সেই হ্যাভার্জের গোলেই ক্লাব বিশ্বকাপের দুঃখ ভুলল চেলসি
চেলসি ২:১ পালমেইরাস
ক্লাব বিশ্বকাপ মানেই ইউরোপের জয়জয়কার। সেমিফাইনাল থেকে টুর্নামেন্ট শুরু করা ইউরোপীয় চ্যাম্পিয়নরা এই বিশ্বকাপে কোনো ম্যাচ হারেনি গত আট বছরে।
তবে সর্বশেষ যে ইউরোপীয় দলটি এই টুর্নামেন্টের শিরোপা নিয়ে বাড়িতে ফিরতে পারেনি, সেই দলটির নাম আবার চেলসি। এই কারণেই হয়তো আবুধাবির বিন জায়েদ স্টেডিয়ামে কিছুটা স্নায়ুচাপ নিয়েই মাঠে নেমেছিল টমাস টুখেলের দল। তবে চ্যাম্পিয়নস লিগের মতো আরও একবার কাই হ্যাভার্জের গোলেই চেলসি পায় শিরোপা উদযাপনের সুযোগ। দক্ষিণ আমেরিকান চ্যাম্পিয়ন পালমেইরাস আন্ডারডগ হিসেবেই কোপা লিবের্তাদোরেস জিতেছিল । চেলসিকে কাঁপিয়ে দিয়েও তাদের পাওয়া হলো না ট্রফি।
স্বাভাবিকভাবেই বলের দখল রেখে ম্যাচ শুরু করে চেলসি। দুই উইংব্যাকের মাধ্যমে শুরুতে বেশ কয়েকবার আক্রমণেও আসে তারা। তবে ম্যাচে প্রথম বলার মতো আক্রমণটি করে ব্রাজিলিয়ানরাই।
২৪ মিনিটে পালমেইরাস তারকা দুদু একাই কাঁপিয়ে দেন চেলসির রক্ষণকে। দুই তিনজন চেলসি খেলোয়াড়কে পাশ কাটিয়ে ডিবক্সের বাইরে থেকে শট নেন দুদু। বাম পাশ থেকে করা তার বাঁকানো শট লক্ষ্য বধ না করলেও যায় পোস্টের গা ঘেঁষেই। কয়েক মিনিটের মধ্যে এরকম আরেকটি আক্রমণ করে পালমেইরাস।
প্রথমার্ধের বাকি সময়টুকু আর বলার মতো তেমন কোনো আক্রমণ না করেই কাটিয়ে দেয় দুই দল। তবে প্রথমার্ধের অতিরিক্ত সময়ে ন্যানো সেকেন্ডেন্য স্টেডিয়ামের ব্রাজিলীয় ভক্তদের রক্ত হিম করে দেন চেলসির ব্রাজিলিয়ান ডিফেন্ডার থিয়াগো সিলভা। ডিবক্সের বেশ বাইরে থেকে নেওয়া তার বুলেট গতির শটে ঝাঁপিয়ে পড়ে হালকা আঙুল ছোঁয়াতে সক্ষম হয় পাইমেইরাস কিপার উইভারটন। তার বীরত্বে গোলশূন্য স্কোরলাইন নিয়ে মধ্য বিরতিতে যায় দুই দল।
চেলসি দ্বিতীয়ার্ধ শুরু করে আক্রমণের মাধ্যমে। প্রথমার্ধের মতো দ্বিতীয়ার্ধেও চেলসির আক্রমণের একটি প্রধান চেহারা হয়ে উঠেন ক্যালাম হাডসন-ওডোয়। বামপাশের টাচলাইন ধরে এগিয়ে গিয়ে তার করা ক্রস বারবার জায়গা করে নিতে শুরু করে পালমেইরাসের বক্সে। এরকমই এক ক্রস থেকেই ম্যাচের প্রথম বড় আঘাত হানে চেলসি।
৫৪ মিনিটে হাডসন-ওডোয়ের করা এক ক্রস খুঁজে পায় রোমেলু লুকাকুর মাথা। সেমিফাইনালের মতো ফাইনালেও ম্যাচের প্রথম গোলটি করেন এই বেলজিয়ান।
তবে চেলসির উচ্ছ্বাস দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। প্রতিপক্ষ ব্রাজিলিয়ান দলটির জন্য লাইফলাইন হয়ে আসেন চেলসির ব্রাজিলিয়ান ডিফেন্ডারের এক ভুল। ৬১তম মিনিটে পালমেইরাসের নেওয়া এক কর্নারের সময় লাফিয়ে ওঠা থিয়াগো সিলভার হাতে স্পর্শ করে বল। খেলায় কোনো প্রভাব না ফেলা সেই স্পর্শকে প্রথমে রেফারি এড়িয়ে গেলেও পরবর্তীতে ভিএআরের পরামর্শে পালমেইরাসকে পেনাল্টি উপহার দেন তিনি।
আফকন ফেরত এডওয়ার্ড মেন্ডিকে অপর পাশে পাঠিয়ে সেই পেনাল্টি থেকে গোল করেন রাফায়েল ভেগা। সমতা ফিরে ম্যাচে।
পুরো ম্যাচের মতো নির্ধারিত সময়ের বাকি অংশজুড়েও চেলসির পায়েই থাকে সিংহভাগ বলের দখল। কিন্তু ম্যাচের গতি নির্ধারণ করে পালমেইরাস। চেলসি নিজেদের মাঝে প্রচুর বল পাসিং করলেও পালমেইরাসের বক্সের আশেপাশে যাওয়ামাত্রই প্রতিবার দুর্দান্ত প্রেসে তাদের ঘিরে ধরেছে ব্রাজিলিয়ানরা।
দ্বিতীয়ার্ধের যোগ করা সময়ে অবশ্য একাধারে আক্রমণ করে যেতে শুরু করে চেলসি। তবে এসব আক্রমণ কর্নার, ক্রস ও পাইমেইরাসের ক্লিয়ারেন্সের মাঝেই সীমাবদ্ধ থাকে। নির্ধারিত ৯০ মিনিট সমতায় শেষ হলে অতিরিক্ত সময়ে গড়ায় ম্যাচ।
অতিরিক্ত সময়ে যেন দুদলই কিছুটা নেতিয়ে পড়ে। তবে বদলি টিমো ভের্নার ও হাকিম জিয়েশের বদৌলতে আক্রমণে কিছুটা চাঞ্চল্য ধরে রাখে লন্ডনের দলটি।
অতিরিক্ত সময়ের দ্বিতীয়ার্ধে ভাগ্য বিধাতার দেখা পায় চেলসি। ১১৪ মিনিটে বক্সের ভেতর থেকে নেওয়া সিজার আজপিলিকোয়েটার শট গিয়ে লাগে পালমেইরাস ডিফেন্ডার লুয়ান গার্সিয়ার হাতে। এবারও প্রথমে ঘটনাটি এড়িয়ে যান রেফারি। কিন্তু ভিএআরের পরামর্শে চেলসিকে দেওয়া হয় পেনাল্টি।
ধীরস্থিরভাবে সেই পেনাল্টি নিতে আসা কাই হ্যাভার্জ কিপারকে ডানদিকে পাঠিয়ে বল পাঠান জালের বাম কোণে। বুনো উদযাপনে মেতে ওঠে চেলসি।
এই পেনাল্টিই শেষ পর্যন্ত ম্যাচের ভাগ্য গড়ে দেয়। ফলশ্রুতিতে প্রথমবারের মতো ক্লাব বিশ্বকাপের শিরোপা জেতে চেলসি। রোমান আব্রামোভিচ যুগে আর কোনো ট্রফি জেতাই বাকি নেই লন্ডনের ক্লাবটির।
কোভিড আইসোলেশন শেষে এই ম্যাচ দিয়েই ডাগআউটে ফেরা টমাস টুখেলের চেলসি ম্যানেজার হিসেবে তৃতীয় শিরোপা এটি। উয়েফা চ্যাম্পিয়ন্স লিগ, উয়েফার সুপার কাপ ও ক্লাব বিশ্বকাপ; ম্যানেজার হিসেবে মাত্র ৩৮২ দিনে তিনটি আন্তর্জাতিক শিরোপা জিতলেন এই জার্মান।
পালমেইরাসের জন্য এই শিরোপা অধরা থেকে গেলেও আবুধাবিকে মনে রাখার মতো একটি রাত উপহার দিয়েছে ক্লাবটির খেলোয়াড় ও দর্শকেরা। পালমেইরাস ভক্তদের রঙিন ও সরব উপস্থিতি মাতিয়ে রেখেছিল পুরো ম্যাচ। হ্যাভার্জের গোলের পর তাদের নীরবতা তাই থমথমে করে দিয়েছিল পুরো স্টেডিয়ামকেই। ইউরোপীয় ভক্তদের চেয়ে এই শিরোপা যে তাদের কাছে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ, তা বলে দিচ্ছিল ভক্তদের চোখের পানিই।
সবাই এক চেষ্টায় দৈত্যবধ করতে পারে না। চেলসি যেমন দ্বিতীয় চেষ্টায় পেরেছে এই বিশ্বকাপ জিততে, তা দেখে পালমেইরাস ভক্তরাও আশায় বুক বাঁধতে পারে। তাদের দলও হয়তো একদিন আবার ফিরবে, ক্লাব জগতের সর্বোচ্চ শিরোপাটি নিজেদের করে নিতে।