• অ্যাশেজ ২০২১-২০২২
  • " />

     

    উসমান খাওয়াজা: ‘লিভিং দ্য অস্ট্রেলিয়ান ড্রিম’

    উসমান খাওয়াজা: ‘লিভিং দ্য অস্ট্রেলিয়ান ড্রিম’    

    উসমান খাওয়াজা তখন আটকে আছেন  ৯৬* তে।   সঙ্গী ক্যামেরন গ্রিন তখন অন্য প্রান্তে স্ট্রাইকে। একের পর এক ডট দিয়ে শেষ বলে সিঙ্গেল নিলেন গ্রিন। স্ট্রাইক রাখলেন নিজের কাছে। পরপর দুই ওভার এমন হলো।  ওদিকে সিডনির দর্শকরা স্ট্রাইকে চাইছে খাওয়াজাকে। গোটা এসসিজিতে উঠলো ‘ দুয়োধ্বনির জোয়ার। 

    এর আগে প্রথম ইনিংসেও হয়েছিল একই দৃশ্যর মঞ্চায়ন। গ্রিনের জায়গায় ছিলেন অধিনায়ক প্যাট কামিন্স। খাওয়াজাকে ৯৯* তে রেখে শেষ বলে সিঙ্গেল নেন তিনি। ব্যস! আর দেখতে হয়নি। ‘বু’ শব্দে তখনও সরগরম ছিল সিডনি। ‘দুয়োধ্বনির’ আবহে দুই ইনিংসেই দর্শকরা যেন বলতে চেয়েছেন, ‘আমরা খাওয়াজার সেঞ্চুরি দেখতে এসেছি বাপু, তোমাদের ওই টুকটুক ব্যাটিং নয়’! 

    হ্যাঁ, গোটা এসসিজি দেখেছে খাওয়াজার সেঞ্চুরি, দুই ইনিংসে দুটি। অথচ চলতি অ্যাশেজের প্রথম তিন টেস্টের কোনোটিতে দলেই জায়গা পাননি।এর আগে টেস্ট খেলেছেন তাও প্রায় আড়াই বছর হবে। শেষ সেঞ্চুরির বয়সও চার বছর। এতদিন পর জাতীয় দলে ফিরে, দুই ইনিংসেই দুর্দান্ত সেঞ্চুরি। খাওয়াজাকে প্রশ্ন করাই যায়, এভাবেও ফিরে আসা যায়?

    Ashes 2022: Usman Khawaja, LeBron James, century, Australia vs England,  fourth Test, SCG

    উত্তরটা খাওয়াজা দিয়েছেন ব্যাট হাতেই। চার বছর পর  প্রথম সেঞ্চুরিটা উদযাপন করেছেন বাস্কেটবল তারকা লেব্রন জেমসের ‘Calmness’ স্টাইলে। তাকে কেন্দ্র করে পাক খেতে থাকা পাগলাটে হাওয়াটাকে শান্ত করেছেন যেন।  

    রাজকীয় এই প্রত্যাবর্তনের গল্পটা নিজ হাতেই লিখেছেন ৩৫ বছর বয়সী খাওয়াজা। অপেক্ষা ছিল কেবল একটা সুযোগের। অ্যাশেজ শুরুর আগে প্রধান নির্বাচক জর্জ বেইলিও জানান, খাওয়াজা কিংবা হেড; মিডল অর্ডারে খেলবেন যেকোনো একজন। হেড সুযোগ পান, খাওয়াজা থেকে যান উপেক্ষিত। শেষ পর্যন্ত সুযোগ পান তিনি, হেড করোনাক্রান্ত হওয়ায়।

    নির্বাচকদের ভরসা অর্জন করেই খাওয়াজার টেস্ট ক্যারিয়ার শুরু। প্রথমদিকে ধারাবাহিক ছিলেন না। প্রথম দশ টেস্টের একটিতেও ছিল  না হাফ সেঞ্চুরি। । গড়পড়তা ফর্মের জন্য ২০১৩ অ্যাশেজের মাঝপথেই প্রথম বাদ পড়েন দল থেকে। টানা দুই বছর বিরতির পর দলে ফেরেন। টানা তিন সেঞ্চুরিতে, সেই প্রত্যাবর্তনও মনে রাখার মতো। নির্বাচকরা আস্থা রাখেন তার ওপর।

    প্রতিদানের খাতায় কখনো হিসেব দিতে পারেন, কখনো পারেন না। সেঞ্চুরি আসে মাঝেসাঝে। কিন্তু নিয়মিত নয়। ইনিংস বড় করার সুযোগ আসে, খাওয়াজা ছিটকে পড়েন।  আউট হন, ৬০, ৭০, ৮০ কিংবা ৯০-এর ঘরে। ২০১৯ এর ফেব্রুয়ারিতে ক্যানবেরায় শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে সেঞ্চুরি করলেও, সেই বছরের অ্যাশেজে রানখরা প্রবল হয়ে ওঠে তার ব্যাটে। সিরিজের তিন টেস্ট খেলার পর  তার সর্বোচ্চ রান ৪০।  ফলস্বরূপ, দল থেকে বাদ পড়েন অ্যাশেজের লিডস টেস্টের পরই। 

     

    আড়াই বছর, বেশ লম্বা একটা সময়। শেষ ওয়ানডেও খেলছেন ২০১৯ সালে। ২০২০ -এ বাদ পড়েন অস্ট্রেলিয়ার কেন্দ্রীয় চুক্তি থেকেও। ফেরার সব দরজা বন্ধ নাকি! খাওয়াজা বললেন, ‘না’।

    ফক্স স্পোর্টসকে এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, ‘আমার এখনো মনে হয়, দেশের সেরা ছয় ব্যাটসম্যানের একজন আমি, কোনো প্রকার দাম্ভিকতা ছাড়াই বলছি।’ 

    খাওয়াজা ফিরেছেন, চতুর্থ টেস্টে। যদিও প্রিয় ওপেনিং স্লটটা পাননি। সেখানে ডেভিড ওয়ার্নারের সঙ্গী মার্কাস হ্যারিস। ব্যাটিং অর্ডারে জায়গা হলো পাঁচ নম্বরে। সেখানে যে দারুণ মানিয়ে নিয়েছেন, স্কোরকার্ডই তার অকাট্য দলিল। শেফিল্ড শিল্ডের গত মৌসুমের পাঁচ ম্যাচে চার নম্বর পজিশনে নেমে প্রায় ৬৬ গড়ে করেছেন ৪৬০ রান। টুর্নামেন্টের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। 

    শেফিল্ড শিল্ডের সেই ধারাবাহিকতা খাওয়াজা ধরে রেখেছেন, তা সবাই দেখেছেনই। এক ম্যাচে দুই সেঞ্চুরিতে ২৩৮ রান। নজরকাড়া ব্যাপার হচ্ছে, চলতি অ্যাশেজে ইংল্যান্ডের সব ব্যাটসম্যানের চেয়ে তার রান বেশি। ব্যতিক্রম কেবল  অধিনায়ক জো রুট। খাওয়াজার চেয়ে ১৫ রান বেশি তার। 

    পারফর্ম্যান্স নিয়ে খাওয়াজার বিপক্ষে অভিযোগ তো ছিলই। সাথে যোগ হয়েছিল ফিটনেস ইস্যুও। আট কেজি মেদ ঝেড়ে তিনি এখন ফিট। স্পিনের সামনে দুর্বল, এমন কথাও শুনেছেন। বছরখানেক আগে মুখে জবাব দিয়েছিলেন, ‘স্পিনের বিপক্ষে আমার ব্যাটিং দেশের সেরাদের মধ্যেই আছে। এগিয়ে আছে কেবল, স্টিভেন স্মিথ।’

    এবার ব্যাটেও জবাব দিলেন। ফুল টাইমার স্পিনার জ্যাক লিচকে তো ভালোই সামলেছেন। রুট-মালান; দুই পার্ট টাইমারকেও খেলেছেন নিজের মতোই। দুই ইনিংসের দুই সেঞ্চুরিও হাঁকিয়েছেন স্পিনারদের বলেই। দুবারই গর্জে উঠেছে সিডনির গ্যালারি। তার নাম ধরে চলেছে সমস্বরে চ্যান্টিং। দর্শকরা তাদের ঘরের ছেলেকে দিয়েছেন স্ট্যান্ডিং ওভেশন। হাততালি আর উল্লাসে জানিয়েছেন ভালোবাসা। তার স্ত্রী-কন্যাও গ্যালারি থেকে গলা ফাটিয়েছেন তার জন্য।

    দর্শক-সমর্থকদের এই ভালোবাসায় আপ্লূত হয়ে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতেও ভুলেননি খাওয়াজা। ভার্চুয়াল প্রেস কনফারেন্সে খাওয়াজা বলেছেন ‘নাম ধরে চ্যান্টিং, গর্জনের আওয়াজ; এসবের স্বপ্ন দেখাই যায়। কিন্তু এভাবে সত্যি হয়ে যাওয়ার প্রত্যাশা করে না কেউ। সেঞ্চুরির দেখা নিয়মিত পাওয়া যায় না। অনেক পরিশ্রমের পরই দেখা মিলে। পুরোটা সময়ই দারুণ সমর্থন পেয়েছি। গোটা ব্যাপারটাই অবিশ্বাস্য’।

    অবিশ্বাস্যই বটে। জন্মেছেন পাকিস্তানের ইসলামাবাদে। অস্ট্রেলিয়ায় সপরিবারে পাড়ি জমান সেই শৈশবে। পড়াশোনা করেছেন অ্যাভিয়েশনে। ক্রিকেটে আসার আগে ছিলেন লাইসেন্সড কমার্শিয়াল পাইলট। বিমানের ককপিট থেকে অস্ট্রেলিয়ার হয়ে ক্রিকেট মাঠের এই যাত্রাটা প্রতিনিয়তই মনে করেন খাওয়াজা।  পেছন ফিরে দেখতে পান অনেক বাধার দেয়াল, যা টপকে এসেছেন। অস্ট্রেলিয়ার হয়ে খেলছেন, ব্যাটও হাসছে। বিনিময়ে সমর্থকদের ভালোবাসা পাচ্ছেন। ‘উজি! উজি!’ চ্যান্টিংয়ে জমজমাট হয়ে উঠছে তার চারপাশ।  

    পড়তি ফর্মে জাতীয় দলে ব্রাত্য হয়ে পড়েছিলেন। একটা রাস্তাই খোলা ছিল, লেগে থাকা, চেষ্টা করে যাওয়া। খাওয়াজা তা করেছেন। ঘরের মাঠ সিডনিতে খেলেছেন ২০১৯ সালের জানুয়ারিতে। এরপর এই ভেন্যুতে আরো দুটি টেস্ট খেলেছে অস্ট্রেলিয়া। যে দুই ম্যাচে অস্ট্রেলিয়ার স্কোয়াডেই ছিলেন না খাওয়াজা। ‘নিজভূমে পরবাসী’ কথাটার মর্ম তিনি অনুভব করেছেন হয়তো।

    ওসব এখন পুরনো গল্প। নিজভূমে পরবাসী হয়ে ওঠা খাওয়াজা ফিরেছেন নিজের ঘরের মাঠেই। পায়ের নিচের ঝুরঝুরে মাটিটাও শক্ত হতে শুরু করেছে। সিডনি টেস্টে অমন পারফর্ম্যান্সের পর নির্বাচকরা তাকে দলের ছাউনির নিচে দীর্ঘদিন পেতে চাইবেন, তা হলপ করেই বলা যায়। ক্রিকেটে নতুন করে মাথা গোঁজার ঠাই হলো খাওয়াজার। 

     

    তাই তো নিজেই বলেছেন, ‘আই অ্যাম লিভিং দ্য অস্ট্রেলিয়ান ড্রিম’