• আইসিসি বিশ্বকাপ ২০২৩
  • " />

     

    'একদিন আমি সুপারস্টারের মতো অবসর নেব'

    'একদিন আমি সুপারস্টারের মতো অবসর নেব'    

    চোখ দেখে মনে হয় মাত্রই বুঝি ঘুম থেকে উঠে এলেন। বয়স ৩০ ছুঁইছুঁই হলেও চেহারায় এখনো কৈশোরের লাবণ্য লেপ্টে আছে। কিন্তু ব্যাট হাতে নিলেই বদলে যান কুইন্টন ডি কক। এবারের বিশ্বকাপে বোলাররা বেশ ভালোই টের পাচ্ছেন ‘বেবি ফেইস অ্যাসাসিন’-ডি ককের ব্যাটের তেজ। দুর্দান্ত ব্যাটিংয়ে এখন পর্যন্ত এবারের বিশ্বকাপের সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক। কিন্তু এই দারুণ ছন্দে থেকেও বিশ্বকাপের পরই বিদায় জানাবেন ওয়ানডে ক্রিকেটকে। শেষটাও তাই রাঙাচ্ছেন নিজের মনমতো।

    এবারের আগে খেলেছেন মোট দুইটি ওয়ানডে বিশ্বকাপ। সেই দুই আসরে ছিল না কোনো সেঞ্চুরি। এবার ভারতে শুরুটাই করেছেন সেঞ্চুরি দিয়ে। শ্রীলংকা, অস্ট্রেলিয়ার পর বাংলাদেশের বোলাররা পড়েছেন তাঁর ব্যাটিং ঝড়ের মুখে। পাঁচ ম্যাচের মধ্যে তিনটিতেই সেঞ্চুরি। তাই প্রোটিয়া ভক্তদের আফসোসটা হয়তো একটু বেশিই কাজ করছে; বিশ্বকাপের পর যে আর ওয়ানডেতে দেখা যাবে না তাকে।  

    অথচ দুরন্ত ছন্দে থাকা ডি কক হয়তো ক্রিকেটারই হতেন না! যদি না সেই কৈশোরে তাঁর বাবা তাকে ক্রিকেটের সাথেই আটকে থাকতে না বলতেন। বেসবল খেলোয়াড় হিসেবেই বেড়ে উঠছিলেন ডি কক, এমনকি পেশাদার বেসবল খেলোয়াড় হতে যুক্তরাষ্ট্রেও যেতে চেয়েছিলেন। ভাগ্যিস তাঁর বাবা সেই যাত্রায় আটকেছিলেন তাকে। নইলে এমন দারুণ এক ক্রিকেটারের দেখা প্রোটিয়ারা যে পেত না, সেটা বলে না দিলেও হচ্ছে। 

    জোহানেসবার্গে বেড়ে ওঠা ডি ককের শিক্ষা জীবিন শুরু হয়েছিল কিং এডওয়ার্ডস (সপ্তম) স্কুলে। ক্রিকেটার গড়ে তোলার জন্য যে প্রতিষ্ঠানের খ্যাতি পুরো দক্ষিণ আফ্রিকা জুড়ে। সেই স্কুল থেকেই বেরিয়েছেন গ্রায়েম স্মিথ, নিল ম্যাকেঞ্জি, আলী বাছেরের মতো ক্রিকেটাররা। তবে পড়াশোনা অত টানেনি ডি কককে। পড়ার পাট তাই চুকে গেল অল্প বয়সেই। হাই স্কুল আর শেষ করা হয়নি। 

    ২০০৯ সালে স্কুল ছেড়ে ১৭ বছর বয়সে যোগ দেন হাইভেল্ড স্ট্রাইকার্সে। অবশ্য হাইভেল্ডের তৎকালীন কোচ গ্র্যান্ট মরগ্যান স্কুলের হেডমাস্টারের সাথে মিটিংয়ে বসেছিলেন, ডি ককের ভবিষ্যত নিয়ে কথা। এর আগেই আফ্রিকার তিনদিনের টুর্নামেন্টে খেলে ফেলেছিলেন ডি কক। পেশাদার ক্রিকেটে তখনই হাতেখড়ি তাঁর। ২০১২ সালটা ডি ককের ক্যারিয়ারের অন্যতম সেরা অধ্যায়। সেবারের অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপ দক্ষিণ আফ্রিকা খেলেছিল ডি ককের অধীনে। ডি কক হয়েছিলেন আসরের চতুর্থ সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক। বিশ্বকাপ শেষে ক্লাব ক্রিকেটে ফিরে সফল এক মৌসুম কাটে তাঁর। আফ্রিকার মোমেন্টাম ওয়ানডে কাপ জেতে লায়ন্স, তাও পাঁচ বছর পর। সে বছরই আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টিতে অভিষেক হয়ে যায় তার। 

    দেখতে যতটা শান্তশিষ্ট মনে হয় ডি কককে, ঠিক ততটা তিনি নন। ক্যারিয়ারের শুরুর দিকে বেশ কবার ঝামেলায় জড়িয়েছেন মাঠেই। ২০১৩ সালে চারদিনের ম্যাচ খেলার সময় কেইপ কোবরার ক্রিকেটার অ্যালিস্টার গ্রেকে বুকে ধাক্কা মারার পর ব্যাট দিয়ে মারার হুমকিও দিয়েছিলেন। অল্পের জন্য সেবার নিষিদ্ধ হননি, জরিমানা দিয়ে পাড় পেয়ে যান। ২০১৮ সালে ডারবান টেস্টে কিংসমিডের টানেলে ডেভিড ওয়ার্নারের সাথেও জড়িয়েছিলেন কথার যুদ্ধে। 

    এই ব্যাপারে তার বয়সভিত্তিক দলের কোচ পেডিন আপটন বলেছিলেন,এমনিতে শান্ত থাকলেও পরিস্থিতির কারনে মাঝেমধ্যেই খেপে যান ডি কক। সেটার প্রমাণ তো বেশ কবারই পাওয়া গেছে ক্রিকেট মাঠে। বাংলাদেশ সফরে এসে তামিম ইকবালকে ধাক্কা দিয়ে জরিমানা গুনেছিলেন ম্যাচ ফির ৭৫%। অবশ্য মাঠের সফলতায় তার হুটহাট মাথা গরমের ব্যাপারটা চাপা দিয়েছে বারবার। ২০১৩ সালে আবু ধাবিতেব পাকিস্তানের বিপক্ষে সেঞ্চুরির পর ভারতের বিপক্ষে করেছিলেন টানা তিন সেঞ্চুরি। ২০১৪ সালে টেস্ট দলে ডাক পান। সিডনিতে বছরটা শেষ করেন ষষ্ঠ ওয়ানডে সেঞ্চুরি দিয়ে। স্বপ্নের মতো শুরু আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে। 

    তবে ২০১৫ বিশ্বকাপটা একেবারেই ভালো যায়নি। পারফর্ম্যান্সের জন্য বাদ পড়েন টেস্ট দল থেকেও। নিজের সামর্থ্যকেই প্রশ্ন করে বসেন তখন। তার আক্রমণাত্মক মানসিকতাও দায়ী ছিল এর জন্য। 

    সবকিছু ঝেড়ে ফেলতে ক্রিকেট থেকে বিরতি নেন বেশ লম্বা সময়ের জন্য। মাছ ধরতে পছন্দ করেন খুব। ক্রিকেটের চেয়েও বেশি টানে তাকে বন জঙ্গল। আফ্রিকার জাম্বেজি নদীর পাড়ে যান ক্যাম্প ফায়ার করতে। সেখানেই নির্বিঘ্নে দিন কেটে যায় মাছ ধরে, বনে ঘুরে। ডাউন ব্যাটারি রিচার্জ করে ডি কক ফেরেন ঘরোয়া ক্রিকেটে। ট্রেনিংয়ে ঝালাতে থাকেন নিজের স্কিলসেট। মানসিকতাতেও আসে আমুল পরিবর্তন। নিজেই বুঝতে পারেন, মাঠে কিংবা ব্যক্তিগত জীবনে আরো একটু সহনশীলতা দেখানোর প্রয়োজন তার। সেই পরিবর্তনটাই যেন বদলে দিল সব। 

    ডি ককের সেই বদলটা খুব কাছ থেকে দেখেছেন লায়ন্সের তৎকালীন অধিনায়ক স্টিফেন কুক, যিনি ২০১৬ থেকে ১৭ সালের মধ্যে প্রোটিয়াদের হয়ে খেলেছেন ১১টি টেস্ট। তার মতে ডি কককে মানুষজন সবসময়ই ভুল বুঝেছে, ‘মানুষজন ভাবে সে কোনো কিছু চিন্তা ছাড়াই সিদ্ধান্ত নিয়ে নেয়। আসলে সেটা না। ওর চিন্তা ভাবনার প্রসেসটাই আলাদা।’

    সেটার একটা উদাহরণ কুক দিয়েছেন এভাবে, ‘২০১৬ সালে অস্ট্রেলিয়া সফরের আগে ট্রেনিং ক্যাম্পে আমরা নাথান লায়নের বোলিংয়ের ভিডিও দেখছিলাম। কয়েকটা বল দেখে ও (ডি কক) বলে উঠল, পরেরবার লায়নকে উইকেটের স্কয়ার রিজিওন দিয়ে মারব। সিরিজের দ্বিতীয় টেস্টে লায়নের ১১৫ বল থেকে ৮৭ রান তুলেছিল ও’

    এরপর সময়ের সাথে সাথে কুইন্টন ডি কক আরো পরিণত হয়েছেন। ওয়ানডেতে করেছেন ৬ হাজারের বেশি রান। টি-টোয়েন্টিতে প্রোটিয়াদের সর্বোচ্চ রানের মালিক। ৫৪ ম্যাচ খেলে টেস্টকে জানিয়েছেন বিদায়। তবে ক্যারিয়ারে যা অর্জন করেছেন সেটা তার ‘আউট অফ দ্য বক্স’ চিন্তাভাবনায় জন্যই। সেটা নিজেই স্বীকার করেছেন তিনি। পড়াশোনাটা বেশিদূর এগোয়নি। তবে নিজেই বলেছেন, ‘ড্রেসিংরুমে মজা করে বলি আমার কাছে স্কুল পাশ করিনি। কিন্ত ক্রিকেটে মাস্টার্স ডিগ্রী আছে।’

    ২০১৫ সালে টেস্ট দল থেকে বাদ পড়ার পর ডি কক, স্টিফেন কুককে বলেছিলেন, ‘আমি বাদ পড়েছি ঠিকই, কিন্তু দেখো একদিন আমি সুপারস্টারের মতো অবসর নেব।’

    ডি কক তো সেই পথেই এগোচ্ছেন এবারের বিশ্বকাপে। অবসরের ঘোষণা দিয়ে রাখা ক্রিকেটারের জন্য শেষটা রাঙানোর এর চেয়ে ভালো মঞ্চ তো আর হতেই পারে না। কে জানে! এই সুপারস্টারের হাত ধরে প্রোটিয়াদের শিরোপা খরা কেটেও যেতে পারে এবার।