পাকিস্তানের 'সিকান্দার', জিম্বাবুয়ের 'রাজা'
একটা দুঃস্বপ্ন আছে সিকান্দার রাজার জীবনে। রাজার মনে হয়, সারাজীবনই সে দুঃস্বপ্ন তার সঙ্গে জুড়ে থাকবে।
শেষ বলে ছয়। ২০১৯ বিশ্বকাপে নাম লেখানোর জন্য জিম্বাবুয়ের প্রয়োজনটা নেমে এসেছিল এটুকুতেই। আরব আমিরাতের সঙ্গে ওই শেষ বলে দুই রানের বেশি আসেনি। তবে এসে যায় এক দুঃস্বপ্ন। সেই টুর্নামেন্টে ৬ ম্যাচে ১২ উইকেট ও ১৯৬ রান নিয়ে সেরা খেলোয়াড় হয়েছিলেন রাজাই।
টুর্নামেন্ট সেরার পুরস্কার নিতে এসে বোধহয় এতটা নিরাশা প্রকাশ করেননি আর কেউই। সেবারই বিশ্বকাপ নেমে এসেছিল চৌদ্দ থেকে দশ দলে। যা নিয়ে নিজের ক্ষোভ, হতাশা প্রকাশ করেছিলেন রাজা, সকল সহযোগী দেশের পক্ষ নিয়ে আইসিসি কর্মকর্তার সামনেই। তখনই বলেছিলেন, ওই পুরস্কারটা তাকে এই দুঃস্বপ্নের কথা মনে করিয়ে দেওয়ার কাজটাই করবে কেবল। ওই ম্যান অব দ্যা টুর্নামেন্টের অর্থ তাঁর জীবনে বদলে হয়ে গিয়েছিল- এক বেদনাদায়ক স্মৃতিচিহ্ন!
বিশ্বকাপ থেকে জিম্বাবুয়ের বাদ পড়া যে রাজাকে তার জীবনের সবচেয়ে বেদনাদায়ক স্মৃতি দিয়েছিল, সেই রাজার জন্মস্থানই জিম্বাবুয়ে নয়। সেই রাজার জীবনের লক্ষ্য, উদ্দেশ্য, স্বপ্ন কিছুতেই ক্রিকেট ছিল না। তবে নিয়তির খেলায় খেলায় ক্রিকেটে স্বপ্ন না দেখা জিম্বাবুয়ের 'রাজা'তেই স্বপ্ন দেখতে পারে জিম্বাবুয়েইনরা।
***
তার গল্পটা অন্যরকম। কখনো স্কুল ফাঁকি দেননি রাজা। পড়াশোনায় মনযোগী এক ছাত্র। তার স্বপ্নে যে ক্রিকেটের অস্তিত্ব নেই, সেটা তাই খুব অবাক করার কিছু নয়। তবে জন্ম পাকিস্তানের শিয়ালকোটে, তবু স্বপ্নে ক্রিকেট নেই, সেটি হয়তো অবাক করতে পারার মতোই ঘটনা।
সিকান্দার নামের যা যা অর্থ পাওয়া যায় অন্তর্জালে, তার মধ্যে আছে 'যোদ্ধা', 'রক্ষক'। সিকান্দার রাজার যা স্বপ্ন ছিল তা যোদ্ধা কিংবা রক্ষক হওয়ারই। মনেপ্রাণেই হতে চেয়েছিলেন যুদ্ধবিমান চালক। 'ফাইটার পাইলট' হয়ে দেশকে রক্ষা করার স্বপ্নটা দেখে ফেলেন এগারো বছর বয়সেই। বাবা-মাকে বললে সমর্থনও পেয়ে গেলেন।
পাকিস্তান এয়ার ফোর্সের এক স্কুলে ভর্তি হলেন দশ হাজারের বেশি প্রতিযোগীর মাঝে ষাটজনের একজন হয়ে। সাড়ে তিন বছর পার করেও দিলেন। কিন্ত এরপর যে চোখ দিয়েই দেখে রাজা বল পেঠান দুর্ধষভাবে, সেই চোখেরই এক ত্রুটি ধরা পড়লো, যা সাধারণত দশজনের সাতজনেরই থাকে বলে তাকে জানানো হলো। যুদ্ধবিমান চালানোর জন্য আনফিট বলে দেয়া হলো রাজাকে। রাজার স্বপ্নের ঘরে তালা লেগে গেলো আজীবনের জন্য। তার কাছে সুযোগ ছিল অবশ্য, এয়ার ফোর্সের সঙ্গে যেকোনভাবে জড়িয়ে থাকার। কিন্ত রাজা যে শুধুই আকাশে যুদ্ধবিমান উড়াতে চেয়েছিলেন!
তার বাবা ব্যবসা করতেন। ব্যবসার কাজে গিয়েছিলেন জিম্বাবুয়েতে, তখন ২০০২ সাল। জিম্বাবুয়েতে গিয়ে তার বাবা পরিবার নিয়ে স্থায়ী হওয়ার পরিকল্পনাও করে ফেললেন। রাজারা পাড়ি জমালেন জিম্বাবুয়েতে।
***
পাকিস্তানে এক স্বপ্নভঙ্গ হয়েছে রাজার। নতুন আবাস জিম্বাবুয়েতে গিয়েই নতুন স্বপ্ন জন্ম নিবে রাজার জীবনে? সেই স্বপ্ন হবে ক্রিকেট নিয়ে, কেউ একজনের নজরে একদিন পড়ে যাবে তার প্রতিভা, জিম্বাবুয়েতে ঘরোয়া ক্রিকেটে ঝলক দেখিয়ে জাতীয় দলে! গল্পটা যদি এমনই হতো, তবে কি আর তা অন্যরকম হতো!
রাজা চলে যান স্কটল্যান্ডে। সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে। সেখানেই টুকটাক ক্রিকেট খেলতেন। ক্লাব লেভেলে ক্রিকেট খেলেছিলেন। সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারিং পড়লেও জানতেন, এই জগতেই তিনি থাকতে চান না। যুক্তরাজ্যে একটা ভালো মৌসুম কাটানোর পরে পরিবারকে তাই জানালেন, ক্রিকেটে 'ট্রাই' করে দেখতে চান! ২০০৭ সালে প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে অভিষেক করে ফেলেছিলেন, তবে তখনও পুরোদমে ক্রিকেটে নেমে পড়েননি। গ্র্যাজুয়েশন শেষ করে যখন ফিরলেন আবার জিম্বাবুয়েতে, সময়টা তখন ২০০৯ সাল। পুরোদমে ক্রিকেট শুরু করলেও তখনও যদিও ক্রিকেটেই নিজের ভবিষ্যত দেখছিলেন না রাজা।
জিম্বাবুয়েতে ফিরে ম্যাশ ইগলস বি দলে সুযোগ পেয়েছিলেন, তবে রাজার কথায় সেই টুর্নামেন্টে পারফরম্যান্স নাকি 'অত্যন্ত খারাপ'ই হয়েছিল তার! এরপর একদিন প্র্যাকটিস করছিলেন। সেই 'কেউ একজনের নজরে এলো মোর প্রতিভা' পর্ব চলে আসে রাজার জীবনে। সেই 'কেউ একজন' ছিলেন তখনকার সাউথার্ন রকসের সিইও। তিনি বলে গেলেন, পরদিন ট্রায়ালে হাজির থেকো, সাউথার্ন রকসের বিবেচনায় যদি থাকতে চাও।
রাজা গেলেন, নির্বাচিতও হয়ে গেলেন। মাস্টার্স করবেন নাকি খেলা চালিয়ে যাবেন, সে সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছিলেন যে রাজা, জিম্বাবুয়ের ঘরোয়া টি-টোয়েন্টি টুর্নামেন্ট সাউথার্ন রকস দলের হয়ে ওপেনিং করতেই নামলেন এরপর, সঙ্গী আরেক ওপেনারের নাম ব্রায়ান চার্লস লারা!
***
একবার ঘরোয়া ক্রিকেটে ব্যাটিং করছিলেন রাজা। পেছন থেকে কিপার স্লেজিং করছিল তাকে। বলছিল- তোমার তো জিম্বাবুয়ের পাসপোর্টই নেই, রান করে কী হবে!
সেই রাজাকে পাওয়ার জন্য জিম্বাবুয়ে ক্রিকেটেই এরপর বলতে গেলে উঠে-পড়েই লেগেছিল। ঘরোয়া ক্রিকেটে তার উন্নতি চলেছে বেশ দ্রুতই। দশ বছর জিম্বাবুয়ের বাসিন্দা- জিম্বাবুয়ের জাতীয় ক্রিকেট দলে খেলার ক্ষেত্রে একটা শর্ত। সেই শর্তও পূরণ হয়ে যায় রাজার। জাতীয় দলে খেলার ক্ষেত্রে যা যা প্রয়োজন, সেসবে সাহায্যে এগিয়ে আসে খোদ জিম্বাবুয়ে বোর্ডই। ২০১৩ সালেই এরপর অভিষেকও হয়ে যায় রাজার।
নাটক নাটকে যেভাবে ক্রিকেটে চলে আসা রাজার, সেভাবে তার টেস্ট অভিষেকটাও হয়ে যায় নাটকীয়ভাবে। ব্রেন্ডন টেলরের মেয়ের জন্ম হওয়ার কথা। সময়মতো তা হয়ে গেলে টেলরের দলের সাথে যোগ দেওয়ার কথা। কিন্ত তা হয় না, ম্যাচের ঘন্টাখানেক আগে রাজা জানতে পারেন, তিনি খেলবেন, জন্মভূমি পাকিস্তান তার প্রতিপক্ষ। বাংলাদেশের বিপক্ষে ওয়ানডে ও টি-টোয়েন্টির পর টেস্ট অভিষেকেও রাজা বনে গেলেন 'অল-ফরম্যাট' ক্রিকেটার।
একে একে রাজা হয়ে গেলেন জিম্বাবুয়ে ক্রিকেটেরই রাজাদের একজন! জিম্বাবুয়ের ইতিহাসের সেরা অলরাউন্ডারদের ছোট্ট তালিকা যদি করা হয়, তবে তাতে পাওয়া যাবে সিকান্দার রাজারও নাম।
***
পাকিস্তানের সিকান্দার রাজার যে জীবন ছিল, সেখানে অস্তিত্ব ছিল শুধু 'সিকান্দার' এর। তিনি হতে চেয়েছিলেন আকাশপথে যোদ্ধা। তার আবেগের সবটুকু জুড়েই ছিল তা। এতটাই আবেগ, টেলিভিশনে এয়ার ফোর্স নিয়ে করা অনুষ্টান দেখলেই বসে পড়েন টিভি সেটের সামনে। স্কটল্যান্ড হয়ে জিম্বাবুয়েতে যে জীবন পেয়েছেন, তাতেই জন্ম নিলো ক্রিকেট আবেগের। রাজভাই, সাকিভাই, রাজার জীবনে! সিকান্দার রাজার সে ক্রিকেটার অধ্যায়কে আলাদা করে দেওয়া যায় 'রাজা'র ভাগে!
পাকিস্তানের সিকান্দার, জিম্বাবুয়ের রাজা। তবে সেই 'সিকান্দার' এর প্রভাব 'রাজা'র জীবনেও আছে খুব। 'ফাইটার পাইলট' হওয়ার ট্রেনিং ক্রিকেট মাঠেও কাজে দেয়, রাজা তো বলেন এমনটাই। গতবছর বোন-ম্যারো তে সমস্যা দেখা দেয় রাজার। যার ফলে পুরোনো অ্যাকশনে বল করতে পারছিলেন না, বাহুর শক্তিও হারিয়ে ফেলেছিলেন কিছুটা। তবে সার্জারির পর অ্যাকশন বদলে নতুন অ্যাকশনে ফিরেছেন আবার, ফিরেছেন বোলিংয়ে আরও ধার বাড়িয়েই! ক্রিকেটার রাজা লড়তে জানেন, রক্ষক হয়ে দাঁড়ান প্রতিপক্ষের সামনে!
যেভাবে আইসিসির সহযোগী দেশের হয়ে বিশ্বকাপে দল সংখ্যা কমানোর প্রতিবাদ করতে পিছপা হননি। তাদের কপালটাও বলা যায় খারাপ ছিল কোয়ালিফায়ারের ওই ম্যাচে। তাদের কাছে ম্যাচটার মানে ছিল 'জেতো না হয় বিদায়'। প্রথমে ব্যাট করে আরব আমিরাত ৪৭.৫ ওভারে ২৩৭ রান করে, তখনই বৃষ্টি চলে আসে। আরব আমিরাতের ইনিংসের সমাপ্তিও ওখানেই।
৩৯ ওভার শেষে জিম্বাবুয়ের সংগ্রহ পৌঁছে যায় ২১৫ রানে। কিন্ত ডি-এল মেথডে জিম্বাবুয়ের লক্ষ্যটা যে ছিল ৪০ ওভারে ২৩০ রানের। শেষ ওভারে তাই ১৫ রান করতে হতো, সে হিসেবটা শেষ বলে ছয়ে আসে। জিম্বাবুয়ে পারে না, ১৯৮৩ সালের পর প্রথমবারের মতো তাই বিশ্বকাপ হয় জিম্বাবুয়েকে ছাড়া।
ক্রিকেট পাগলদের জন্য বিশ্বকাপ মানেই উৎসব। আর ক্রিকেটাররা তো বাসই করেন ক্রিকেটে। ক্রিকেটার, দর্শক, সকলের জন্যেই তাই সেটি এক আনন্দ-ফুর্তির উপলক্ষ। বিশ্বকাপ চলাকালে রাজাকে এক সাক্ষাৎকারে প্রশ্ন করা হয়েছিল, বিশ্বকাপ দেখছেন কি না? স্বপ্নভঙ্গের আগুনে এতটাই পুড়েছিলেন রাজা, বলেছিলেন, জিম্বাবুয়ে নেই, তাই বিশ্বকাপ দেখায় তার কোন মন নেই!
***
পরের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপেও জায়গা হয়নি রাজাদের। ২০২১ সালের সে বিশ্বকাপের কোয়ালিফায়ারে অংশগ্রহণ করতেই পারেনি জিম্বাবুয়ে। ক্রিকেট বোর্ডে সরকারী হস্তক্ষেপ ও অস্থিতিশীল পরিস্থিতির বরাতে আইসিসি জিম্বাবুয়েকে নিষিদ্ধ করে ফেলে, আইসিসি ইভেন্টে অংশগ্রহণ করা থেকে।
সে নিষেধাজ্ঞা উঠে যায় একসময়। ২০২২ সালের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ কোয়ালিফায়ারে আসে জিম্বাবুয়ে। রাজাদের লক্ষ্য থাকে, পাঁচ ম্যাচের পাঁচটিই জিতবেন। রাজা সেই লক্ষ্যপূরণে অগ্রণী ভূমিকাই পালন করেন। হন কোয়ালিফায়ারের সেরা খেলোয়াড়। তবে রাজার কাছে তার চেয়ে বড় বিষয়, বিশ্বকাপে ফিরেছে জিম্বাবুয়ে। রাজার কাছে তা 'খুশির চেয়ে স্বস্তি বেশি' রুপেই এসেছিল!
কোয়ালিফায়ার পর্ব শেষে বাংলাদেশের সঙ্গে টি-টোয়েন্টি সিরিজ, ওয়ানডে সিরিজ। সবখানেই সেরা খেলোয়াড়ের নাম সিকান্দার রাজা। দীর্ঘদিন ধরে সুদিনের দেখা না পাওয়া জিম্বাবুয়েইনদের কাছে সিকান্দার রাজাকে মনে হতেই পারে তাই, ক্রিকেট মাঠের রাজা।
অস্ট্রেলিয়া বিশ্বকাপে 'আপসেট' ঘটাবেন, রাজার চাওয়া। জিম্বাবুয়েইনরাও হয়তো বড় দলকে হারিয়ে আপসেট ঘটানোর স্বপ্ন দেখে। নিজেকে 'পাকিস্তানে জন্ম নেওয়া আফ্রিকান' বলা, পাকিস্তানের 'সিকান্দার' ও জিম্বাবুয়ের 'রাজা, দুয়ে মিলে জিম্বাবুয়ের আপন এক ছেলে সিকান্দার রাজাতে তারা স্বপ্ন দেখতেই পারে!