• বাংলাদেশের জিম্বাবুয়ে সফর
  • " />

     

    যেভাবে সাকিব-মাহমুদউল্লাহকে মনে করিয়ে দিলেন রাজা-চাকাবভা

    যেভাবে সাকিব-মাহমুদউল্লাহকে মনে করিয়ে দিলেন রাজা-চাকাবভা    

    সিকান্দার রাজার প্র‍্যাঙ্ক করতে ভালো লাগে। কদিন আগেই রেজিস চাকাবভাকে তিনি আর তার আরেক বন্ধু ক্রেইগ আরভিন মিলে বললেন, গলফ খেলতে যাবেন। চাকাবভা তো সেজেগুজে প্রস্তত৷ রাজা, আরভিন মিলে হাসলেনই শুধু এরপর…কিন্ত চাকাবভা সেদিন বেশ বিরক্তই হয়েছিলেন।

    আরেকদিন জিম্বাবুয়ে বিশ্বকাপ কোয়ালিফায়ারের ফাইনাল জিতেছে। আরভিন যাচ্ছেন প্রেজেন্টেশনে কথা বলতে। চাকাবভাকে রাজা বললেন, মেডেল দিবে, আরভিনের পেছন পেছন যেতে। চাকাবভাও যেতে লাগলেন৷ কিছুক্ষণ পর আবিস্কার করলেন, পেছনে দাঁড়িয়ে পুরো দলের হাসিতে ফেটে পড়ার অবস্থা! 

    বাংলাদেশের সঙ্গে এই সিরিজের সময়ে চাকাবভার সাথে রাজা কোন 'প্র‍্যাঙ্ক' করলেন কি না, কে জানে! তবে রাজা যদি চাকাবভাকে বলতেন, জিম্বাবুয়ে প্রথম দুই ম্যাচেই ওয়ানডে সিরিজ জিতে নিবে, তাহলে সেটি কি মনেপ্রাণে 'সিরিয়াসলি' নিতে পারতেন চাকাবভা? আর সেই সাথে যদি বলতেন, জিম্বাবুয়ের ইতিহাসের দ্রুততম সেঞ্চুরি হাকিয়ে সে সিরিজ জয় নিশ্চিতে সাহায্য করবেন চাকাবভা, তবে সেটি চাকাবভার কাছে 'প্র‍্যাঙ্ক' রুপেই দেখা দিত হয়তো!

    ***

    মাঠে নামলে তো আর র‍্যাংকিংয়ের হিসাব-কিতাবে খেলা হয় না। স্কিলের সাথে দরকার পড়ে বিশ্বাস, লড়াইয়ের পণ, এবং কিছু পাওয়ার আকাঙ্কা। পনেরো নাম্বারে থাকা জিম্বাবুয়েরও তাই বিশ্বাস করেই নামতে হয়, জেতা সম্ভব। ২৯১ রানের লক্ষ্যতাড়ায় নেমে ৪৯ রানে চার উইকেট হারানোর পরেও নিজেকে বিশ্বাস করান রাজা ও চাকাবভা, সম্ভব। 

    সাধারণত চাকাবভা ওপেনিংই করেন, এদিন তাকে কোচেরা রেখে দিলেন মিডল-অর্ডারে। পঞ্চাশের কম রানে চারজনের বিদায় দেখার পরে চাকাবভা ক্রিজে এসে দেখতে পেলেন, অন্য পাশে সিকান্দার রাজাকেও তাসকিনরা চেপে রেখেছেন। রাজা ও চাকাবভা মাঠে জুটি গড়েছেন এর আগে মাত্র সাতবার, তার মধ্যে সর্বোচ্চ জুটি ৬৪ রানের। আর এদিন এ দুজনের কাঁধেই ভর করছিল জিম্বাবুয়ের সব আশা-ভরসা। 

    খেলাটা রাজা খেলেছেন বাংলাদেশের বিপক্ষেই। কিন্ত আদতে তো সে লড়াইটা হয়েছে ভাগেভাগে। রাজার লড়াইটা যে পাঁচ বোলারের সঙ্গে ছিল, তার মধ্যে কিছুটা হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছিল শুধুই মেহেদী–তাইজুল স্পিনজুটি। ওই লড়াইটা জিতে যাওয়াতেই রাজার মূল লড়াইটাই জেতা হয়ে গেছে। যেটি বাংলাদেশের কোচের চোখে ম্যাচে বড় পার্থক্য। তিন পেসার মিলে তো আর তাকে কোন ভয়ই দেখাতে পারেননি। ইনিংসের শুরুতে যা একটু পেরেছিলেন তাসকিন। তাসকিন রাজার সামনে বাউন্ডারি ছাড়া ২৮ বল করে দিয়েছেনও ১৯ রান। হাসান মাহমুদ ও শরিফুলের অবস্থা তো ছিল একেবারেই নাজুক। হাসান মাহমুদ ১৪ বল করেই দিয়ে ফেলেছেন ২১ রান, আর শরিফুল ২৪ বলে ২৭। 

    রাজার সামনে পেসাররা নির্বিষ ঠেকলেও মিরাজ-তাইজুল কার্যকরই ছিলেন। তাইজুল যখন ১৫তম ওভারে প্রথম বোলিংয়ে আসেন, তখন থেকে- তাইজুলের বিপক্ষে রাজা শুরুর ২০ বলে মাত্র পাঁচ সিঙ্গেলই বের করতে পেরেছিলেন। মিরাজের রাজার সামনে শুরুর স্পেলে ১৪ বলে কেবল ৫ সিঙ্গেলই বের করতে পারেন রাজা। অথচ প্রথম ওয়ানডেতে রাজার বিরুদ্ধে লড়াইটায় মুখ তুলে দাঁড়াতেই পারেননি মিরাজ। ২৫ বলে ডট দিতে পেরেছিলেন মাত্র ৫টি। সহজেই সিঙ্গেল বের করে নিচ্ছিলেন রাজা, সেই সাথে সুযোগেই বাউন্ডারি খুঁজে নিয়ে তিন চার ও এক ছয়ে মিরাজের থেকে মোট ৩৭ রান নিয়েছিলেন রাজা। 

    দ্বিতীয় ওয়ানডেতে রাজাকে কিছুটা বেঁধে রাখতে সক্ষম হন মিরাজ। রাউন্ড দ্যা উইকেট থেকে এঙ্গেল তৈরি করে দুর্দান্তভাবে বল করে যান। রাজার সিঙ্গেল নেওয়ার সব অপশনই বলতে গেলে বন্ধ করে দিয়েছিলেন টাইট লেংথে বল করে। প্রথম ওয়ানডেতে একজন বাঁহাতি স্পিনারের অভাব বোধ করেছিল বাংলাদেশ, এদিন যেন তাইজুল সেটির মাত্রা আরও বাড়িয়ে দিলেন তাঁর বোলিং দিয়ে। প্রায় ৬৫ শতাংশ বল ডট দিয়েছেন তাইজুল। পেস ভ্যারিয়েশনের সঙ্গে জোরের উপর আর্ম বলও করে যাচ্ছিলেন, যা রাজাকে সবসময় ধন্দে রেখে আক্রমণাত্মক হওয়া থেকে রুখেছিল। 

    রাজাও রানের জন্য হাঁসফাঁস করেননি, অতিরঞ্জিত কিছু করার চেষ্টা দেখা যায়নি তাঁর মাঝে। ওই সময়টা ধৈর্য ধরেই কাটিয়ে দিয়েছেন, তবে নিজের জায়গামতো পেলেই বাউন্ডারি আদায়ও করে নিয়েছেন। তাইজুল ও মিরাজ জুটিকে মেরেছেন দুটি চার ও তিনটি ছয়। তাইজুলের বিপক্ষে ৩৭ বলে যে ২৬ রান করেছেন রাজা, তার ১৬ রানই এসেছে বাউন্ডারি থেকে। ‘ক্যালকুলেটিভ ক্রিকেট’ খেলে মিরাজ-তাইজুলের সঙ্গে সে লড়াইটাও জিতে যান। পুরো লড়াইয়ের মাঝে তাদের এই লড়াইটাও বেশ উপভোগ্য হয়ে উঠেছিল। রাজার সামনে তাসকিনের শুরুর স্পেল ছাড়া বাকি পেসারদের সঙ্গে তো আদতে কোন লড়াই-ই হয়নি রাজার! যখনই চাপ তৈরি হয়েছে, এক প্রান্ত থেকে রান প্রসবিত হয়ে সেই চাপ উড়ে গেছে রাজাদের গা থেকে। 

    চাকাবভা পুরো ইনিংস জুড়েই আক্রমণের কাজটা সামলেছেন। আউট হওয়ার আগে যে ৭৪ বল খেলেছেন, তার মধ্যে মাত্র ১৮টিতেই রান নিতে পারেননি। নিয়মিত স্ট্রাইক বদলের সাথে বাউন্ডারিও হাকানোতেও তার পূর্ণ মনযোগ ছিল। ১০টি চারের সাথে মারেন দুটি ছয়। সবাইকেই খেলে গেছেন স্বাচ্ছন্দ্যে। তিন পেসারের ৩৯ বল থেকেই তো নিয়েছেন ৬৭ রান। তাইজুল-মেহেদীর থেকেও এনেছেন বলপ্রতি রানের বেশি। ম্যাচশেষে বাংলাদেশ কোচ রাসেল ডোমিঙ্গোর মুখেও শোনা গেছে প্রশংসা, ‘বড় পার্থক্য ছিল, ওরা আমাদের স্পিনারদের ভালো খেলেছে।’

    ***

    রাজা ও চাকাবভার সুযোগ ছিল সাকিব-মাহমুদউল্লাহকে ছাড়িয়ে যাওয়ার। অনুমান করার চেষ্টা করুন তো! কার্ডিফে সাকিব-মাহমুদউল্লাহ যেদিন ২২৪ রানের মহাকাব্যিক জুটি লিখেছিলেন, সেদিন বাংলাদেশ যে ৩৩ রানেই চার উইকেট হারিয়েছিল। পঞ্চাশের কমে চার উইকেট হারানোর পর পঞ্চম উইকেটে সর্বোচ্চ জুটিটা ২২৬ রানের, দ্বিতীয় স্থানে সাকিব-মাহমুদউল্লাহর জুটি। 

    চাকাবভা সেঞ্চুরি হাঁকিয়ে আউট হয়ে গেলে তাদের ছাড়িয়ে যাওয়া হয় না রাজাদের। তবে তাতেই তো দুই বন্ধুর মিলে করা ২০১ রানের পার্টনারশিপটা এক মহাকাব্যিক রুপ নিয়েই ফেলেছে, জিম্বাবুয়ে ক্রিকেটের বাস্তবতায়। জিম্বাবুয়ের ওয়ানডে ইতিহাসে তৃতীয় সর্বোচ্চ রানের জুটিও সেটিই। 

    ***

    রাজা ও চাকাবভার আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারের শুরুটা একসাথে না হলেও তাদের বন্ধুত্বটা বেশ পুরোনোই। দুজনেই ঘরোয়া ক্রিকেটে একই দলের হয়ে খেলতেন। বয়সের হিসাবেও তাদের পার্থক্য খুব একটা নেই।  ২০১৩ সালের পর বাংলাদেশের বিপক্ষে প্রথম সিরিজ জয় যখন নিশ্চিত করছে তাদের পার্টনারশিপ, তখন দুজনেই দলে সিনিয়র সদস্য। পঞ্চাশের মতো ওয়ানডে খেলা হয়ে গেছে চাকাবভার, তবে গড় তার বিশের উপরে যায়নি এখনো। স্ট্রাইক রেটটা ৬৫ এর আশেপাশেই আছে, সেই চাকাবভাই রোববারের এক বিকেলে হারারেতে উল্লাসের হাওয়া বইয়ে দিলেন, খেললেন জিম্বাবুয়ের হয়ে দ্রুততম ওয়ানডে সেঞ্চুরির ইনিংস। 

    ৪৯ রানে চার উইকেট, সেখান থেকে ম্যাচ জিতিয়ে মাঠ ছাড়া। সিকান্দার রাজার ইনিংসের মাহাত্ম্য বুঝাতে এই প্রেক্ষাপটটাই যথেষ্ট। তবে এই যে লড়াইয়ের মধ্যেও যেভাবে তিনি ছোট্ট লড়াই জিতলেন, সেই পরীক্ষায় পাশেরও তো প্রশংসা করতে হয়। তাইজুল-মেহেদীর স্পিনে পরীক্ষা দেওয়ার আগে তিনিও নিজেও তো বাংলাদেশি ব্যাটসম্যানদের পরীক্ষা নিয়েছেন। ডেথ ওভারে বল করেছেন, আফিফ-মাহমুদুল্লাহর ৮১ রানের জুটি ভেঙ্গেছেন। তিন উইকেট পেয়েছেন ৫৬ রানে, এরপর অপরাজিত ১১৭ রান করে বিজয়ের হুঙ্কার দেওয়া! 

    একই ম্যাচে শতক ও কমপক্ষে তিন উইকেট নেওয়ার অলরাউন্ড কীর্তি আছে ওয়ানডে ক্রিকেটে মোট ৩৭ জনের। তবে এর মধ্যে রান তাড়ায় ম্যাচ জিতিয়ে মাঠ ছাড়তে পেরেছেন কেবলই ১০ জন। রাজাও তাদের মধ্যে একজন এবং জিম্বাবুয়ের প্রথম!

    এমন ম্যাচের গল্প যদি চাকাবভাকে শোনাতেন রাজা, তবে কি সেটি তার কাছে 'প্র‍্যাঙ্ক' এর মতোই শুনাতো না? রাজা যে ফর্মে আছেন, টি-টোয়েন্টি ওয়ার্ল্ড কাপ কোয়ালিফায়ারে সেরা খেলোয়াড় হওয়ার পরে বাংলাদেশের বিপক্ষে টি-টোয়েন্টি সিরিজেও সেরা খেলোয়াড়, আগের ম্যাচে সেঞ্চুরি হাঁকিয়ে জেতানো, জীবনের সেরা ফর্মে থাকা রাজাকে এমন কোন স্ক্রিপ্ট শোনালে হয়তো তার কাছে তা 'প্র‍্যাঙ্ক' মনে না-ই হতে পারে তাই! রাজার জীবনে তা হয়তো আজকাল স্বাভাবিকই।