ছিলেন দারুণ পারদর্শী। তবে বয়স বাড়ার সাথে সাথে বড়দের দলে জায়গা করে নেওয়ার চিন্তা থেকেই বোলিংয়ে মনোনিবেশ করলেন তিনি। ঐ সময়ে ব্রেন্ডান আবার তাদের অ্যাডিলেইডের বাড়ি ছেড়ে ক্যানবেরার পথ ধরলেন। লায়নকেও বললেন এসিটির বয়সভিত্তিক দলে যোগ দিতে। লায়নের স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্যই ৩ ঘন্টা আসা যাওয়ার রাস্তা পাড়ি দিয়ে তাকে সপ্তাহান্তে ক্যানবেরা নিয়ে যেতেন তার বাবা-মা অথবা দাদী। তবে এভাবে তো আর আজীবন চলবে না। একটু বড় হতে তাই লায়নও ভাইয়ের পদাঙ্ক অনুসরণ করে ক্যানবেরায় ভিটা গাড়লেন।

    ওখানে গিয়ে রাজ্য দলের জন্য নিজেকে প্রস্তুত করতে তিনি শরনাপন্ন হন জন ডেভিসনের। কানাডার সেই ডেভিসন যার অধীনে এক সময় ছিল দ্রুততম বিশ্বকাপ সেঞ্চুরির রেকর্ড। ডেভিসন দক্ষিণ অস্ট্রেলিয়ার হয়ে শেফিল্ড শিল্ডে ততদিনে নাম কুড়িয়ে ওখানেই কাজ করছেন। প্রথম দেখায় লায়নকে তার মনে ধরল না তেমন একটা। ছন্নছাড়া লাইন লেংথের এই স্পিনারের অবশ্য শেখার অশেষ ইচ্ছা; ডেভিসনের মন গলল তাতেই। ধীরে ধীরে নিজের পরিধিও বাড়াতে শুরু করলেন লায়ন। আরেক কোচ হিগসকে নিয়ে লায়নের সাথে কাজ করা ডেভিসনের তখন মনে হল এই ছেলেকে ক্যানবেরায় স্থায়ীভাবে নিয়ে আসা দরকার। রাজ্য দলের জন্য জোর দাবী জানাতে প্রস্তুতিও তো সেরকম হওয়া চাই। এসিটির তৎকালীন কোচ অ্যাশলি রসকে বলে এই দুজন মিলে লায়নকে তাই নিয়ে দেন এসএসিএর গ্রাউন্ডসম্যানের চাকরি। রাজ্য দলে তখন অবশ্য তিনি সুযোগ পাননি। হতাশায় পোড়া লায়ন কি আর তখন ভেবেছিলেন যে এই চাকরিই হবে তার স্বপ্নপূরণের সিড়ি!

                                                                           **********************

    টেস্ট ইতিহাসে মাত্র ২০ জন বোলার নিজের প্রথম বলেই উইকেট পেয়েছেন। এদের মধ্যে মোটে ৩ জন ১০টির বেশি টেস্ট খেলতে সক্ষম হয়েছেন। ছোট্ট সেই তালিকার একজন সদস্য হলেন ন্যাথান লায়ন। এই তালিকায় ১০০ টেস্ট খেলা একমাত্র বোলার তিনি তা তো বলা বাহুল্য। এমন অভিষেকের স্বপ্ন বুঝি তিনি নিজেও দেখেননি। শ্রীলঙ্কার দুর্গ গলে তার মাথায় ব্যাগি গ্রিন তুলে দেওয়া হল; অধিনায়ক মাইকেল ক্লার্কের আলিঙ্গনে কাটল সেই ঘোর। এরপর লাল বল হাতে নিয়ে  প্রথম বলেই নিলেন এমন একজনের উইকেট যার উইকেট পাওয়ার জন্য বোলারদের মাথা কুটে মরতে হয়- তর্কসাপেক্ষে শ্রীলঙ্কার সর্বকালের সেরা ব্যাটসম্যান কুমার সাঙ্গাকারার। নিজেদের প্রথম ইনিংসে শ্রীলঙ্কা গুঁটিয়ে গেল ১০৫ রানে। আর অভিষেকেই ৫-উইকেট তুলে নিয়ে সেই ধ্বংসযজ্ঞে অগ্রণী ভূমিকা পালন করলেন লায়ন। সেবার ঐ ম্যাচ জেতার কারণেই ক্লার্কের অস্ট্রেলিয়া পেয়েছিল ১-০ ব্যবধানের সিরিজ জয়; লায়ন নিয়েছিলেন ৮ উইকেট।

    শেফিল্ড শিল্ডে মাত্র ৪ ম্যাচ খেলেই অস্ট্রেলিয়া দলে সুযোগ পাওয়া লায়নকে ঘিরে তবুও ছিল শঙ্কা। কেননা লায়ন তখনও তার স্টক বলের ওপরেই নির্ভরশীল। হ্যাঁ, আকাশে বল ভাসিয়ে ব্যাটসম্যানকে পরাস্ত করার সামর্থ্য তার স্টক বলের আছে। পঞ্চম স্টাম্পের রাস্তায় বল পড়ে তীক্ষ্ণ বাঁকে ডানহাতি ব্যাটসম্যানের ব্যাট ফাঁকি দিয়ে মিডল-অফ স্টাম্প উড়িয়ে দেওয়া বা বাঁহাতি ব্যাটসম্যানকে সামনে ঝুঁকে হাঁটু ফেলে ব্যাট গেড়ে দেওয়ার আমন্ত্রণ জানিয়ে অন্য প্রান্তের পেসারের তৈরি করে যাওয়া ঐ রুক্ষ অঞ্চলে বল ফেলা, অতঃপর ব্যাটসম্যানের ব্যাট চুমু খেয়ে প্রথম স্লিপে ক্যাচ- একজন অফ স্পিনারের স্বপ্নের সেই ডেলিভারি কার্যকর করার স্বপ্নেই মাঠে বিভোর লায়ন। “পারফেক্ট” সেই ডেলিভারির খোঁজ করতে যেয়ে রান গুনছেন প্রায়শই। তবে উইকেটের, অফ স্পিনের সৌন্দর্যের সেই নেশায় তিনি তখনও মত্ত। অধিনায়ক ক্লার্ক কিছুটা নিজেও সেই নেশার মায়ায় পড়েছিলেন; সমালোচনার মুখে তাকে আগলেও রেখেছিলেন। ২০১৩ ভারত সফরে তাকে বাদ দেওয়া হলেও ২০১৪ সালে ঘরের মাটিতে ভারতের বিপক্ষে ঠিকই তাকে দলে নিয়েছিলেন। ফিল হিউসের শোককে শক্তিতে পরিণত করতে বদ্ধপরিকর অস্ট্রেলিয়ার অঙ্গিকার পূর্ণ করলেন সেই লায়নই। জয়ের দিকে ছুটতে থাকা ভিরাট কোহলিকে থামিয়েছিলেন। শেষ ইনিংসে ৭ উইকেটের পাশাপাশি ম্যাচে নিয়েছিলেন ১২ উইকেট। ইনজুরি প্রবণ জনসন, হ্যারিস, সিডল, ওয়াটসনদের মোক্ষম ব্যবহারের সুযোগ ক্লার্ক তো পেতেন ঐ লায়নের জন্যই। এক প্রান্ত আগলে রেখে অবিরাম হাত ঘোরাচ্ছেন লায়ন; শেষ দিনে ঐ পিচের ঐ রুক্ষ জায়গা ব্যবহারের ঘোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। লায়নের সেই প্রচেষ্টা একঘেয়ে; তবে সেই চেষ্টায় আছে অলস সৌন্দর্য। ক্লার্কও তাই আগলে রেখেছিলেন তার এই বিরামহীন সৌন্দর্য-পূজারীকে।

    ক্লার্ক অবসর নেওয়ার পরেই অবশ্য বড় পরীক্ষাগুলো আসতে শুরু করল। অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে ততদিনে তিনি পরীক্ষিত। কিন্তু এশিয়ার মাটিতে কার্যকারিতা নিয়ে তখনও তার মাথার ওপর ঝুলছে প্রশ্নবোধক চিহ্ন। সেই ২০১৩ সালে ভারত সফরে বাদ পড়ার পর আরব আমিরাতে পাকিস্তানের বিপক্ষে খেলার সুযোগ মিলেছিল। তবে ইউনুস খান সেবার তাকে কচুকাটা করে ক্যারিয়ারের অস্তিত্বই শঙ্কার মুখে ফেলে দিয়েছিলেন। কণ্টকাকীর্ণ সেই পথ পরে সন্তর্পণে পাড়ি দিয়েছিলেন ঠিকই, তবে কাটাগুলোর বিহিত করা হয়নি তখনও।

    সুযোগ এল ২০১৬ শ্রীলঙ্কা সফরে। অধিনায়কত্বের আসনে তখন স্টিভ স্মিথ। এর আগে এশিয়া সফর করা লায়নের ওপর সেবার স্মিথের অসীম ভরসা। এই শ্রীলঙ্কায় অভিষেকের সুখস্মৃতি যে লায়ন ফিরিয়ে আনবেন তা নিয়ে স্মিথ আশা দেখছেন। আর এই শ্রীলঙ্কা তো আর সেই সাঙ্গাকারা-জয়াবর্ধনেদের পরাক্রমশালী শ্রীলঙ্কা নয়। ক্রান্তিকালীন এই দলের বিপক্ষে অস্ট্রেলিয়াই সেবার ফেভারেট। পাল্লেকেলের প্রথম টেস্টের প্রথম ইনিংসে শ্রীলঙ্কা ঠিকই গুঁটিয়ে গেল ১১৭ রানে। মাত্র ৩ ওভার বল করেই ৩ উইকেট তুলে নিলেন লায়ন। লায়নের নামে যেই কালিমা লেপন করা হয়েছে সেটা মুছে গিয়ে এশিয়া দুঃস্বপ্ন বিস্মৃতির অতল গহবরে তলিয়ে যাবে- মনে হচ্ছিল সেটাই। তবে ঐ সফরে সুখস্মৃতি ঐটুকুই। দ্বিতীয় ইনিংসে সুইপ শটের বন্যা বইয়ে দিয়ে কুশল মেন্ডিস করলেন ১৭৬; চড়াও হয়েছিলেন মূলত লায়নের ওপরেই। লায়ন রান গুনেছিলেন ওভারপ্রতি ৪ রান করে। সেই শ্রীলঙ্কা সেবার ৩-০ ব্যবধানে ওয়াইটওয়াশ করল অজিদের। ৩ ম্যাচে সেবার ১৬ উইকেট নিয়েছিলেন লায়ন। তবে সফর শেষে পরোক্ষভাবে স্মিথ একহাত নিয়েছিলেন ওই লায়নকেই। কোচ ড্যারেন লেমান তো সাফসাফ বলে দিলেন, লায়নের সেই “পারফেক্ট” বলের খোঁজই ডুবিয়েছে অস্ট্রেলিয়াকে।

                                                                               *****************

    সেই সফরের পর বিগ ব্যাশে কমেন্ট্রি বক্স থেকে তাকে ফিল্ডিং করতে দেখেই সেই প্রথম কোচ বেরির মনে খটকা লাগল। বক্স থেকে বের হয়ে বাউন্ডারি লাইনে দাঁড়ানো লায়নের সাথে কুশলাদি বিনিময় করতে গেলেন সাথে সাথে। যেই স্টক বলের ওপর লায়নের অগাধ আস্থা, যেই লায়ন নিজের তীক্ষ্ণ টার্ন ও বাউন্স দিয়ে যেকোনো ব্যাটসম্যানকে ঘায়েল করার ব্যাপারে এতদিন চূড়ান্ত আত্মবিশ্বাসী ছিল সেই লায়ন তার পুরনো কোচকে জানালেন, তাকে দিয়ে আর হচ্ছে না। তিনি আর বলকে তার মত করে কথা বলাতে পারছেন না। বেরি তো হতভম্ব! লায়নের আত্মবিশ্বাস যে তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে বুঝতে বাকি থাকল না তার। লায়নের আরেক পুরনো কোচ ডেভিসনকে নিয়ে কাজ শুরু করতে বললেন তিনি। সামনের ভারত সফরকে কেন্দ্র করে ডেভিসন লায়নকে বললেন, সৌন্দর্য নয় এবার খোঁজো কদর্য। আধুনিক টি-টোয়েন্টি বোলারদের দেখো, পর্যবেক্ষণ কর। সবসময় ঐ পঞ্চম স্টাম্পের রাস্তায় না হেঁটে ব্যাটসম্যানকে কাট খেলতে দাও। স্পিনের প্রলোভন দেখিয়ে সোজা বল দাও। ডেভিসনের পাশাপাশি শেন ওয়াটসনের সাথেও আলোচনা করলেন লায়ন। ওয়াটসন তাকে ২০১৬ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ মাথায় রেখেই পরিবর্তন আনার কথা বলেন।

    তবে লায়নের ধ্যানজ্ঞ্যান তো সেই ভারত সফর। ভারতের মাটিতে তার সেই স্টক বলে হয়ত তিনি টার্ন পাবেন। তবে ভারতের ব্যাটসম্যানরা হরহামেশা সেসব বল খেলে। এমনকি সেই “পারফেক্ট” ডেলিভারি না হলে বল একটু ফুল হলে সপাটে তাকে সুইপ করা হবে, যা দেখিয়েছেন ইউনুস-মেন্ডিসরা। বল গুড লেংথে পড়লেও ভারতের র‍্যাঙ্ক টার্নার পিচে টার্নের প্রত্যাশাতেই খেলবেন সবাই। তাই দ্রুতই ব্যাকফুটে গিয়ে তাকে স্কয়ার দিয়ে কাট করতে থাকবেন পুজারা-কোহলিরা। আর খাটো লেংথে বল পড়লে তো বলের টিকিটিও খুঁজে পাওয়া যাবে না। ডেভিসন যা বলেছিলেন ভারতের মাটিতে সেটা যে জরুরি সেটা তিনি অনুধাবন করলেন। গোঁয়ার লায়ন হাটলেন “কুৎসিত” পথে। আর্ম বল পরিশিলিত করতে উঠে পড়ে লাগলেন। স্পিনের প্রলোভন দেখিয়ে করা সোজা বলের জন্য চলল নিরন্তর অনুশীলন। ডেভিসনের বাণী আত্মস্থ করে আশ্বিন-হেরাথদের বোলিং পর্যালোচনা করতে থাকলেন। হেরাথের মত পেসের তারতম্য বা আশ্বিনের মত অফ স্পিনের গ্রিপে দ্রুত ও সোজা বল ছাড়ার কৌশল রপ্ত করতে উঠেপড়ে লাগলেন। না, আশ্বিনের ক্যারম বল, দুসরা- ওসবের দিকে নজর দিয়ে নিজের শেকড় ভুলে যাওয়ার ভুল করেননি, হয়ত করতে চাননি।

    ২০১৭ সালের মার্চে শুরু হল সেই অগ্নিপরীক্ষা। স্টিভ ওয়াহ যেই ভারতকে আখ্যা দিয়েছিলেন যেই “ফাইনাল ফ্রন্টিয়ার” হিসেবে সেই দুর্গ জয়ের মিশনে ভারতে আসলেন স্টিভ স্মিথ বাহিনী।  শ্রীলঙ্কা সফরের হতাশা ঝেড়ে ফেলে স্মিথ আবারও চেয়ে থাকলেন লায়ন পানে। প্রথম ম্যাচে লায়ন তার সেই পরিশ্রমের ফসল একটু হলেও পেলেন। আর অস্ট্রেলিয়া পেল ৩৩৩ রানের বিশাল জয়। ম্যাচে ৫ উইকেট নিয়ে লায়ন সবে মৃদু এক বার্তা দিয়ে রাখলেন। বেঙ্গালুরুতে দ্বিতীয় টেস্টে দেখালেন আসল জাদু। নিষ্ঠার ফল পেলেন হাতেনাতে। লোকেশ রাহুল ছাড়া বাকিরা যেন লায়নের কাছে একেবারে দিশেহারা। ভারতের মাটিতে সফরকারী বোলারের সেরা বোলিং ফিগারের রেকর্ড গড়লেন সেবার তিনি (যা এখন আজাজ পাটেলের দখলে); একে একে ৮ জন ব্যাটসম্যানকে ধরাশায়ী করলেন মাত্র ৫০ রান গুনে। দ্বিতীয় ইনিংসে অবশ্য কোনও উইকেট না পেলেও জশ হেজলউডের ক্ষুরধার বোলিংয়ে অস্ট্রেলিয়ার সামনে তখন ১৮৮ রানের লক্ষ্য। লায়ন যখন ২-০ ব্যবধানে এগিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন দেখছেন ঠিক তখনই সিরিজে প্রথমবারের মত স্বরূপে ফিরল ভারত। আশ্বিনে নাকাল অস্ট্রেলিয়া হেরে বসল ৭৫ রানে। সেই যে সিরিজে ফিরল ভারত, এরপর ঠিকই ২-১ ব্যবধানে সিরিজ জিতে নিয়েছিল তারা। তবে স্মিথের সেই আনকোরা অস্ট্রেলিয়া লড়েছিল বুক চিতিয়ে; যেখানে পন্টিন-ক্লার্কদের ক্যাংগারুরা কোনও মত মুখ বাঁচিয়ে ফিরেছিল এর আগে। আর সেবার ৪ ম্যাচে ১৯ উইকেট নিয়ে অস্ট্রেলিয়ার যৌথ সর্বোচ্চ উইকেট শিকারি ঠিকই লায়ন।

    তবে এশিয়া মিশন যে তখনও শেষ হয়নি। পরের গন্তব্য-বাংলাদেশ। চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ইংল্যান্ড সবে নাজেহাল হয়ে ফিরেছে সেখান থেকে। “পম” দের খোঁটা দিতেও ছাড়ছে না অজিরা, আবার নিজেদের ভয়টাকেও পায়ে ঠেলে দিতে পারছে না। পা ফসকালেই যে সমালোচনার বাণে বিদ্ধ হবেন স্মিথরা। ঐযে কথায় আছে, যেখানে বাঘের ভয় সেখানে সন্ধ্যা হয়। বাঘের ডেরায় এসে অজিদের ক্রিকেটাঙ্গনে তাই ঠিকি সন্ধ্যা নেমে এলো। ডেভিড ওয়ার্নারের একরোখা ইনিংসও অজিদের বাঁচাতে পারল না  সাকিবদের করাল থাবা থেকে।  লায়ন অবশ্য আড়ালে আবডালে ঠিকই নিজের কাজ করে গেলেন। দ্বিতীয় ইনিংসে ৬ উইকেট সহ ম্যাচে নিলেন ৯ উইকেট। চূড়ান্ত লজ্জার হাত থেকে স্মিথকে বাঁচালেন তো শেষমেশ সেই লায়নই। দ্বিতীয় ম্যাচে নিলেন ১৩ উইকেট, হলেন ম্যাচসেরা। বাংলাদেশ সফরে হার এড়িয়ে যে স্মিথ ফিরলেন তার জন্য তো তাকে ঐ লায়নের কাছেই কৃতজ্ঞতা পোষণ করতে হল।

                                                            
                                                                              ***********************

    এশিয়ায় অকার্যকারিতার অপবাদ ঘুচিয়ে লায়ন এরপর হয়েছেন অস্ট্রেলিয়ার ওয়ার্ন-পরবর্তী যুগের অবিসংবাদিত সেরা স্পিনার। তবে লায়নের সামনে তখন আরেক পরীক্ষা। স্মিথ-ওয়ার্নারদের স্যান্ডপেপারগেটের পর দুজনেই প্রথম ফিরছেন আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে। প্রথম টেস্টে স্মিথ লিখলেন দুর্দান্ত প্রত্যাবর্তন গাঁথা; করলেন জোড়া সেঞ্চুরি। ইংল্যান্ডের মাঠে অ্যাশেজ রক্ষার দিকে চাতক পাখির মত তৃষিত দৃষ্টিতে চেয়ে থাকা অজিরা পেলো দুর্দান্ত শুরু। ২৫১ রানের জয়ে চারদিকে স্মিথ-বন্দনা। বরাবরের মতই তাই আড়ালে চলে গেলেন লায়ন। শেষ ইনিংসে ৬ উইকেটের পাশাপাশি ম্যাচে ৯ উইকেট নিয়ে তিনি থেকেছেন পার্শ্ব নায়ক হয়ে। কেউ হয়ত ভুলেও গিয়েছেন যে ঐ ইনিংসে বেন স্টোকসকে ফিরিয়ে ৩৫০ উইকেটের মাইলফলক স্পর্শ করেছিলেন তিনি। তবে ঐ স্টোকসের হেডিংলি-রুপকথাতেই অ্যাশেজ জেতা জয়নি অজিদের। যেই লক্ষ্য নিয়ে অজিরা এসেছিল তা অবশ্য পূরণ হয়েছিল। ২-২ ফলাফলের কারণে অ্যাশেজ ছিল তাদের হাতেই। আর সেই অর্জনে লায়ন তার ভূমিকা পালন করে গিয়েছেন কোনোরকম ডামাডোল ছাড়াই, সিরিজে ২০ উইকেট নিয়ে।

    ৩৫০ থেকে ৪০০- এর মাঝে লায়নকে এরপর পার করতে হয়েছে দুই বছরেরও বেশি। এর মাঝে ঋশাভ পান্ট তাকে গ্যাবায় দিয়েছেন আরও এক পাঠ। তবে ক্রিকেট মাঠের একনিষ্ঠ ছাত্র লায়ন সেই শিক্ষা নিয়েছেন দুহাত ভরেই। পরাজয়ের গ্লানিতে নুইয়ে পড়েননি। সাফল্য তার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল বটে, তবে হল ছাড়েননি। দীর্ঘ সময় পরে হলেও অবশেষে এলো সেই মাহেন্দ্রক্ষণ, সেটাও ম্যাচের মোড় ঘুরিয়েই। জো রুট-ডাভিড মালানের নাছোড়বান্দা জুটি ভাঙতে দিনের শুরু থেকেই সিলি মিড অফ নিয়ে বল করে যাচ্ছিলেন। মালান অবশ্য যেভাবে ফিরলেন তাতে সেই সুন্দর অফ স্পিনের ছাপ ছিল না। ৪০০ নম্বর উইকেটটা জুড়ে যেন ছিল পরিবর্তিত লায়নের ছাপ।  

    নতুন সেই লায়ন অস্ট্রেলিয়াকে তাই দিয়েছে ব্যাটিং আরও শক্তিশালী করার সুযোগ। অস্ট্রেলিয়া গত বেশ কিছু বছর খেলেছে ৪ বিশেষজ্ঞ বোলার নিয়ে। স্টার্ক-হেজলউড-কামিন্সদের বিধ্বংসী হয়ে ওঠার পেছনে যে লায়নের নিরন্তর স্পেলের অসামান্য অবদান তা আর যাই হোক অজি শিবির ঠিকই মানে। অস্ট্রেলিয়ার এই দলে লায়ন তাই অমূল্য। আর অস্ট্রেলিয়ার ইতিহাসের সেরা অফ স্পিনারের ৪০০ উইকেটের মাইলফলক ছোঁয়ার আনন্দে তাই ঠিকই তারস্বরে ধারাভাষ্য বক্সে উল্লাসে মেতে উঠেছেন অস্ট্রেলিয়ান ধারাভাষ্যকারেরা। দর্শকদের গ্যালারির মাঝে লায়ন মুখোশধারি সমর্থকদের অকুণ্ঠ সমর্থন ঠিকই পান তিনি। আর উইকেট কিপারের সাথে পুরো গ্যালারি চেঁচিয়ে ওঠে-”নাইস, গ্যারি!”