• এশিয়া কাপ
  • " />

     

    যে পাঁচ কারণে ঘুরে দাঁড়ানোর অবিশ্বাস্য গল্প লিখল শ্রীলংকা

    যে পাঁচ কারণে ঘুরে দাঁড়ানোর অবিশ্বাস্য গল্প লিখল শ্রীলংকা    

    আফগানিস্তানের বিপক্ষে প্রথম ম্যাচেই আট উইকেটের বিশাল হারে এশিয়া কাপ শুরু করেছিল শ্রীলংকা। অল্প কথায় বললে হারের ধরন আর তীব্রতাটা ঠিকঠাক ফুটে উঠছে না। সেদিন উদ্বোধনী ম্যাচে ১০৫ রানে অলআউট হওয়ার পর লংকানরা ম্যাচ হেরেছিল ৫৯ বল আগে। এমন শু10রুর পর চরম আশাবাদী মানুষটাও হয়তো শ্রীলংকার পক্ষে বাজি ধরার সাহস দেখায়নি। অথচ টুর্নামেন্টে শেষে এশিয়া কাপের শিরোপা নিয়ে উল্লাস করেছে ভারত মহাসাগরের পাড়ে বেড়ে ওঠা লংকানরাই। 

    ক্রিকেটকে বলা হয় ‘গৌরবময় অনিশ্চয়তা’-র খেলা। দারুণ এই খেলাটার পরতে পরতে মিশে থাকা সেই অনিশ্চয়তার দেয়ালে ঠিকই নিজেদের নাম খোদাই করে দিয়েছেন দাসুন শানাকারা। পাকিস্তানকে হারিয়ে ষষ্ঠবারের মতো এশিয়া কাপের শিরোপা নিশ্চিত করেছেন তারা। ব্যাকড্রপে ছিল স্বদেশী মানুষের অর্থনৈতিক ভোগান্তি, অভাব, ব্যাহত হওয়া স্বাভাবিক নাগরিক জীবনের আহাজারি। 

    এমন এক সময়ে শানাকারা এশিয়া কাপটা নিয়ে দেশে ফিরবেন, যখন তেমন কিছুর সবচেয়ে বেশি দরকার ছিল। শানাকাদের এশিয়া কাপ জয় হয়তো দেউলিয়া হতে যাওয়া এক দেশের জাতীয় সংকট সমাধান করতে পারবে না। কিন্তু দেশের মানুষের সেই ক্ষতে খানিকটা শান্তির প্রলেপ দেবে নিশ্চিত। খানিকক্ষণের জন্য হলেও হয়তো ভুলিয়ে দিতে পারবে অভাব আর না পাওয়ার গান। দিয়েছেও। পাকিস্তানের শেষ উইকেটটা পড়ার পরই শুরু হয়ে গিয়েছিল লংকানদের উল্লাস। সেই উল্লাস দুবাই থেকে কলম্বো হয়ে ছড়িয়ে পড়েছে আফগানিস্তানের কাবুলেও। 

    সবই হয়েছে দারুণ এক জয়ে। ফাইনালের ম্যাচসেরা ভানুকা রাজাপাকসাও বলেছেন, দেশের মানুষের মুখে একটু হলেও হাসি ফোটাতে পেরেছেন তারা। টুর্নামেন্টের শুরুতেই ভানুকাদের মিইয়ে যাওয়া সেই হাসি এখন আকর্ণবিস্তৃত। না হওয়ারও কারণ নেই। রীতিমতো ধ্বংসস্তূপ থেকে উঠে ঘুরে দাঁড়িয়েছে শ্রীলংকা। কীভাবে এই অর্জন এলো লংকানদের?

     

    ‘ওয়ার্ল্ড ক্লাস বোলার’হীন শ্রীলংকার মোমেন্টাম

    এশিয়া কাপে শ্রীলংকার দ্বিতীয় ম্যাচ ছিল বাংলাদেশের বিপক্ষে। সেই ম্যাচের আগে সংবাদ সম্মেলনে অধিনায়ক দাসুন শানাকা বলেছিলেন, বাংলাদেশে সাকিব-মোস্তাফিজ ছাড়া ভালো বোলার নেই। লংকা অধিনায়কের করা সেই মন্তব্যের জবাবে খালেদ মাহমুদ সুজন বললেন, শ্রীলংকায় তো কোনো ওয়ার্ল্ড ক্লাস বোলারই নেই।

    ব্যস! শুরু হয়ে যায় মাঠের বাইরের কথার লড়াই। তবে মাঠের লড়াইটা ঠিকই জিতেছিল শ্রীলংকা। বাংলাদেশের দেয়া ১৮৩ রানের লক্ষ্য টানটান উত্তেজনায় শ্রীলংকা টপকে গিয়েছিল ৪ বল হাতে রেখে। বাস্তবতাটাও দেখুন, লংকাকে জেতানো শটটাও খেলেছিলেন এক বোলারই; আসিথা ফার্নান্দো।  এরপরই বেজে যায় বাংলাদেশের বিদায় ঘণ্টা। শ্রীলংকা চলে যায় সুপার ফোরে।

    সুপার ফোরে আফগানিস্তানকে পেয়ে সেই হারের মধুর এক প্রতিশোধ নেন শানাকারা। ১৭৫ করেও শেষ রক্ষা হয়নি আফগানদের। পরিস্থিতি বুঝে ব্যাটিং করার সামর্থ্যই সেই ম্যাচটা জিতিয়েছিল শ্রীলংকাকে। ঝড়ো ব্যাটিংয়ে নিসাঙ্কা-কুশালের গড়ে দেয়া ভিতে জয় নিশ্চিত করেন ভানুকা-হাসারাঙ্গারা মিলে। সুপার ফোরে আফগানদের হারানোর পর  ভারতকেও হারিয়েছিল কেবল এক বল হাতে রেখে। সেই বাংলাদেশের বিপক্ষে জয় দিয়ে পাওয়া মোমেন্টামকে সামনে রেখে, ইস্পাত কঠিন মানসিকতার ছোঁয়ায় একের পর এক ম্যাচ জিতে ফাইনালে উঠেছিল শ্রীলংকা। বিশ্বমানের বোলার না থাকার পরেও তো চ্যাম্পিয়ন দলটার নাম শ্রীলংকাই। 


    মানিকজোড়: ভানুকা রাজাপাকসা-ওয়ানিন্দু হাসারাঙ্গা

    পাকিস্তানের বিপক্ষে ফাইনাল ম্যাচের কথাটাই ধরুন। একে তো টস হেরে ব্যাটিংয়ে নেমেছে শ্রীলংকা, এর মধ্যে পাকিস্তানি পেসারদের তোপে ৫৮ রানে নেই পাঁচ উইকেট। ম্যাচ বুঝি একপেশে হতে চলল। কিন্তু রাজাপাকসা সেটা হতে দিলে তো! একপ্রান্তে দাঁড়িয়ে বাঁহাতি এই ব্যাটার খেললেন আপন ছন্দে। ইনিংস শেষে ৪৫ বলে ৭১* রান। এর আগে হাসারাঙ্গার সাথে ৬ ওভারে মহামূল্যবান ৫৮ রানের জুটি।  ২১  বল খেলা হাসারাঙ্গার ব্যাট থেকে এলো ৩৬ রান। দুজন মিলে মোমেন্টাম ছিনিয়ে নিলেন  পাকিস্তানের কাছ থেকে। 

    আলাদা করে বলতে হবে ইনিংসের শেষ বলটার কথা। দারুণ বল করতে থাকা নাসিম শাহকে জায়গায় দাঁড়িয়ে ডিপ কভারের ওপারে যেভাবে আছড়ে ফেলেছেন রাজাপাকসা, ম্যাচ জেতার স্পৃহা হয়তো তখন আরও বেড়ে গিয়েছিল লংকানদের। বোলিংয়ে হাসারাঙ্গা দেখিয়েছেন ভেলকি। এক ওভারেই টপাটপ তুলে নিয়েছেন তিন পাকিস্তানি ব্যাটারকে। ম্যাচ জেতা হয়ে পড়েছিল আনুষ্ঠানিকতার ব্যাপার। পুরো টুর্নামেন্টই দুজন ছিলেন দারুণ ছন্দে। শীর্ষ পাঁচ ব্যাটার-বোলারদের তালিকায় আছেন দুজনই। হাসারাঙ্গা হয়েছেন এশিয়া কাপের সেরা ক্রিকেটার। 

     

    ‘ওরা ১১ ভাই’

    বাংলাদেশের বিপক্ষে টানটান উত্তেজনার ম্যাচটা জেতার পর মহিশ থিকশানা টুইটারে লিখেছিলেন, ‘১১ জন ভাই থাকতে বিশ্বমানের খেলোয়াড় দরকার নেই।’ 

    থিকশানার এই সেই টুইটের প্রমাণ শ্রীলংকা দল প্রতিটা পদে পদে বুঝিয়ে দিয়েছে। একাট্টা হয়ে লড়েছে পুরোটা সময়। ব্যাটিং-বোলিং কিংবা ফিল্ডিং; দুঃসময়ে একজন দাঁড়িয়েছে আরেকজনের পাশে। গত রাতের ফাইনালে নিজেদের ইনিংসের প্রথম ওভার করতে গিয়ে গোলকধাঁধায় পড়ে গিয়েছিলেন দিলশান মাদুশংকা। আইনসিদ্ধ কোনো বল না করে ওয়াইড-নো’তে খরচা করেন নয় রান। 

    তার মতো তরুণের জন্য কঠিন সময়ই বটে। একের পর এক অতিরিক্ত রান দিয়ে হতাশ সেই মাদুশংকার কাছে ছুটে গিয়েছিলেন কুশাল মেন্ডিস। কাঁধে হাত রেখে ভরসা জুগিয়েছেন অধিনায়ক শানাকাও। প্রথম ওভারে ১২ রান দেইয়া মাদুশংকা, চার ওভারের স্পেল শেষ করেছেন ২৪ রান দিয়ে। কেবল তাই নয়, দারুণ একেকটি ফিল্ডিংয়ে রান বাঁচানোর পর একজন আরেকজনকে যেভাবে বাহবা দিচ্ছিলেন, তাতেও ফুটে ওঠে সবার ভাতৃত্ব। 

     

    ওপেনিংয়ে রদবদল

    এশিয়া কাপের আগে শ্রীলংকার সবচেয়ে বড় দুশ্চিন্তার নাম ছিল ওপেনিং জুটি। ২০২২ সালের জানুয়ারি থেকে লংকান ওপেনারদের ১৯.৮০ গড়ে রান তুলেছিল ১১৭। কিন্তু একটা সিদ্ধান্ত বদলে দিল ওপেনিংয়ের চিত্র। প্রথম ম্যাচের পর পাথুম নিসাঙ্কার সাথে ওপেনিংয়ে পাঠানো হলো কুশাল মেন্ডিসকে। দানুশকা গুনাথিলাকা নামলেন টপ অর্ডারে। 

    সেই বাজিতে মাত করে দিলেন নিসাঙ্কা-কুশাল। দুজন মিলে ১৪৩ রান তুলেছেন ৪১.৬ গড়ে। আছে চারটি পঞ্চাশোর্ধ্ব জুটি। পাওয়ার প্লেতে শ্রীলংকা এশিয়া কাপের সফলতম দল। ১২৭ স্ট্রাইকরেটে প্রতি ৫.৫ বলে একটি বাউন্ডারি মেরেছেন লংকান ব্যাটাররা। যদিও ফাইনালে দুই ওপেনারের কেউই সুবিধা করতে পারেননি। সেই কমতি পুষিয়ে দিয়েছিলেন ভানুকা-হাসারাঙ্গারা মিলে। 

     

    ‘শাইনিং শানাকা’

    অধিনায়ক দাসুন শানাকা, মাঠে এক অমায়িক চরিত্র। বোলাররা যখনই বিপদে পড়েছেন, পাশে গিয়ে হাজির হয়েছেন তিনি। বোলারদের চাহিদা মাফিক ফিল্ডিং পরিবর্তন করেছেন প্রায় প্রতিটা ম্যাচেই। নিজের পক্ষ থেকে বোলারদের সেই নিশ্চয়তাটা দিয়েছিলেন বলেই, বোলাররা যথাসাধ্য চেষ্টা করেছেন ভরসার প্রতিদান দিতে। সতীর্থদের ভরসা করতেন বলেই হয়তো  খুব বেশি কথা বলতে দেখা যায়নি তাকে বোলারদের সাথে। স্কোয়াডের চার স্পেশালিস্ট বোলারের মধ্যে মাহিশ থিকশানা ছাড়া বাকি তিন বোলার; প্রমোদ মাদুশান, দিলশান মাদুশঙ্কা, আসিথা ফার্নান্দোদের টি-টোয়েন্টি অভিষেক হয়েছে এশিয়া কাপেই। তাদের স্বস্ত্বির জায়গা নিশ্চিত করা শানাকাকে ‘বোলার্স ক্যাপ্টেন’ বলাই যায়। 

    ব্যক্তিগত পারফর্ম্যান্সের এদিকে ছিলেন নীরব যোদ্ধার মতো। চাপের মুহুর্তে ব্যাট হাতে সামাল দিয়েছেন পরিস্থিতি। ভারতের বিপক্ষে ১৮ বলে ৩৩* রানের দারুণ ক্যামিও খেলে ম্যাচটা জিতিয়েই মাঠ ছেড়েছেন। অধিনায়ক হিসেবে কেবল নিজের কাজটাই যে করতে চান, সেটারও প্রমাণ দেয় এই ইনিংস। একাট্টা হওয়া, একই গন্তব্যের দিকে অবিচল থাকা শ্রীলংকা দলটাকে এক সুতোয় গাঁথার কারিগর এই শানাকাই। যিনি যথাসম্ভব আড়ালেই থেকেছেন। তবে এর আগে নিশ্চিত করেছেন, যেন নিজের কাজটা ঠিকমতো করতে পারেন। সেই বিশেষত্বই তাকে করে তুলেছে 'শাইনিং শানাকা'