• দলবদলের যত খবর
  • " />

     

    ইউরোপীয় ফুটবলে দলবদল হয় যেভাবে: জেনে নিন বিস্তারিত

    ইউরোপীয় ফুটবলে দলবদল হয় যেভাবে: জেনে নিন বিস্তারিত    

    ফুটবল ভক্তদের জন্য দলবদলের চেয়ে সুখকর সংবাদ আর নেই। পছন্দের ক্লাব কোন খেলোয়াড়কে দলে ভেড়াতে পারে, কোন খেলোয়াড়ের দাম কত হবে, গ্রীষ্মজুড়ে এরকম গুঞ্জনের উপরই বেঁচে থাকে ভক্তরা। তবে দলবদলের পুরো প্রক্রিয়া ও এ সংক্রান্ত সব শব্দাবলী সম্বন্ধে হয়তো অনেকেই পরিচিত না।  

    দলবদল সাধারণত হয় দুটি ক্লাবের মধ্যে। ক্রেতা ও বিক্রেতা ক্লাব। তাতে জড়িত থাকে ট্রান্সফার ফি, খেলোয়াড়ের বেতন, এজেন্ট ফি এবং আরও নানা কিছু। সবসময় দুই ক্লাবের মধ্যেই যে খেলোয়াড় নিয়ে দামাদামি হয়, তা না। বাজারে আছেন অনেক ফ্রি এজেন্ট, অনেক খেলোয়াড়ের চুক্তিতে রয়েছে রিলিজ ক্লজ। এসব পরিভাষা দেখে যদি কঠিন মনে হয়, বা ঠিকমতো না বুঝতে না পারেন, তাহলে আপনার জন্যই এই নিবন্ধ। এখানে দলবদল সংক্রান্ত সকল পরিভাষা ও দলবদলের সার্বিক প্রক্রিয়া ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছি আমরা। 

    পর্যবেক্ষণ (মনিটর/এক্সপ্লোর): দলবদলের যেকোনো গুঞ্জন শুরু হয় এই শব্দগুলো দিয়ে। সকল ক্লাবই তাদের পরিকল্পনা অনুযায়ী একটি নির্দিষ্ট সংখ্যক খেলোয়াড়দের পর্যবেক্ষণ করে। তরুণ খেলোয়াড়দের ক্ষেত্রে এই পর্যবেক্ষণকে বলা হয় স্কাউটিং, সিনিয়র খেলোয়াড়দের ক্ষেত্রে মনিটর, এক্সপ্লোরের পাশাপাশি আরও অনেক শব্দ ব্যবহার করেন দলবদল সাংবাদিকরা।  

    আগ্রহ দেখানো (ইন্টারেস্টেড): গুঞ্জন একটু গাঢ় হয়, যখন কোনো ক্লাব একটি খেলোয়াড়ের ব্যাপারে আগ্রহ দেখানো শুরু করে। সাধারণত ক্লাব-কেন্দ্রিক সাংবাদিকদের কাছ থেকে প্রথম আসে এই সংবাদ। 

    ব্যক্তিগত চুক্তি (পার্সোনাল টার্মস): আগ্রহের শুরুতে বড় ক্লাবগুলো এখন প্রথমেই খেলোয়াড়দের কনভিন্স করার চেষ্টা করে। খেলোয়াড়ের সঙ্গে ব্যক্তিগত চুক্তিতে সমঝোতায় আসলে ক্লাবের সঙ্গে দামাদামি করা অনেকটা সহজ হয়ে আসে। কেননা, এই ক্ষেত্রে সেই খেলোয়াড়ের জন্য আগ্রহী অন্য সব ক্লাব আলোচনা থেকে সড়ে যায়। 

    দুই ক্লাবের মধ্যে আলোচনা (নেগোসিয়েশন): আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো খেলোয়াড়ের জন্য বিড পাঠানোর আগে অনেক সময় দুই ক্লাব নিজেদের মধ্যেই দামাদামিটা সেরে নেয়। কিংবা সেই খেলোয়াড়ের দাম কত হতে পারে, বা সে আদৌ বিক্রির জন্য কি না; এসব ব্যাপারে খোঁজ নিতেই (সম্ভাব্য) বিক্রেতা ক্লাবের সঙ্গে আলোচনা চালাতে পারে ক্রেতা ক্লাব। 

    ট্রান্সফার লিস্ট: অনেক ক্লাবই তাদের বিক্রয়যোগ্য খেলোয়াড়দের একটি লিস্ট তৈরি করে মৌসুমের শেষে, যা প্রকাশ করে থাকে ক্লাব-সংশ্লিষ্ট সাংবাদিকরা। প্রত্যেক খেলোয়াড়ের জন্য একটি আনুমানিক ফিও সেঁটে দেয় ক্লাব। ২০২০-২১ মৌসুমের শেষে আশরাফ হাকিমি ও রোমেলু লুকাকু ট্রান্সফার লিস্টে রেখেছিল ইন্টার মিলান। 

    ট্রান্সফার রিকুয়েস্ট: অনেক সময় খেলোয়াড়ের দলবদলের পথ রোধ করে দাঁড়াতে পারে তার নিজের ক্লাব। আরেক ক্লাবের সঙ্গে ব্যক্তিগত চুক্তির ব্যাপারে সম্মতি দিলেও পর্যাপ্ত অর্থের বিড না পেলে বা সেই খেলোয়াড়কে বিক্রি করতে না চাইলে বিক্রেতা ক্লাব নেগোসিয়েশন বন্ধ করে দিতে পারে (চুক্তি শেষ হওয়ার আগ পর্যন্ত একজন খেলোয়াড়কে ধরে রাখার অধিকার আছে ক্লাবের)। সেক্ষেত্রে ক্লাবকে ট্রান্সফার রিকুয়েস্ট পাঠাতে পারেন খেলোয়াড়। ২০২০-২১ মৌসুমের শেষে যেমন হ্যারি কেইন ট্রান্সফার রিকুয়েস্ট পাঠিয়েছিলেন স্পার্সকে। 

    আনুষ্ঠানিক বিড: একটি দলবদলের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়। ক্রেতা ক্লাব বিক্রেতা ক্লাব বরাবর একটি আনুষ্ঠানিক বিড পাঠায়, যা সাধারণত ইমেইল আকারে পৌঁছে। এর ভেতর থাকে ক্রেতা ক্লাব দলবদল ফি কত দিতে চায়, কীভাবে দিতে চায় (ইন্সটলমেন্ট রয়েছে কি না), ও সম্ভাব্য অ্যাড-অন।  

    বিড পাওয়ার পর সম্ভাব্য বিক্রেতা ক্লাব হয় তা গ্রহণ করে, অথবা নাকচ করে। অথবা পুরোপুরি নাকচ না করে ফি আরেকটু বাড়ানো, বা পেমেন্টের কাঠামো বদলানোর সুপারিশ করে। 

    বিডিং যুদ্ধ: কিছু ফুটবলারের জন্য একাধিক ক্লাব আগ্রহী হয়ে থাকে। তখন তারা নিলামের মতোই একজনকে ছাড়িয়ে আরেকজন বিড দিতে থাকে। ক্রেতা ক্লাবগুলো সবসময় বিডিং যুদ্ধ এড়ানোর চেষ্টা করে। ডেকান রাইসের ক্ষেত্রে যেমন আর্সেনালের পাশাপাশি ম্যান সিটি আগ্রহী হলেও একটির বেশি বিড দেয়নি সিটি। 

    ট্রান্সফার ফি: দলবদলের ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সংখ্যা। ক্রেতা ও বিক্রেতা ক্লাব সাধারণত নিজেদের মধ্যে আলোচনা বা দামাদামি করে একটি ফি নির্ধারণ করেন। অথবা বিক্রেতা ক্লাব ফি হিসেবে একটি নির্দিষ্ট অঙ্ক সেঁটে দেয়, যেই ক্লাব তা পূরণ করতে আগ্রহী হবে তাদের সঙ্গেই আলোচনায় বসবে তারা। আমরা সাধারণত ইউরো, পাউন্ড বা মার্কিন ডলারে এই ট্রান্সফার ফি’র হিসাব পাই। 

    কিস্তি (ইন্সটলমেন্ট): ট্রান্সফার ফি পুরোটা সবসময় একসঙ্গে প্রদান করে না বিক্রেতা ক্লাব। চেলসির মতো অনেক ক্লাব কয়েক দফা ইন্সটলমেন্ট বা কিস্তিতে পরিশোধ করে এই ফি। এই কিস্তির কাঠামোও দুই দল মিলেই ঠিক করে থাকে। 

    অ্যাড-অন: ট্রান্সফার ফির সঙ্গে অনেকসময় পারফরম্যান্স-বিষয়ক বাড়তি বোনাসও থাকে। চুক্তিতে থাকা শর্ত-সাপেক্ষ এই বোনাস ফিকে বলে অ্যাড-অন। কোনো খেলোয়াড় নির্দিষ্ট সংখ্যক ম্যাচ খেললে, গোল দিলে বা শিরোপা জিতলে এগুলো সক্রিয় হয়। সম্প্রতি ব্রাজিলিয়ান ফরওয়ার্ড ভিতর রককে দলে ভেড়ানোর সময় বার্সার প্রস্তাবিত ৩০ মিলিয়ন ইউরোর অ্যাড-অনে রয়েছে ব্যালন ডি’অর জেতার শর্তও। অর্থাৎ বার্সার হয়ে সামনে ব্যালন ডি’অর জিতলে অ্যাড-অনের একটা অঙ্ক পাবে তার সাবেক ক্লাব অ্যাথলেটিকো পারানেজ।   

    রিলিজ ক্লজ: অনেক খেলোয়াড়ের চুক্তিতে একটি ধারা থাকে, যেটি অনুযায়ী কোনো ক্রেতা ক্লাব একটি নির্দিষ্ট অঙ্ক ট্রান্সফার ফি হিসেবে দিতে রাজি হলেই সেই খেলোয়াড়কে বিক্রি করতে বাধ্য থাকবে তার ক্লাব। সেই নির্দিষ্ট অঙ্কটিকে বলে রিলিজ ক্লজ। নতুন চুক্তি দেওয়ার সময় ক্লাব ও খেলোয়াড় দুই পক্ষ মিলেই ঠিক করে এই ক্লজ। লা লিগায় প্রতি খেলোয়াড়ের চুক্তিতে একটি রিলিজ ক্লজ থাকা বাধ্যতামূলক। 

    এই ক্লজকে অনেক সময় বাই-আউট ক্লজও বলা হয়। 

    সেল-অন ক্লজ: অনেক সময় দলবদল ফি’র পাশাপাশি একটি সেল-অন ক্লজও সেঁটে দেয় বিক্রেতা ক্লাব। এক্ষেত্রে খেলোয়াড়ের সত্ত্ব’র একটি অংশ বরাদ্দ থাকে তাদের জন্য। যেমন অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদ রেনান লোদিকে ১৩ মিলিয়ন ইউরোতে মার্সেইয়ে পাঠালেও চুক্তিতে ২০ শতাংশ সেল-অন ক্লজ রেখেছে তারা। অর্থাৎ সামনে যদি রেনান লোদিকে বিক্রি করে মার্সেই, সেই দলবদল ফি’র ২০ শতাংশ যাবে অ্যাটলেটিকোর পকেটে।   

    পূর্ণ সমঝোতা/ ফুল এগ্রিমেন্ট: দুই ক্লাব যখন ট্রান্সফার ফি, অ্যাড-অন, খেলোয়াড়ের বেতন ও বোনাসসহ সব ব্যাপারে একমত হয়, তখন আমরা শুনি এই শব্দগুলো। কিংবা ফাব্রিজিও রোমানোর সেই মধুর বাণী- হেয়ার উই গো। 

    দলবদলের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিরা- 

    পূর্বে শুধু খেলোয়াড় ও দুই ক্লাবের কর্তাব্যক্তিদের মধ্যেই দলবদলের সব আলোচনা সীমাবদ্ধ থাকলেও এখন তা পুরোপুরি বদলে গেছে। ইউরোপের সর্বোচ্চ স্তরের একটি দলবদলের পিছনে অন্তত ১৫-২০ জন ব্যক্তি জড়িত থাকেন বলে দাবি করেছেন ট্রান্সফার সাংবাদিক ফাব্রিজিও রোমানো। সেই ব্যক্তিরা কারা? 

    খেলোয়াড় ও তার এজেন্ট/পরিবার: ফুটবলারদের প্রধিনিনিধত্ব করার জন্য এখন বড় বড় এজেন্সি রয়েছে। যেমন পর্তুগিজ এজেন্ট হোর্হে মেন্ডেজের এজেন্সির নাম গেস্টিফুট, যার অধীনে রয়েছেন ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো, জোয়াও ফেলিক্স, এডারসন, আনহেল ডি মারিয়ার মতো প্রায় শ’খানেক ফুটবলার।

    অনেক খেলোয়াড় আবার এজেন্সির দ্বারস্থ হন না। তাদের এজেন্ট হিসেবে থেকে যান বাবা, মা বা পরিবারের কেউ। লিওনেল মেসি, কিলিয়ান এমবাপে, আর্লিং হালান্ড, আদ্রিয়ান রাবিওর মতো অনেক ফুটবলারের এজেন্টই তাদের পরিবারের সদস্য। 

    ক্লাবের রিক্রুটমেন্ট ইউনিট: প্রত্যেক ক্লাবেই একটি রিক্রুটমেন্ট ডিপার্টমেন্ট রয়েছে, যাদের দায়িত্ব খেলোয়াড় স্কাউটিং ও পর্যবেক্ষণ করা। সশরীরে খেলোয়াড় স্কাউট করার পাশাপাশি অনেক ক্লাব ডাটা-নির্ভর স্কাউটিংও করে থাকে। 

    কোচ ও স্পোর্টিং ডিরেক্টর: কোন খেলোয়াড়কে দলে ভেড়াতে হবে, সেই সিদ্ধান্ত এই দুজনের উপরই সবচেয়ে নির্ভর করে। দলবদল থেকে শুরু করে ক্লাবের সার্বিক পরিস্থিতির দেখভাল করাই স্পোর্টিং ডিরেক্টরের দায়িত্ব। যেহেতু দলবদলে আর্থিক লাভ-লোকসানের সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি, তাই এই খাতে স্পেশালিস্টদেরই মূলত এই পদে রাখে ক্লাবগুলো। দলবদল ও খেলোয়াড়-সংক্রান্ত যাবতীয় বিষয়ে কোচকে সঙ্গে নিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হয় স্পোর্টিং ডিরেক্টরকে।