• আইসিসি বিশ্বকাপ ২০২৩
  • " />

     

    অথচ বিশ্বকাপ কাঁপানো ক্লাসেনই ক্রিকেট ছাড়তে চেয়েছিলেন!

    অথচ বিশ্বকাপ কাঁপানো ক্লাসেনই ক্রিকেট ছাড়তে চেয়েছিলেন!    

    মুম্বাইয়ের ওয়াংখেড়ের ড্রেসিংরুম লাগোয়া নর্থ স্ট্যান্ড থেকে শচীন! শচীন! শুনেই অভ্যস্ত সবাই। কিন্তু বিশ্বকাপে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে দক্ষিণ আফ্রিকার ম্যাচে শোনা গেল ক্লাসেনের নাম। ইংল্যান্ডের বোলারদের ওপর ঝড় বইয়ে যখন সিড়ি বেয়ে উঠছিলেন ক্লাসেন, তখন যেন পুরো নর্থ স্ট্যান্ড হুমড়ি খেয়ে পড়েছিল তার ওপর।  ওয়াংখেড়েতে মাঠ ছেড়েছেন জমজমাট এক ইনিংস খেলে।৬১ বলে সেঞ্চুরি ছোঁয়ার পর থেমেছেন ১০৯ রানে।

    দারুণ এই ইনিংসটা ক্লাসেন খেলেছেন মুম্বাইয়ের প্রচন্ড গরমে হাঁসফাঁস করে। গরমের কারণে ঘাম ঝরছিল, হচ্ছিল ক্র্যাম্পও। গরম সইতে না পেরে বসেই পড়েছিলেন মাঠে একটা সময়। তবে এর চেয়ে বড় লড়াইটাও ক্লাসেন জিতে এসেছেন। ক্রিকেটের প্রতি ভালোবাসাটাই যে হারাতে বসেছিলেন তিনি । ক্যারিয়ারের শুরুর দিকে একবার, আর সর্বশেষ কোভিড জর্জরিত ২০২০ সালে। করোনাক্রান্ত হয়ে দুই মাস প্রায় ঘরবন্দীই ছিলেন। সুস্থ হয়ে রানিং-ট্রেনিং শুরু করতে গিয়েই পড়েন বিপত্তির মুখে।

    টানা ২০-৩০ মিটার দৌড়াতে পারতেন না, টানা পাঁচ মিনিট সাইক্লিংয়ের পর তার হার্টবিট প্রতি মিনিটে হয়ে যেত প্রায় দুইশো! মানসিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়া সেই সময়টার কথা ক্লাসেন নিজেই বলেছেন এক সাক্ষাতকারে।মানসিক অবসাদ পেয়ে বসেছিল তাকে। কোভিড থেকে সেরে ওঠার পর নিজের ফিটনেস ফিরিয়ে আনার সময়টায় ক্রিকেট ছেড়ে দেয়ার কথাও ভেবেছিলেন ক্লাসেন।  তখন পাশে পেয়েছিলেন প্রোটিয়াদের সাবেক টেস্ট অধিনায়ক ডিন এলগারকে। 

     

    এর আগে ক্যারিয়ারের শুরুর দিকেও ক্রিকেটের প্রতি ভালোবাসা হারাতে বসেছিলেন ক্লাসেন। সাদা বলের ক্রিকেটে নিজের সামর্থ্য অনুযায়ী খেলতে পারেননি। সেবার তার হাত ধরেছিলেন  প্রোটিয়াদের সাদা বলের বর্তমান কোচ রব ওয়াল্টার। তার পরামর্শেই ঘরোয়া ক্রিকেটে পারফর্ম করে জাতীয় দলে ফিরেছিলেন ক্লাসেন।

     

    দক্ষিণ আফ্রিকার হয়ে তিন ফরম্যাটের ক্রিকেটেই খেলছেন ক্লাসেন। তবে সাদা বলের ক্রিকেটেই বেশি সফল তিনি। ওয়ানডেতে অভিষেক হয়েছিল কুইন্টন ডি ককের ইনজুরিতে। সেখান থেকে ধীরে ধীরে হয়ে উঠেছেন প্রোটিয়াদের মিডল অর্ডারের ভরসা।

    ম্যাচের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময়, অর্থাৎ মিড ওভারে তার ব্যাটিং গড় আর স্ট্রাইকরেটই বলে দিচ্ছে, কেন পাঁচ নম্বর পজিশনে ক্লাসেন সেরাদের একজন। মিড ওভারে ক্লাসেনের ব্যাটিং গড়  ৪৭.১৩ ও  স্ট্রাইকরেট ১০৭.৪৩। তার ইনিংস কনভার্শনের দারুণ উদাহরণ হয়ে রইল ইংল্যান্ডের বিপক্ষের সেঞ্চুরিটা। ৪০ বলে ফিফটি করেছিলেন, বাকি ৫০ ক্লাসেন পেরিয়েছেন মাত্র ২১ বলে!প্রচন্ড গরমে ধুঁকতে থাকলেও নিজের পাওয়ার হিটিং থেকে সরে আসেননি। ফিনিশার হিসেবেও দারুণ করছেন এই বছর থেকে।ডেথ ওভারে তার স্ট্রাইকরেট ২০০ ছাড়ানো! 

    দক্ষিণ আফ্রিকার ন্যাশনাল ক্রিকেট একাডেমির কোচ শুক্রি কনরাড অবশ্য তাকে ক্যারিয়ারের শুরু থেকেই তাকে ডাকতেন গরীবের ধোনি হিসেবে। মাঠে ধোনির মতোই শান্ত থাকেন ক্লাসেন।

    ক্লাসেনের এই ভয়ংকর ব্যাটিং সত্তার আবির্ভাব মূলত এই বছর থেকেই। তার ওয়ানডে ক্যারিয়ারের মোট রানের অর্ধেকই তুলেছেন এবার। ওয়ানডেতে তার ক্যারিয়ার স্ট্রাইকরেটে যেখানে ১১৪, সেখানে এই বছর ব্যাট করেছেন প্রায় ১৫০ স্ট্রাইকরেট।

                 ওয়ানডেতে ক্লাসেন

     

     

    ম্যাচ

    রান

    স্ট্রাইকরেট

    ব্যাটিং গড়

    ওয়ানডে ক্যারিয়ার

    ৪৫

    ১৫২১

    ১১৪.৬১

    ৪২.২৫

    ২০২৩

    ১৫

    ৭২৫

    ১৪৭.৯৫

    ৫৫.৭৬

     

    বিশেষ করে স্পিন হিটিংয়ে নিজের স্কিলসেট ঝালিয়েছেন এই বছরে। বিশ্বকাপে ঘরের মাঠে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ওয়ানডে সিরিজে সেঞ্চুরি করার ম্যাচে অ্যাডাম জ্যাম্পাকে নিয়েছিলেন এক হাত। জ্যাম্পার ১৭ বল থেকে তুলেছিলেন ৫০ রান। সর্বশেষ ম্যাচে আদিল রশিদকেও খেলেছেন বেশ ভালোভাবেই। তার ১৮ বল থেকে ক্লাসেন পান ২০ রান। রশিদকে যে ছক্কাটা মেরেছিলেন মিড উইকেটের ওপর দিয়ে, সেটা আছড়ে পড়েছিলেন গ্যালারির দশ ধাপ পেছনে।

     

    কেভিন পিটারসেন তাই টুইটারে প্রশ্ন করেছিলেন, সাদা বলে ক্লাসেনের চেয়ে ভালো স্পিন হিটার আর কেউ আছেন কিনা। শেন বন্ড তো সরাসরি বলেই দিয়েছেন, ক্লাসেনের বিপক্ষে বল করা এখন স্পিনারদের জন্য দুঃস্বপ্ন।

     

    স্পিনের বিপক্ষে তার এই পাওয়ার হিটিংয়ের নেপথ্যে আছে ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগগুলো। বিশেষত আইপিএল। আইপিএলে স্পিনের বিপক্ষে ব্যাট করেছেন ১৮০-এর বেশি স্ট্রাইকরেটে। গত আইপিএলে স্পিনের বিপক্ষে তার ব্যাটিংয়ের টোটকা ছিল বলের লাইন যত দ্রুত সম্ভব পিক করে শট নেগোশিয়েট করা। এক্ষেত্রে তাকে সাহায্য করেছে তার বটম হ্যান্ড ও ব্যাকফুট নির্ভর ব্যাটিং। বিশেষ করে স্পিনারদের শর্টার লেংথের ডেলিভারিগুলোতে পুল শট ছিল মূল অস্ত্র।  উইকেটের স্কয়ার রিজিওনও তো তার শক্তির জায়গা।

     

    ডেলিভারির আগে নড়াচড়া করতেন না বলে তার বেজ ছিল স্ট্রং। তাই একই লেন্থের বল ভিন্ন লাইনে পিচ করলেও শট খেলতে পারতেন অনায়াসে। যেহেতু স্পিনারদের ডেলিভারির লাইন-লেংথ পিক করতে পারতেন দ্রুত, তাই হেরফের হলে বাকিটা সামলে নিতেন ফুটওয়ার্কের মাধ্যমে। আইপিএলে স্পিন ট্যাকল করে সেই অভিজ্ঞতার পূর্ণ ব্যবহার ক্লাসেন এখন করছেন বিশ্বকাপে।সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে বিশ্বকাপের বাকিটাতেও হয়তো স্পিনাদের ওপর বয়ে যেতে পারে ক্লাসেনের ঝড়!