গ্রুপ 'জি' প্রিভিউ: ব্রাজিলের 'মিশন হেক্সা'তে কোনও ব্যাঘাত ঘটাবে সার্বিয়া, সুইজারল্যান্ড, ক্যামেরুন
ব্রাজিলিয়ান কিংবদন্তী কাফু তো হুংকার দিয়েই বললেন, ব্রাজিল ফিরে এসেছে, তাই ব্রাজিলেও ফিরছে বিশ্বকাপ। হেক্সা জয়ের লক্ষ্য নিয়ে কাতারে নামা ব্রাজিল সন্দেহাতীতভাবেই শিরোপার শক্ত দাবীদার। তবে সেই লক্ষ্যে প্রথম রাউন্ডেই থাকছে সার্বিয়া, সুইজারল্যান্ডদের মত মস্ত ফাঁড়া। সেই সাথে ক্যামেরুন যদি তাদের ইতিহাস ফিরিয়ে আনে তবে ব্রাজিলের শুরুটা হতে পারে নড়বড়ে। সেরকম কিছু হবে কি না সেটাই বোঝার চেষ্টা করা যাক গ্রুপ ‘জি’-এর প্রিভিউ থেকে।
ব্রাজিল
পেন্টা জয়ের ২০তম বছরে শুরু হচ্ছে ব্রাজিলের ‘মিশন হেক্সা’। ২০১৪ বিশ্বকাপের সেই তিক্ত অভিজ্ঞতা, ঘরের মাঠে জার্মানদের কাছে অপদস্থ হওয়া স্মৃতি যে এখনও তাড়িয়ে বেড়ায় সেলেসাওদের। সেই ২০০২ সালে বিশ্বজয়ের পর এই ইউরোপিয়ানরা তাদের বিদায় ঘণ্টা বাজিয়ে এসেছে। এবার সেরকম কিছু তারা চাইবেন না। তিতের অধীনে প্রতিযোগিতামূলক ম্যাচে মাত্র ২ পরাজয়ের সর্বশেষটা এসেছিল আর্জেন্টিনার কাছে কোপা খোয়ানোর ম্যাচে। ব্রাজিলের জন্য সেটাও কম অপমান নয় বৈকি। এসব গ্লানিকর অধ্যায়ের শেষ দেখতে ব্রাজিল এবার বদ্ধপরিকর। বিশ্বকাপ বাছাইপর্বে অপরাজিত দলটার কান্ডারি নেইমার তো ইতোমধ্যে ঘোষণা দিয়েছেন, এমনভাবে খেলবে যেন এটা তার শেষ বিশ্বকাপ। প্রতিবারের মত এবারেও নেইমার পাদপ্রদীপের আলোয় থাকলেও এবার হয়ত নেইমার আগের দুই বিশ্বকাপের মত ভারাক্রান্ত নয়। সেই সাথে আরও পরিণত নেইমার সতীর্থ হিসেবে সব পজিশনেই পাচ্ছেন বিশ্বমানের খেলোয়াড়। ব্রাজিলও এবার তাই বিশ্বকাপ ছাড়া আর অন্য কোনও ফলাফলে সন্তুষ্ট হবে না।
শক্তি
বরাবরের মতই ব্রাজিলের মূল শক্তি তাদের আক্রমণভাগ। নেইমারের সাথে এবার আছেন দুর্দান্ত ফর্মে থাকা ভিনিসিয়ুস জুনিয়র, গ্যাব্রিয়েল জেসুস, ব্রাজিলের হয়ে এই বছরের সর্বোচ্চ গোলদাতা রিচার্লিসন, মার্টিনেল্লি, পেদ্রো, রদ্রিগো, রাফিনিয়া, অ্যান্টনিদের মত দারুণ সব প্রতিভা। মিডফিল্ডের সেনানী কাসেমিরোর সাথে ফ্রেডের জুটিটাও যে দারুণ জমে। আর বিকল্প হিসেবে সেখানেও তিতের হাতে থাকছে প্রিমিয়ার লিগ মাতানো ব্রুনো গুইমারেস, ফাবিনিয়োরা।
দুর্বলতা
ব্রাজিলের মূল সমস্যা তাদের ফুল ব্যাক। যেই রেনান লোদির ভুলে কোপার ফাইনালে একটি বার তাদের জালে বল জড়িয়েছিল তিনি এবার না থাকলেও লেফট ব্যাক হিসেবে থাকা আলেক্স টেয়েস বা অ্যালেক্স সান্দ্রোদের ফর্ম খুব একটা আশা জাগানিয়া নয়। সেই সাথে রাইট ব্যাক দানিলোর ফর্ম বেশ কিছুদিন ধরেই নিম্নগামী। মাঝে তিতে উপায় খুঁজতে মিলিতাওকেও খেলিয়েছেন ওই জায়গায়। নিরুপায় তিতে শেশ্মেশ অভিজ্ঞতার দ্বারস্থ হয়েছেন, ফিরেছেন দানি আলভেজের কাছে। তবে বিশ্বকাপের সবচেয়ে বয়স্কদের একজন আলভেজ যদি কোনও ম্যাচে শুরু করেন তাহলে বয়স তাকে পেয়ে বসবে কি না থেকে যাচ্ছে সেই প্রশ্ন।
ক্যামেরুন
ক্যামেরুনের নাম শুনলেই কি কর্নার ফ্ল্যাগে এক হাত রেখে রজার মিলার সেই ছন্দে ছন্দে নেচে ওঠার উদযাপনটাই মনে পড়ে না আপনার? মিলার সেই আনন্দ যেন উৎসারিত হয় ক্যামেরুনের মাঠের খেলায়ও। খেলার মান বলুন আর ক্যামেরুনের বিশ্বকাপ সংক্রান্ত নানা গল্প- দলটি দর্শকদের বিনোদন দিয়ে এসেছে বহু বছর ধরেই। তবে বিশ্বমঞ্চে মিলায় সাওয়ার হয়ে শেষ আটে জায়গা করে নেওয়াটাই এখইন পর্যন্ত তাদের সেরা সাফল্য। স্যামুয়েল ইতোর মত কিংবদন্তীরা এরপর দেশের জার্সি গায়ে বিশ্বকাপে গেলেও ফলাফলটা থেকেছে আগের মতই। সময়ের পরিক্রমায় সেই ইতো তাদের ফুটবল ফেডারেশনের প্রেসিডেন্ট। বিশ্বকাপ শুরুর আগে তো তিনি ঘোষণা দিয়েছেন যে ফাইনাল হবে মরক্কো ও ক্যামেরুনের মাঝে, যেখানে আফ্রিকার সিংহদের হাতে প্রথমবারের মত উঠবে বিশ্বকাপ। দুর্দান্ত ফর্মে থাকা জাম্বি-আঙ্গিসা, এরিক ম্যাক্সিম চুপো মোটিংরা ইতোর আস্থার প্রতিদান দিতে পারবেন কি না তা সময়ই বলবে। তবে ব্রাজিলের পাশাপাশি সার্বিয়া, সুইজারল্যান্ডের বাঁধা পেরিয়ে গ্রুপ পর্ব উৎরাতেই অবশ্য তাদের কাঠখড় পোড়াতে হতে পারে।
শক্তি
ক্যামেরুনের শক্তি তাদের আক্রমণ। শারীরিকভাবে সমর্থ ভিনসেন্ট আবু বকরের সাথে চুপো মোটিং সেট পিস গুলোতে যেকোনো রক্ষণের জন্য চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারেন। মিডফিল্ড থেকে আক্রমণে কতটা ভয়ঙ্কর হতে পারেন লিভারপুলের বিপক্ষে জাম্বি আঙ্গিসা চ্যাম্পিয়নস লিগে সেটা দেখিয়েছেন।
দুর্বলতা
রক্ষণভাগের অবস্থা খুব একটা সুবিধার নয় যার প্রমাণ মিলেছে বাছাইপর্বের পর প্রীতি ম্যাচগুলোতেও।
সার্বিয়া
বিশ্বকাপ বাছাইপর্বে এবার দারুণ খেলেই ইউরোতে খেলতে না পারার ক্ষত পুষিয়েছে সার্বিয়া। পর্তুগালকে প্লেঅফের দিকে ঠেলে দিয়ে গ্রুপ থেকে সরাসরি কোয়ালিফাই করা সার্বিয়া চেষ্টা করবে ২০১০ সালের মত কোনও অঘটন ঘটানোর। গ্রুপটা এবার তাদের জন্য কঠিন হলেও মিলিনকোভিচ-সাভিচ, কস্টিচ, মিত্রোভিচ, তাদিচ, মিত্রোভিচ, ভ্লাহোভিচদের মত ইউরোপের শীর্ষ সারির ফুটবলে নিয়মিত পারফর্ম করে আসা খেলোয়াড়দের নিয়ে এবার বড় স্বপ্ন বুনছে সার্বিয়ানরা। নেশন্স লিগে সবার আগে নিজেদের গ্রুপ পার করা সার্বিয়া তাই গ্রুপের সমীকরণ ওলটপালট করে দেওয়ার সামর্থ্য রাখে।
শক্তি
নিশ্চিতভাবেই সার্বিয়ার মূল শক্তি এবার তাদের আক্রমণ। দেশ ও ক্লাবের হয়ে গত প্রায় দেড় বছর ধরে অদম্য আলেক্সান্ডার মিত্রোভিচের সাথে জুটি বাঁধবেন জুভেন্টাসের দুশান ভ্লাহোভিচ। সেই সাথে বিকল্প হিসেবে আছেন সাবেক মাদ্রিদ ফরওয়ার্ড লুকা ইয়োভিচ। সেই সাথে মিডফিল্ডে এবারও দারুণ ফর্মে আছেন সের্গেই মিলিঙ্কোভিচ-সাভিচ।
দুর্বলতা
বাছাইপর্বের ৮ ম্যাচে সার্বিয়ার জালে জড়িয়েছে ৯ গোল, যেটা আসলে তাদের রক্ষণের পক্ষেই কথা বলে। তবে দ্রাগান স্টয়কোভিচ তার রক্ষণ কীভাবে সাজাবেন সেটা নিয়ে এখনও সেই অর্থে নিশ্চিত নয়। ৪-৪-২ ফর্মেশনে মিডফিল্ডের মাঝের জায়গায় মিলিঙ্কোভিচ-সাভিচের সহযোদ্ধাদের নিয়েও আছে প্রশ্ন।
সুইজারল্যান্ড
টানা পঞ্চম বারের মত এবার বিশ্বকাপে এসেছে সুইজারল্যান্ড। গত ইউরোতে ফ্রান্সকে বিদায় দেওয়া সুইজারল্যান্ডের বিশ্বকাপের অর্জন শুধু ২০১৪ সালে স্পেনকে হারানোতেই সিমাবদ্ধ নয়। জেরদান শাকিরি সেই ২০১০ সাল থেকেই করেছেন দারুণ কিছু গোল, আছে বিশ্বকাপ হ্যাটট্রিকও। শাকিরির ফর্ম পড়তি হলেও দল হিসেবে সুইসদের পারফর্ম্যান্স ঊর্ধ্বগামী। গত বিশ্বকাপে গ্রুপ পর্বে ব্রাজিলকেও আটকিয়ে দিয়েছিলেন তারা স্টিভেন জুবেরের গোলে। ইউরোর মত বিশ্বকাপেও এবার তাই সুইসরা জন্ম দিতে পারেন বেশ কিছু ‘আপসেট’-এর।
শক্তি
সুইসদের মূল শক্তি তাদের রক্ষণভাগ। ম্যানুয়েল আকাঞ্জি, ফাবিয়ান শার, সিলভান ভিডমার, নিকো এলভেদি, রিকার্দো রদ্রিগেজদের নিয়ে গড়া রক্ষণভাগের পেছনে আছেন বুন্দেসলিগায় এক ম্যাচে সর্বোচ্চ সেভের রেকর্ড গড়া ইয়ান সমার। ইউরো ও ক্লাবের ফর্ম টেনে আনলে সমারের জালের ফাকে বল জরানো যেকোনো দলের জন্যই দুঃসাধ্য হবে।
দুর্বলতা
সুইসদের ফরওয়ার্ডদের গোলমুখে নিষ্প্রভ দিনগুলো ভাবাবে কোচ মুরাত ইয়াকিনকে। নিজের ছায়া হয়ে আছেন হারিস সেফেরোভিচ। ব্রিল এমবোলোও খুব একটা ধারাবাহিক নয়। গোলের জন্য শাকিরি, জাকাদের মিডফিল্ডের দিকেই তাই হয়ত তাকিয়ে থাকতে হবে তাদের।
প্রেডিকশন: গ্রুপ থেকে প্রথম ও দ্বিতীয় দল হিসেবে পরের রাউন্ডে যাবে ব্রাজিল ও সার্বিয়া। পরের দুই স্থানে থাকবে যথাক্রমে সুইজারল্যান্ড ও ক্যামেরুন।