যেসব জায়গায় ফাইনালে বাজিমাত করেছে হার্দিকের গুজরাট
আইপিএলের ইতিহাসের অন্যতম সেরা দলীয় উপাখ্যানের পাতায় নিশ্চিতভাবেই থাকবে গুজরাট টাইটান্সের শিরোপা জয়ের গাঁথা। দলে সেই অর্থে ছিল না মহাতারকা। টি-টোয়েন্টির সেরা তারকাদের একজন হিসেবে হার্দিক পান্ডিয়াকে গণ্য করা হলেও ইনজুরি জর্জরিত মৌসুমের পর তাকে ঘিরে ছিল প্রশ্ন। তবে গুজরাট তার ওপর ভরসা করে তাকে দিয়েছিল অধিনায়কের গুরুদায়িত্ব। ডেভিড মিলারের মত খেলোয়াড়দের অনেকেই বাতিলের খাতায় ফেলে দিয়েছিল; নিলামেও মিলার বিক্রীত হয়েছিলেন শেষ রাউন্ডে এসে। রাহুল তেওয়াতিয়াকে এত চড়া দাম দিয়ে কেনার কারণে অনেক সমালোচকদের তির্যক কথার বাণ থেকে রেহাই পায়নি এই ফ্র্যাঞ্চাইজি। তবে আশিষ নেহরার তত্ত্বাবধানে নিজেদের কাজটা ঠিকই করে গিয়েছে এই দল। অভিজ্ঞতা ও তারুণ্যের মিশেলে গড়া এই দলের সবাই নিজেদের সামর্থ্যে আস্থা রেখে নিজেদের জায়গা থেকে সর্বোচ্চটা দিয়ে গিয়েছেন প্রায় প্রতি মাচে। আর সেই সেরাটা বের করে আনতে অধিনায়ক হার্দিকের ভুমিকা যে অপরিসীম সেটা নিয়ে দ্বিমত পোষণের খুব একটা সুযোগ নেই। ফাইনালেও দেখা মিল হার্দিকে উদ্দীপিত এক গুজরাটের। ফাইনালটাও তারা জিতল দাপট দেখিয়েই। আর কোথায় কোথায় প্রাধান্য বিস্তার করে রাজস্থানকে মৌসুমে ৪র্থ বারের মত হারিয়ে শিরোপা তুলল গুজরাট সেটাই দেখে আসা যাক।
হার্দিক পান্ডিয়ার মারণঘাতি স্পেল
প্রথম বলেই লকি ফার্গুসনের ১৫০+ কিমি. গতির গোলা মিড অনের ওপর দিয়ে চার মেরে রাজস্থান অধিনায়ক সাঞ্জু স্যামসন ইঙ্গিত দিচ্ছিলেন আর একটি ঝড়ো ইনিংসের। এই মৌসুমে প্রায় ১৫০ স্ট্রাইক রেটে ব্যাট করা স্যামসনের জন্যই অনেক ম্যাচে জস বাটলার পেয়েছেন সময় নিয়ে খেলার সুযোগ। তবে এদিন যে গুজরাট অধিনায়কের মনে ছিল নিজেকে প্রমাণ করার তাড়না। রাজস্থানের সবচেয়ে দুর্ধর্ষ জুটিকে শুরুতেই ভেঙে দেওয়ার জন্য নিজেই বল হাতে তুলে নিলেন হার্দিক। গুড লেংথে সজোরে বল ফেলার তার যে সক্ষমতা সেটাই কাজে লাগানোর চেষ্টা করলেন শুরু থেকেই। আহমেদাবাদের উইকেটে সেটা কাজেও দিল শুরু থেকেই। আড়াআড়ি ব্যাটে খেলতে গিয়ে ১০ রানে বিদায় নিলেন স্যামসন। অন্য প্রান্তে থাকা বাটলার যখন আরও একটি ফিফটির দিকে ধীর পায়ে এগিয়ে যাচ্ছেন তখন বোলিংয়ে ফিরে এসে সেই একই লেংথে তাকে পরাস্ত করে উইকেটের পিছে তালুবন্দি করলেন হার্দিক। দুর্দান্ত এক স্পেলের শেষ অভারে শিমরন হেটমায়ার তাকে দুটি চার মারলেও শেষ বলে সেই একই লেংথে তাকে কাবু করেন হার্দিক। শেষ হয় ফাইনালের অন্যতম সেরা এক স্পেল। অধিনায়ক হার্দিক সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়ে শেষ করেন দারুণ বোলিং ফিগার নিয়ে: ৪-০-১৭-৩।
আরও একটি ফাইনাল, রশিদের আরও একটি কিপটে স্পেল
প্লেঅফ/নকআউট পর্বে রশিদ খানের রেকর্ড নিয়ে প্রশ্ন তলার বোধহয় খুব বেশি মানুষ নেই। শেষ যেবার ফাইনাল খেলেছিলেন সেবার উইকেট না পেলেও এক মেইডেন সহ দিয়েছিলেন ২৪ রান। এই ফাইনালেও হতাশ করেননি রশিদ। বাটলারের বিরুদ্ধে তার রেকর্ডের কথা মাথায় রেখেই রশিদকে আনা হয়েছিল পাওয়ারপ্লের শেষ ওভারে। সাই কিশোরের পা গলে একটি বাউন্ডারি বের হয়ে যাওয়া ছাড়া শুরুটা হয়েছিল দুর্দান্ত। মাঝে দেবদূত পাডিক্কালকে ধুঁকতে দেখে হার্দিক তাকে আক্রমণে আনতেই ঠিকই পাডিক্কালকে ফেরান তিনি। পরে হেটমায়ারে নিশ্চুপ রাখতে তাকে আক্রমণে আনা হলে সেই স্পেলেও হতাশ করেননি রশিদ। অসাধারণ এক স্পেল শেষে তার বোলিং ফিগার ছিল: ৪-০-১৮-১।
হার্দিকের অধিনায়কত্ব
এদিন যেখানেই হার্দিক হাত দিয়েছেন সেখানেই যেন মিলেছে সোনার দেখা। ফাইনালে তার অধিনায়কত্ব নিয়ে আলাদা করে কথা বলতেই হয়। রাজস্থানের কোন ব্যাটারের বিরুদ্ধে তার তুরুপের তাস রশিদের রেকর্ড ভাল, কারা গুড লেংথের বলে দুর্বল - এসবই যেন ছিল তার মাথায় গাঁথা। পাওয়ারপ্লেতে সেই অর্থে লাগামছাড়া হতে না পারা বাটলার যে শেষ ওভারে আক্রমণের চিন্তা করতে পারেন সেটা তিনি মাথায় রেখেছিলেন; একই সাথে উইকেটেও স্যামসন তখন নতুন। স্যামসন রশিদের বিরুদ্ধে মাত্র ১ বার উইকেট দিলেও তার স্ট্রাইক রেট ছিল ৯৪। অন্য দিকে রশিদের বিরুদ্ধে বাটলার ৪ বার আউট হয়ে রান করতে পেরেছেন এর আগে মোটে ২৪! পাওয়ারপ্লের শেষ ওভারে তাই রশিদকে আনার ফাটকা খেললেন। ওই ওভারে উইকেট না পেলেও রশিদ বেঁধে রেখেছিলেন দুজনকেই।
এরপরে বলতে হয় দেবদূত পাডিক্কালের ১০ বলে ২ রানের ইনিংসের কথা, যেখানে তার বোলিংয়ের ভুমিকা অসামান্য। ডিপ ব্যাকওয়ার্ড স্কয়্যার লেগ ও ডিপ ফাইন লেগ রেখেছিলন প্রায় পুরো সময়, আর বল ফেলে গিয়েছিলেন গুড লেংথে পাডিক্কালের পাজর বরাবর। কোণঠাসা পাডিক্কাল জায়গা বানিয়েও হাঁসফাঁস করছিলেন। সুযোগ তুলতেই রশিদকে আক্রমনে ফেরালেন হার্দিক; ফলাফল পেলে সাথে সাথেই। আবারও জায়গা বানিয়ে কাট করতে গেলেও রশিদের ফ্লিপার পড়তে না পেরে ব্যাকওয়ার্ড পয়েন্টে ক্যাচ অনুশীলনের সুযোগ দিয়ে ফেরেন তিনি।
রাজস্থান যখন একেবারেই কোণঠাসা তখন তাদের যে রক্ষা করতে পারতেন সেই হেটমায়ারও এর আগে রশিদের কাছে ৪ বার আউট হয়েছিলেন। সমীকরণটা মাথায় রেখে রশিদকে আক্রমণে আনতেই খোলসবন্দী হয়ে থাকেন হেটমায়ার। আর সেটার ফসল অন্য প্রান্তে তুলেছিলেন হার্দিক নিজেই। অধিনায়কত্বে এদিন হার্দিক যেন নিজের সর্বোচ্চটাই ঢেলে দিয়েছিলেন।
গিল-হার্দিকের ঠান্ডা মাথার ব্যাটিং
শুধু আইপিএল কেন, টি-টোয়েন্টিতেই প্রথম ওভারের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর বোলারদের একজন ট্রেন্ট বোল্ট। স্বল্প পুঁজি নিয়ে বাজিমাত করতে তার দিকেই তাকিয়ে থাকা রাজস্থানকে প্রথম ওভারেই উদযাপনের উপলক্ষ এনে দিয়েছিলেন প্রায়। তবে শুবমন গিলের ব্যাট-প্যাড হওয়া ক্যাচটা নিতে পারেননি যুজবেন্দ্র চেহেল। সেটার মাশুল পরে দিতে হয়েছে কী করুণভাবে! বোল্ট ঠিকই নিজের কাজ করেছেন দুর্দান্তভাবেই। নিজের চার ওভারের কোটা পূর্ণ করে মাত্র ১৪ রান দিয়েছিলেন; ১ মেইডেনসহ নিয়েছিলেন ম্যাথিউ ওয়েডের উইকেটও। তবে ওই গিলের সাথে যোগ দিয়ে হার্দিক
ম্যাচ প্রায় শেষ করেই দিয়ে গিয়েছেন। দুজনের কেউই তেড়েফুঁড়ে আক্রমণে যাননি। বোলার বুঝে, নিয়মিত প্রান্ত বদল করে প্রয়োজনীয় রান রেটের মাঝেই খেলে গিয়েছেন ঠান্ডা মাথায়। চেহেলের ঘূর্ণিতে ৩০ বলে ৩৪ রান করার পর হার্দিক ফিরলেও ম্যাচ শেষ করা ছয়টা এসেছে ৪৩ বলে ৪৫* রানে অপরাজিত থাকা গিলের ব্যাট থেকেই।
মিলারের আরও একটি ফিনিশ
১৪তম ওভারে হার্দিক যখন ফিরলেন তখন প্রয়োজনীয় রান রেট ছুঁয়েছে ৭-এর কোটা। উইকেটে নতুন বাটারের সুযোগ নিয়ে চেপে বসার সুযোগও পেয়েছিল রাজস্থান। দুর্দান্ত ফর্মে থাকা ডেভিড মিলারের অবশ্য সেসবের বালাই ছিল না। জয়ের জন্য বদ্ধপরিকর মিলার ম্যাচের ওই অধ্যায় সামলেছেন শান্তভাবেই। ১৬তম ও ১৭তম ওভারে রবিচন্দ্রন আশ্বিন ও প্রাসিধ কৃষ্ণার খারাপ বলগুলো মাঠছাড়া করে তিনি বিপদের কোনও সুযোগও দেননি। গুজরাট যে শেষটা অনায়াসে করে এসেছে তার পেছনে মিলারের ১৯ বলে ৩২* রানের ভুমিকা বেশ বড়।