• আইসিসি বিশ্বকাপ ২০২৩
  • " />

     

    বিশ্বকাপের আপসেট : আফগান রূপকথা, বাংলাদেশের ইংলিশ বধ ও অন্যান্য

    বিশ্বকাপের আপসেট :  আফগান রূপকথা, বাংলাদেশের ইংলিশ বধ ও অন্যান্য    

    ছোট দলের হাতে কুপোকাত বড় দল। প্রায় প্রতিটি বিশ্বকাপেই এমন দুই একটি ম্যাচের দেখা মিলেই। দুই দলের শক্তির পার্থক্য বিশাল। তবুও দেখা যায় দিনশেষে তুলনামূলক সেই ছোট দলই মাঠ ছাড়ছে জয় নিয়ে। এবারের বিশ্বকাপে এমন আপসেটের জন্ম দিয়েছে আফগানিস্তান, তাও বিশ্বচ্যাম্পিয়ন ইংল্যান্ডকে হারিয়ে। আফগানদের ইংল্যান্ড বধের মতো এমন আরো অনেক আপসেটেরই সাক্ষী হয়েছে ক্রিকেট বিশ্বকাপ। এই ম্যাচসহ বিশ্বকাপ আপসেটের পাতায় জায়গা করে নেয়া ম্যাচগুলোর স্মৃতি ফেরানো যাক আরো একবার। 


    ইংল্যান্ড-আফগানিস্তান, ২০২৩ বিশ্বকাপ 

    শক্তি-সামর্থ্যে দুই দলের পার্থক্যটা দিনের আলোর মতোই পরিস্কার। দুই দেশের ক্রিকেট কাঠামোর, যাবতীয় সুবিধাদির বিশাল ভিন্নতা তো আছেই। তবুও ইংল্যান্ডকে হারিয়েছে আফগানিস্তান। এর মধ্যে দিয়ে ঘুচল আফগানদের অপেক্ষা, বিশ্বকাপে টানা ১৪ হারের পর জিতল কোনো ম্যাচ।  ২০১৫ বিশ্বকাপের সেই আসরে স্কটল্যান্ডকে হারিয়েছিল তারা ৩ বল হাতে রেখে। ইংল্যান্ডকে হারানোর আগে সেটাই ছিল বিশ্বকাপে আফগানিস্তানের একমাত্র জয়। 

    দিল্লীতে কীভাবে আফগানরা করল ইংলিশ বধ? এক কথায় উত্তর দিলে রহমানউল্লাহ গুরবাজের দুর্দান্ত ৮০, ইকরাম আলীখিলের ৫৮ রানের ইনিংসের পর আফগান স্পিনত্রয়ীর জাদুতে। প্রথমে ব্যাট করে ২৮৪ রানের সংগ্রহ। সেটা তাড়া করতে নেমে ৭০ রানের মধ্যেই নেই ইংলিশদের তিন ব্যাটার। টপ অর্ডারের ব্যর্থতার পর জস বাটলার-লিভিংস্টোনরাও সুবিধা করতে পারেননি। যদিও এক প্রান্ত আগলে রেখেছিলেন হ্যারি ব্রুক। 

    তবে রশিদ-মুজিব-নবীদের স্পিন জাদুতে একের পর এক উইকেট হারাতে থাকে ইংল্যান্ড। আলাদা করে বলতে হবে রশিদ খানের কথা। বিশ্বকাপের গত আসরে তাকে রীতিমতো তুলোধুনা করেছিলেন ইংলিশ ব্যাটাররা। রশিদ একাই হজম করেছিলেন ১১টি ছক্কা। সেই রশিদ আর এই রশিদ কত পার্থক্য এবার। তার বোলিং স্পেলটাই যেন গড়ে দিল ম্যাচের সুর। ৯.৩ ওভারে এক মেইডেনসহ ৩৭ রানে নিয়েছেন ৩ উইকেট। ম্যাচের জয়টাও এসেছে তার হাত ধরেই। শেষ ব্যাটার হিসেবে মার্ক উডকে বোল্ড করে ৬৯ রানের ঐতিহাসিক জয় এনে দেন দলকে। 


    বাংলাদেশ-ইংল্যান্ড, ২০১১ ও ২০১৫ বিশ্বকাপ 

    বিশ্বকাপে সবচেয়ে বেশি আপসেটের শিকার হওয়া দলটা সম্ভবত ইংল্যান্ডই। ২০১১ ও ২০১৫; টানা দুই বিশ্বকাপে বাংলাদেশের কাছে হেরেছিল তারা। গেল আসরের মতো এবারও বাংলাদেশ তাদের হারাতে পারেনি। তবে সেই দুই ম্যাচ বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসে আলাদা জায়গা নিয়ে আছে। ।


    ২০১১

    সেবার ঘরের মাঠে ইংল্যান্ডকে হারিয়েছিল বাংলাদেশ। চট্টগ্রামে স্পিন জাদুতে ইংলিশদের আটকে রেখেছিলেন সাকিব আল হাসানরা। ব্যাটিংয়ে ইমরুল কায়েসের শুরু এনে দেয়ার পর শেষটা করেছিলেন মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ ও ব্যাটার বনে যাওয়া পেসার শফিউল ইসলাম। দুজনের অমূল্য ৬৯ রানের জুটিতেই এসেছিল অসাধারণ সেই জয়। তরুণ অধিনায়ক সাকিবের বোলিং চেঞ্জ, ফিল্ড প্লেসিংয়ের মুন্সিয়ানাও সেই ম্যাচে ছিল দেখার মতো। অ্যান্ড্রু স্ট্রস, জোনাথন ট্রট, ইওন মরগানদের বড় ইনিংসের সম্ভাবনা সাকিব গুড়িয়ে দিয়েছিলেন সেদিন। 

    লক্ষ্য তাড়ায় নেমে  তামিম-ইমরুলের পঞ্চাশোর্ধ জুটি,  টপ অর্ডারে কলাপ্সের পর ইমরুলের সাথে সাকিবের ৮৩ রানের প্রতিরোধ। ম্যাচের টোন সেট করে দিয়ে সাকিব ফিরলে আবারও ধ্বস নামে ব্যাটিংয়ে। ৪০-তম ওভারে মাঠে আসেন শফিউল। সেখান থেকেই রিয়াদের সাথে তার হয় ৬৯ রানের জুটি। গ্রায়েম সোয়ানকে সোজা ব্যাটে মাথার ওপর দিয়ে ছক্কা মেরেছিলেন শফিউল, সেটাই বাংলাদেশের ইনিংসের একমাত্র ছক্কা। তার ২৪ বলে ২৪* রানের ইনিংস। রিয়াদের ৪২ বলে ২১*। খুব বড় নয়, তবে এর যে ইম্প্যাক্ট সেটা সেদিন ছাড়িয়ে গিয়েছিল সবকিছুই, পরিস্থিতির জন্য। টিম ব্রেসনানের বলে কভার দিয়ে চার মেরে সেদিন রিয়াদ জয়ের আনন্দে ভাসিয়েছিলেন বাংলাদেশকে। আনন্দে ভাসারই তো কথা! প্রতিপক্ষ ইংল্যান্ড, যে দলের হয়ে খেলছেন স্ট্রস-কলিংউড-সোয়ানের মত ইংলিশ গ্রেটরা। 


    ২০১৫

    অস্ট্রেলিয়ার অ্যাডিলেড ওভাল, রিয়াদের সেঞ্চুরি, তামিমের ক্যাচ মিস, রুবেল হোসেনের রিভার্স সুইং, মাঠের এক কোণে মাশরাফির ওপর পুরো দলের ঝাপিয়ে পড়া জয়ের আনন্দে। ২০১৫ বিশ্বকাপে ইংল্যান্ড বধের স্মৃতিচারণ করতে গেলে এই মুহূর্তগুলোই তো চোখের সামনে ভাসার কথা। 

    বিশ্বকাপে ইংল্যান্ডকে দ্বিতীয় দফায় হারানোর ম্যাচে ব্যাটিং ধ্বসের মুখে পড়েছিল বাংলাদেশ। দুই ওপেনার তামিম-ইমরুল নেই দশ রানের মধ্যে। এরপর রিয়াদের সাথে সৌম্যর জুটি। সৌম্য ফিফটির আগে ফিরলেও রিয়াদ অন্য প্রান্তে ছিলেন অটল। মুশফিকের সাথে ১৪১ রানের জুটি, সেই জুটির পথে করেছিলেন সেঞ্চুরি, বিশ্বকাপে বাংলাদেশের প্রথম সেঞ্চুরিও সেটি। 

    দুজনের দারুণ জুটিতে ২৭৬ রানের লক্ষ্য দেয় বাংলাদেশ। সেই চেজে নেমে মাশরাফি-রুবেলের তোপের মুখে পড়ে ইংলিশরা। দুই পেসারের দারুণ বোলিংয়ে ১৩২ রানের মধ্যেই পড়ে প্রথম পাঁচ উইকেট। তবে বাটলার বড় বিপদের কারণ হয়ে উঠতে থাকেন। সেই ম্যাচে  মাশরাফির বোলিং চেঞ্জও ছিল কার্যকরী। তাসকিন আহমেদকে বোলিংয়ে আনার পর পড়েছিল দুটি উইকেট। জেমস টেলরের পর বাটলারের উইকেটও নিয়েছিলেন তিনি। 

    লং অন বাউন্ডারিতে তামিম ইকবাল ক্রিস ওকসের ক্যাচ ফেলে সবার হার্টবিট খানিকটা বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। তবে রুবেল হোসেনের দুর্দান্ত দুই রিভার্স সুইং ডেলিভারিতে স্টুয়ার্ট ব্রড-জেমস অ্যান্ডারসন বোল্ড হওয়ার পর সেই শংকা উড়ে যায় বাংলাদেশের। টানা দ্বিতীয় বিশ্বকাপে ইংলিশদের বিপক্ষে বাংলাদেশের জয়। নাসের হুসাইনের ধারাভাষ্যটাও মনে আছে নিশ্চয়ই? 


    আয়ারল্যান্ড-ইংল্যান্ড, ২০১১ বিশ্বকাপ

    ২০১১ বিশ্বকাপে বাংলাদেশের কাছে ধরাশায়ী হওয়ার আগে আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষেও হেরেছিল ইংলিশরা। টপ অর্ডার ব্যাটারদের দারুণ সব ইনিংসে ৩২৭ রানের বড় সংগ্রহ পায় ইংল্যান্ড। ব্রড-অ্যান্ডারসন-ব্রেসনানের মতো পেসারদের বিপক্ষে ব্যাট করে সেই রান আইরিশরা তাড়া করে ফেলবে, কেউ ভুলেও হয়তো ভাবেনি সেদিন। 

    কিন্তু সবাই যা ভাবেনি, ভাবতে চায়নি; সেই জিনিসটাই করে দেখিয়েছিলেন কেভিন ও ব্রায়েন। স্টার্লিং-এড জয়েসের ত্রিশোর্ধ্ব ইনিংসে ভিত পাওয়ার পরও ১১১ রানে পড়ে ৫ উইকেট। এরপর ছয়ে নামা ছোট ‘ও ব্রায়েনের’ কাউন্টার অ্যাটাক সেদিন দেখেছিল বেঙ্গালুরু। মাত্র ৫০ বলে সেঞ্চুরি করে হয়েছিলেন ওয়ানডে বিশ্বকাপের দ্রুততম সেঞ্চুরিয়ান। এবার ৪৯ বলে সেঞ্চুরি করে সেই রেকর্ড নিজের করে নিয়েছেন আফ্রিকার এইডেন মার্করাম। রান আউট হয়ে ফেরার আগে কেভিন করেন ৬৩ বলে ১১৩ রান। তার অমন খুনে ব্যাটিংয়ের পর শেষ ওভারের প্রথম বলে চার মেরে জয় নিশ্চিত করেন জন মুনি। এবারের বিশ্বকাপে শ্রীলঙ্কার দেয়া ৩৪৫ রানের লক্ষ্য পাকিস্তান টপকে যাওয়ার আগ পর্যন্ত আইরিশদের এই ইনিংসই ছিল বিশ্বকাপে সর্বোচ্চ রান তাড়ার রেকর্ড। 

     

    বাংলাদেশ-ভারত, ২০০৭ বিশ্বকাপ 

    শচীন টেন্ডুলকার, রাহুল দ্রাবিড়, বীরেন্দ্র শেবাগ, সৌরভ গাঙ্গুলি  যুবরাজ সিং; ভারতের সেই দলকে এক কথায় বলা চলে তারকায় ঠাঁসা। তারকা ঠাঁসা সেই দলকেই ২০০৭ বিশ্বকাপে পোর্ট অফ স্পেনে হারিয়েছিল বাংলাদেশ। মাশরাফির আগুনে ওপেনিং স্পেল, রাজ্জাক-রফিকদের স্পিন জাদু, তামিম ইকবালের আগমনী বার্তা, সাকিব-মুশফিকের নির্ভরতার প্রতীক হয়ে ওঠার সেই ম্যাচে পাত্তাই পায়নি ভারত। 

    ব্যাট হাতে ভারতের হয়ে সেদিন একা লড়েছিলেন সৌরভ। ভারত করে ১৯১ রান। সেই লক্ষ্য তাড়া করতে নেমে জহির খানকে ডাউন দ্য গ্রাউন্ডে এসে তামিমের ছক্কা; এখনো এই দেশের ক্রিকেটপ্রেমীদের মনে আনন্দ দিয়ে যায়। তামিম সেদিন ফিফটির পর ফিরেছিলেন বটে। তবে জয়ের ভিতটা তৈরি করে দিয়েছিলেন ঠিকই। সেই ভিত্র দাঁড়িয়ে সাকিব-মুশফিকের ফিফটিতে জয় পেয়েছিল বাংলাদেশ। সেই জয়ে নিশ্চিত হয়েছিল বিশ্বকাপের সুপার এইট, যেখানে  কোয়ালিফাই করতে পারেনি ভারত। 

     

    বাংলাদেশ-পাকিস্তান, ১৯৯৯ বিশ্বকাপ 

    বাংলাদেশের ক্রিকেট তখন সবে এক পা, দু পা করে এগোচ্ছে। পাকিস্তান ততদিনে এশিয়া তো বটেই, ক্রিকেটেরই অন্যতম পরাশক্তি। ওয়াসিম আকরাম-ওয়াকার ইউনিস-সাকলাইন মুশতাক-সাঈদ আনোয়াররা তখন বিশ্বের সেরা তারকাদের কাতারে। তাদেরই হারিয়ে বিশ্বমঞ্চে প্রথম বড় জয়টা পেয়েছিল বাংলাদেশ। নর্দাম্পটনে টস হেরে ব্যাট করতে নেমে আকরাম খানের ৪২, শাহরিয়ার হোসেন বিদ্যুতের ৩৯ রানে ভরে করে ২২৩ রান করেছিল বাংলাদেশ। ব্যাটিংয়ে নেমে খালেদ মাহমুদ সুজনের দারুণ বোলিংয়ে ধ্বসে পড়ে পাকিস্তানের ব্যাটিং অর্ডার। ৪২ রানেই পড়ে যায় পাঁচ উইকেট। টপ ও মিডল অর্ডারের পাঁচ ব্যাটারই সেদিন ফিরেছিলেন সিঙ্গেল ডিজিটে।

    শেষদিকে আজহার মাহমুদ-ওয়াসিম আকরামদের ছোট ইনিংসে জয়ের দিকে এগোলেও বাংলাদেশি বোলারদের সাথে পেরে ওঠেননি তারা। সেই ম্যাচে পাকিস্তানের শেষ উইকেট পড়ার দৃশ্যটা এখনো বাংলাদেশের ক্রিকেটের ক্লাসিক মোমেন্টের একটি। দুর্জয়ের বলে শোয়েব আকতারের পুশ করে সিংগেলের চেষ্টা, অপির দুর্দান্ত থ্রোতে পাইলটের দারুণ এক রান আউট। 


    ওয়েস্ট ইন্ডিজ-ভারত,  ১৯৮৩ বিশ্বকাপ 

    ১৯৮৩ বিশ্বকাপ। ভারতের জেতা প্রথম বিশ্বকাপ। তাও টানা দুইবারের চ্যাম্পিয়ন ওয়েস্ট ইন্ডিজকে হারিয়ে। উইন্ডিজের সেই দলটায় ছিলেন ভিভ রিচার্ডস, গর্ডন গ্রিনিজ, ক্লাইভ লয়েডের মতো ব্যাটাররা। আর বোলিং অ্যাটাক? ম্যালকম মার্শাল, জোয়েল গার্নার, অ্যান্ডি রবার্টস, মাইকেল হোল্ডিং। প্রতিপক্ষের বুকে কাঁপন ধরাতে আর কী চাই! তবুও ফাইনালে বুক চিতিয়েই তাদের বল খেলেছিলেন কৃষ্ণমাচারি শ্রীকান্ত-মহিন্দর অমরনাথরা। তবে তাদের এনে দেয়া শুরুটা বাকিরা কাজে লাগাতে পারেননি সেভাবে। ৬০ ওভারের ম্যাচে ৮ ওভার বাকি থাকতেই গুটিয়ে যায় ভারত। তবে শেষ উইকেটে সৈয়দ কিরমানি-সান্ধুর ২২ রানের জুটিতে ১৮০ পেরোনো স্কোর পায় ভারত।  

    এরপর বালবিন্দর সান্ধুর অফ কাটারে বোল্ড গর্ডন গ্রিনিজ। ভিভ রিচার্ডস এসে শুরু করেন স্বভাব্জাত ব্যাটিং। সাত চারে ৩৩ রানে পৌঁছানোর পর মদন লালের বলে ক্যাচ তোলেন রিচার্ডস। লেগ সাইডে অনেকটা দৌড়ে গিয়ে সেই ক্যাচ তালুবন্দী করেন অধিনায়ক কপিল দেব। জেফরি ডুজুন-ম্যালকম মার্শাল চেষ্টা করেছিলেন ৪৩ রানের জুটিতে দলকে ম্যাচে ফেরাতে। তবে অমরনাথের স্পেলে ফেরেন দুজনই। অমরনাথের বলেই এসেছিল ভারতের প্রথম বিশ্বজয়ের মুহূর্ত। মাইকেল হোল্ডিংকে এলবিডব্লিউয়ের ফাঁদে ফেলে আউট করে সবাই দেন ভোঁ দৌড়। লর্ডসে।  বিশ্বজয়ের দৌড়।