ভালো উইকেট, নতুন আবিষ্কার : তারপরও কি বিপিএল সফল?
দেখতে দেখতে শেষদিকে বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগের এবারের আসর। প্রতিবারের মতো এবারও নানান ভালো-মন্দের মিশেলে এগিয়েছে দেশের সবচেয়ে বড় এই ক্রিকেট টুর্নামেন্ট। মাঠ ও মাঠের বাইরের বিভিন্ন ঘটনার পর বিপিএলের পর্দা নামছে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ান্স-সিলেট স্ট্রাইকার্সের ফাইনালের মধ্য দিয়ে। কেমন ছিল বিপিএলের এবারের আসর? কী পেল দেশের ক্রিকেট? কী কী অসঙ্গতি আরও একবার চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে গেল বিপিএল?
কেমন ছিল এবারের উইকেট?
উইকেটের মান নিয়ে সমালোচনা যেন বিপিএলের চিরসঙ্গী। বিশেষ করে শেষ কয়েক মৌসুমে এই সমালোচনা আরো প্রকট আকারা ধারণ করেছিল। বিপিএলের ২০২২ সালের আসরে বেশ কিছু ম্যাচ গড়িয়েছিল শেষ ওভারে। এমন অনেক ম্যাচও হয়েছিল যার নিষ্পত্তি হয়েছিল ম্যাচের শেষ ওভারের শেষ বলে। এবারও শুরুর দিকের বেশ কয়েকটা ম্যাচ হয়েছে লো স্কোরিং। বিশেষ করে দিনপ্রতি দুটি ম্যাচের প্রথমটিতে।
আসরের উদ্বোধনী ম্যাচের কথাই বলা যায়। সিলেটের বিপক্ষে সেই ম্যাচে ১০০ রানও করতে পারেনি চট্টগ্রাম। সেখানে চট্টগ্রামের ব্যাটারদের ব্যর্থতা কিংবা সিলেটের বোলারদের ভূমিকা তো আছেই। ভাইটাল রোলে ছিল মিরপুরের উইকেটও। টুর্নামেন্টের দ্বিতীয়দিনের প্রথম ম্যাচেও খুলনা আটকে গিয়েছিল ১১৩ রানে। তবে দিন যত গড়িয়েছে লো স্কোরিং ম্যাচের সংখ্যা ততই কমেছে। মিরপুরেই এবার প্রথমবার দেখা মিলেছে প্রায় ৪০০ রান ছোঁয়া ম্যাচ। ফরচুন বরিশালের দেয়া ১৯৫ রানের লক্ষ্য সিলেট ছুঁয়েছিল এক ওভার হাতে রেখেই। এই দুই দলের সৌজন্যেই দেখা মিলেছে ২০০ ছাড়ানো ইনিংস। এর বাইরে ইনিংস প্রতি ১৭০-৮০ রানের ম্যাচও দেখা গেছে অহরহ। প্রথাগত স্লো, টার্নিং ট্র্যাকের বদলে স্পোর্টি উইকেট পেয়ে প্রশংসা করেছেন ক্রিকেটাররাও।
তরুণ ক্রিকেটারদের জন্য আদর্শ মঞ্চ?
বিপিএলের প্রতি মৌসুমেই লাইমলাইটে আসেন কোনো না কোনো ক্রিকেটার। ফরচুন বরিশালের হয়ে খেলে গত বছর জাতীয় দলে সুযোগ পেয়েছিলেন মুনিম শাহরিয়ার। এবার আলোচনায় আছেন সিলেটের তৌহিদ হৃদয়। বয়সভিত্তিক দল হয়ে উঠে আসা এই ব্যাটার এবারের শীর্ষ রান সংগ্রাহকের তালিকায়। ধারাবাহিক পারফরম্যান্সে ম্যাচ জেতানো বেশ কিছু ইনিংসও খেলেছেন ডানহাতি এই ব্যাটার।
এমনিতে দেশের ঘরোয়া ক্রিকেটের পরিচিত মুখই তিনি। তবে নিজেকে নতুন করে চিনিয়েছেন এবারের বিপিএলে। দেশের ক্রিকেটের সবচেয়ে বড় এই মঞ্চে পারফর্ম করেই জানান দিয়েছেন নিজের সক্ষমতার। পাওয়ার হিটিং, পরিস্থিতি অনুযায়ী ব্যাটিং; সব মিলিয়ে দারুণ করেছেন হৃদয়। সিলেট দলে তারই সতীর্থ জাকির হাসানও ঝলক দেখিয়েছেন টি-টোয়েন্টির। গেল নভেম্বরে টেস্টে অভিষিক্ত হওয়া এই ব্যাটার এবার ধারাবাহিক পারফর্ম্যান্স না করলেও জানান দিয়েছেন নিজের পাওয়ার হিটিংয়ের। কেবলই ‘টেস্ট ব্যাটার’ নন, সেই বার্তাটা দিয়েছেন বেশ জোরেশোরেই।
দুই আসর ধরেই বিপিএলের নিয়মিত পারফর্মারদের একজন কুমিল্লার তানভীর ইসলাম। আগের বিপিএলের চতুর্থ সর্বোচ্চ উইকেট শিকারি এই স্পিনার এবারও আছেন শীর্ষ বোলারদের তালিকায়। স্পট বোলিংয়ে ওভারপ্রতি ৬.৩১ রান দিয়ে তুলে নিয়েছেন ১৬ উইকেট। কেবল তিন ম্যাচ খেললেও গতির ঝলক দেখিয়েছেন খুলনা টাইগার্সের নাহিদ রানা।
বয়সভিত্তিক দলের নানান ধাপ পেরিয়ে বিপিএল পর্যন্ত উঠে এসেছিলেন অনেক ক্রিকেটারই। সেখান থেকে জাতীয় দলে খেলেছেন আবু হায়দার রনি, শেখ মাহেদি হাসান, মুনিম শাহরিয়াররা। এবারের বিপিএল হৃদয়-তানভীরদের জন্য জাতীয় দলের দরজা দুয়ার খুলে দেবে কিনা সেটাই দেখ্র অপেক্ষা।
ফ্র্যাঞ্চাইজি বিভ্রাট থেকে মুক্তি?
নয় মৌসুমে এখন পর্যন্ত আলাদা ২৭টি ফ্র্যাঞ্চাইজি দেখা গেছে বিপিএলে। সিলেট দলের কথাই ধরা যাক। এখন পর্যন্ত আলাদা ছয়টি ফ্র্যাঞ্চাইজির অধীনে খেলেছে দলটি। ২০১২ সালের প্রথম আসরে সিলেট রয়েলস নামে শুরু করে ২০১৫ সালের সেটা বদলে যায় সিলেট সুপারস্টার্সে। এক মৌসুম পর সিলেট সিক্সার্স। ২০১৯ বিপিএলে সিলেটের দল খেলেছে সিলেট থান্ডার নামে। গেল আসরের সিলেট সানরাইজার্স এবার মাঠে নামছে নতুন মালিকানায় সিলেট স্ট্রাইকার্স হয়ে।
ঢাকার চিত্রটাও ভিন্ন নয়। এখন পর্যন্ত আলাদা আলাদা ৫টি নামে দেখা গেছে রাজধানীর দলটিকে। ঢাকা গ্ল্যাডিয়েটর্স, ঢাকা ডায়নামাইটস, ঢাকা প্লাটুন, মিনিস্টার গ্রুপ ঢাকা এবং সর্বশেষ ঢাকা ডমিনেটরস।
মালিকানা না বদলে বিপিএলে টিকে আছে কেবল কুমিল্লার ভিক্টোরিয়ান্স। একই মালিকানায় ২০১৫ সাল থেকে খেলছে বিপিএলের তিনবারের শিরোপাজয়ী দলটি। এর মধ্যে কেবল এক আসরে অংশগ্রহণ করেনি। এদিকে ২০১৯ সালের পর বিপিএলের পর রাজশাহীর দল কিনতে আগ্রহ দেখায়নি কোনো ফ্র্যাঞ্চাইজিই।
চট্টগ্রাম কিংবা খুলনা দলকেও একটি নির্দিষ্ট বিরতির পর দেখা গেছে নতুন নামে, নতুন ফ্র্যাঞ্চাইজির অধীনে। এক কিংবা দুই মৌসুম পর পর ফ্র্যাঞ্চাইজির নাম বদলে যাওয়া; ওই এলাকার ভক্তদের জন্যও তা যথেষ্ট বিভ্রান্তিকর। কাঠামোগত দিক দিয়ে ফ্র্যাঞ্চাইজিগুলোকে নিয়ে দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনার অভাবেরই বহিঃপ্রকাশ সেটা। গত বিপিএলে দরপত্র আহবান করেও ঢাকার জন্য শুরুর দিকে কোনো ফ্র্যাঞ্চাইজি পায়নি বিপিএলের গভর্নিং বডি। শেষ পর্যন্ত প্লেয়ার্স ড্রাফট থেকে খোদ বিসিবি দল গড়েছে ঢাকার। সেটার মালিকানা নিয়েছিল মিনিস্টার গ্রুপ।
এবার অবশ্য প্রতিটি ফ্র্যাঞ্চাইজিকে তিন বছরের জন্য দলের দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়েছে বিপিএল গভর্নিং কাউন্সিল। ফিরেছে রংপুর রাইডার্সের মতো পুরনো ফ্র্যাঞ্চাইজিও। তবে ফরচুন বরিশালের মালিক বলেছেন, সামনের আসর থেকে তারা আর থাকছেন না। এদিকে ফ্র্যাঞ্চাইজিদের কাঠামোগত এই পরিবর্তনের ফল দেখা যাবে হয়তো সামনেই। দলকে ঘিরে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনাও সারতে পারবে প্রতিটি ফ্র্যাঞ্চাইজিই। অঞ্চলভিত্তিক দলের একটি নির্দিষ্ট ফ্যানবেজও গড়ে তোলায়ও হতে পারে এক্স ফ্যাক্টর।
আম্পায়ারিং, ডিআরএস ও এডিআরএস
‘নায়ক’ সিনেমা দেখেছেন না? একদিনেও অনেক কিছু করা সম্ভব। যে করতে পারে সে সব করতে পারে। এই পুরো সবকিছু বাদ দিয়ে আবার ড্রাফট হবে, অকশন হবে, ফ্রি টাইমে বিপিএল হবে, সব আধুনিক টেকনোলজি থাকবে। ব্রডকাস্ট ভালো থাকবে। হোম অ্যান্ড অ্যাওয়ে ভেন্যু থাকবে।’, দায়িত্ব পেলে বিপিএলে কী কী পরিবর্তন করতেন প্রশ্নের উত্তরে কথাগুলো বলেছিলেন সাকিব আল হাসান। তার এই কথাতেই অন্যান্য টি-টোয়েন্টি লিগের পার্থক্যটা স্পষ্ট হয়ে ধরা দিল। বিপিএলের টিভি সম্প্রচারের মান নিয়ে শুরু থেকেই সমালোচনার অন্ত নেই। এইচডি পিকচার কোয়ালিটির যুগে বছর তিন-চারেক আগেও ঘোলা স্ক্রিনেই দেখতে হয়েছে বিপিএল। সাথে ম্যাচ চলাকালীন অদ্ভুতুড়ে সব গ্রাফিক্স-মোশনের কাজ তো ছিলই। স্কোরকার্ডের সাথে ক্রিকেটারদের নাম বিভ্রাটের দেখাও মিলেছে টিভির স্কোর স্ক্রলে।
দ্বিপাক্ষিক সিরিজেও এখন ডিআরএস থাকে। অথচ এবারের বিপিএলের গ্রুপ পর্বের ৪২ ম্যাচে ছিল না প্রযুক্তিগত এই সুবিধা। প্লে-অফের আগ পর্যন্ত থার্ড আম্পায়াররা কাজ চালিয়েছেন ‘এডিআরএস’ দিয়ে। এই এডিআরএস এবার খেলা দেখিয়েছে টুর্নামেন্টের শুরু থেকেই, যেখানে ছিল না হক আই, স্নিকোমিটার, বল ট্র্যাকিং। কেবল বলের পিচিং লাইন দেখেই থার্ড আম্পায়ারকে জানাতে হয়েছে লেগ বিফোরের সিদ্ধান্ত।
সেই সীমাবদ্ধতা সঙ্গী করেই প্লে অফ পর্যন্ত গড়িয়েছে বিপিএল। যার কারণ ক্রিকেটাররা একাধিকবার আম্পায়ারের সিদ্ধান্তে হস্তক্ষেপ করেছেন, নাখোশ হয়ে মেজাজ হারিয়েছেন মাঠেই দুর্ব্যবহার করে, গুনেছেন জরিমানা, জুটেছে ডিমেরিট পয়েন্টও।
খুলনা টাইগার্সের বিপক্ষে ম্যাচে লেগ বিফোরের শিকার হয়েছিলেন সৌম্য সরকার। খুলনা তখন রিভিউ নিলে থার্ড আম্পায়ার আউট দেন তাকে। সেই সিদ্ধান্ত মেনে নেননি সৌম্য। বাউন্সার মাথার ওপর দিয়ে গেলেও ওয়াইড ডাকেননি লেগ আম্পায়ার। সেই সিদ্ধান্তে মেজাজ হারিয়ে রীতিমতো আম্পায়ারের দিকে চিৎকার করে তেড়ে যান সাকিব। রংপুর রাইডার্সের বিপক্ষে বরিশালের ইনিংস শুরুর আগে নুরুল হাসান সোহান বোলার পরিবর্তন করেছিলেন স্ট্রাইকে চতুরঙ্গ ডী সিলভাকে দেখে। সাকিব তখন মাঠে ঢুকে তর্কে জড়িয়েছিলেন আম্পায়ারদের সাথে। আম্পায়ারিংয়ের সমালোচনা করে ম্যাচ ফির নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ জরিমানা দিয়েছেন কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ান্সের কোচ মোহাম্মদ সালাউদ্দিনও।
সর্বশেষ দ্বিতীয় কোয়ালিফায়ারে থার্ড আম্পায়ারের দেয়া এলবিডব্লিউয়ের সিদ্ধান্তে মেজাজ হারিয়ে মাঠ ছেড়েছেন শান্ত। এমন আচরণে ডিমেরিট পয়েন্টের সাথে ম্যাচ ফিও জরিমানা দিয়েছেন তিনি।
বিসিবির দূরদর্শিতার অভাব
প্রতি মৌসুমে প্লেয়ার্স ড্রাফটস বা নিলাম থেকে শুরু করে দলগুলোর মালিকানা নির্ধারণ, মাঠের বাইরের কান্ড, ম্যাচ গড়াপেটা, খেলোয়াড়দের বকেয়া পাওনা, স্লো উইকেট, টিভি ব্রডকাস্টের মান নিয়ে নানান তর্ক-বিতর্কের মধ্যে দিয়ে গেছে বিপিএল। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন আসতে পারে, ক্রিকেটের বিশ্বায়নের এই যুগে কেন এই বেহাল দশা দশ বছর বয়সী একটি ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগের? এতদিনেও কি কোনো ব্র্যান্ডভ্যালু গড়ে ওঠেনি? বিসিবির পরিকল্পনা ই বা কী?
দিনকে দিন রঙ হারাচ্ছে বিপিএল। ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেটের যে চাকচিক্য সেটাও মিইয়ে গেছে অনেকদিন। বিসিবির নেই কোনো ব্যবসায়িক মডেল। বিশ্বের অন্যান্য ফ্র্যাঞ্চাইজিগুলোতে সেন্ট্রাল পুল থাকে, সেখান থেকে প্রাপ্ত অর্থ নির্দিষ্ট হারে দলগুলোর মালিক কর্তৃপক্ষের সাথে ভাগাভাগি করে আয়োজক কমিটি। অথচ বিপিএলে একেকটি ফ্র্যাঞ্চাইজির খরচের বিপরীতে লাভের পরিমাণ হয়তো অনেক কমই।
আইপিএল, পিএসএল কিংবা নব্য চালু হতে যাওয়া আইএল টি-টোয়েন্টি; ছোট প্রোমো ভিডিও, কিংবা নজরকাড়া কাউন্টডাউনে ডিজিটাল মাধ্যমে চলে তাদের দারুণ সব প্রচারণা। ভক্ত-সমর্থক ছাপিয়ে গোটা বিশ্বের ক্রিকেটপ্রেমীরাই ওয়াকিবহাল তা নিয়ে। সামাজিক যোগযোগ মাধ্যমে প্রচারের এই অবারিত সুযোগ থাকার পরেও এখানে যোজন যোজন পিছিয়ে বিপিএল। বিপিএলের অফিসিয়াল পেজ বছরজুড়ে প্রায় ফাঁকা ই পড়ে থাকে। ব্যস্ততা যেটুকু কেবল বছরের শেষ কিংবা শুরুতে বিপিএলের সময়টুকুতেই। বিপিএলের টুকটাক খোঁজখবর যারা রাখেন, তাদের ভরসা দলগুলোর ফেসবুক পেজ।