একাদশ নির্বাচন নাকি নির্বিষ বোলিং : কোথায় ভুল হলো ইংল্যান্ডের?
ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়ন ইংল্যান্ডের এ কি দশা! ছয় ম্যাচের পাঁচটিতে হেরে পয়েন্ট টেবিলের তলানিতে ইংলিশরা।অথচ এবার বিশ্বকাপের অন্যতম ফেবারিট হিসেবে ধরা হচ্ছিল জস বাটলারদের। টাইটেল ফাইট দেয়া অনেক দূরের কথা, সেমির আশাই বলা চলে শেষ ইংলিশদের। আগের বিশ্বকাপের নায়ক বেন স্টোকস ফিরেছেন অবসর ভেঙে, ইংল্যান্ডের এই দলটাও অল আউট অ্যাটাকিং ক্রিকেট খেলেই অভ্যস্ত। তবুও কী এমন ভুল হলো তাদের? এই ব্যর্থতার কারণই বা কী?
বিশ্বকাপে বাংলাদেশের বিপক্ষে পাওয়া জয়টাই এখন পর্যন্ত একমাত্র সাফল্য ইংল্যান্ডের। প্রথম তিন হারে দলের মিসিং লিংক ছিলেন বোলাররা, পরের দুটোতে ব্যাটিং কলাপ্স। এসবের বাইরেও কিছু জায়গায় হিসেব মেলেনি ইংল্যান্ডের।
একাদশ নির্বাচনে ভুল?
পাঁচ ব্যাটার, সাথে মঈন আলী, লিভিংস্টোন থাকতেন পঞ্চম বোলার হিসেবে। তিনজন পেসারের সাথে লেগি আদিল রশিদ। বিশ্বকাপের আগ পর্যন্ত এমনই ছিল ইংল্যান্ডের টিম কম্বিনেশন। কিন্তু বিশ্বকাপে প্রায় প্রতি ম্যাচেই আলাদা একাদশ খেলিয়েছে ইংল্যান্ড। কিন্তু সেরা কম্বিনেশনটাই খুঁজে পায়নি এখনো।
প্রথম ম্যাচে এই কম্বিনেশনই ছিল ইংল্যান্ডের। তবে সেই একাদশের মিসিং লিংক ছিলেন স্যাম কারান। টি-টোয়েন্টির পরীক্ষিত বোলার হলেও ওয়ানডেতে ফ্রন্ট-লাইন বোলার হিসেবে নিজের প্রমাণের বাকি তার। টি-টোয়েন্টিতে বোলিং গড় ২৩.৮৬, ওয়ানডেতে সেটা ৩৯.০০।
প্রোটিয়াদের বিপক্ষে চতুর্থ ম্যাচে ছয় ব্যাটার নিয়েও ঠেকাতে পারেনি ব্যাটিং কলাপ্স। শ্রীলংকার বিপক্ষে ইংল্যান্ড ফিরে যায় তাদের স্ট্যান্ডার্ড ইলেভেনে। অবশ্য সেই ম্যাচেও বড় ব্যবধানে হেরেছে ইংলিশরা। ভারতের বিপক্ষেও একই একাদশ খেলিয়েও ম্যাচ হারতে হয়েছে।
টসের সিদ্ধান্তে গোলমাল?
আফগানিস্তান ও দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে ইংল্যান্ড হেরেছে টসে জিতে বোলিং করে। পাকিস্তানের বিপক্ষে আফগানরা চেজ করে জিতলেও ইংল্যান্ডের বিপক্ষে টসে হারাই শাপেবর হয়েছিল তাদের। দুই ওপেনারের দারুণ শুরুতে ফাইটিং টোটাল নিয়ে তিন স্পিনারকে দিয়ে অ্যাটাক করে জয় পেয়েছে আফগানরা। যেন এই অপেক্ষাতেই ছিল তারা ইংল্যান্ডও সেই সুযোগটা দিয়েছে তাদের।
দক্ষিণ আফ্রিকা পুরো টুর্নামেন্টেই প্রথম ইনিংসের দুর্দান্ত দল। প্রোটিয়াদের কমপ্যাক্ট ব্যাটিং অর্ডারের বিপক্ষে কেবল পাঁচ বোলার নিয়ে নেমেছিল ইংল্যান্ড। যাদের মধ্যে মার্ক উড-রিস টপলির ছিল ইনজুরি ইস্যু,আরেক বোলার আদিল রশিদ ছিলেন অসুস্থ।
পরিসংখ্যানে অতিমাত্রায় নির্ভরতা
মুম্বাইয়ের ওয়াংখেড়তে চেজ করে জেতার রেকর্ড ভালো বলে সেই ম্যাচে বোলিং নিয়েছিল ইংল্যান্ড। কিন্তু এবারের দক্ষিণ আফ্রিকা-ইংল্যান্ড ম্যাচের আগে সর্বশেষ ওয়ানডে হয়েছিল এই বছরের মার্চে, তাও তিন বছরের ব্যবধানে। এই সময়ে মাঠ, উইকেটের গতি-প্রকৃতি তো বদলেছেই।
অধিনায়কত্ব
মাঠের অধিনায়কত্বে জস বাটলারকে নিয়ে প্রশ্ন উঠতেই পারে। তবে কোনো বোলার মার খেলে বারবার তার কাছে ছুটে গিয়ে কথা বলাটাও তার পক্ষে একটু মুশকিলই। কারণ তিনি উইকেটকিপার। সেখানে বাটলারকে সাপোর্ট করতেন সহ-অধিনায়ক মঈন আলী। অথচ সেই মঈনই খেলেননি তিন ম্যাচ। কোচ ম্যাথু মট বলেছিলেন, স্টোকস তাদের 'স্পিরিচুয়াল ক্যাপ্টেন।' সেই স্টোকসও খেলতে পারেননি তিন ম্যাচে। এটা পরিষ্কার, মাঠে ক্যাপ্টেন্সিতে বাটলারের পাশে কাউকে না কাউকে লাগেই। মঈন, স্টোকসের না থাকার প্রভাব স্পষ্টতই পড়েছে সেই ম্যাচগুলোতে।
ব্যক্তিগত সাফল্যে পিছিয়ে থাকা
পেসারদের নিয়ে টুর্নামেন্ট জুড়েই ভুগছে ইংল্যান্ড। ছন্দে ছিলেন কেবল রিস টপলি, আঙ্গুলের চোটে বিশ্বকাপ শেষ তার। ক্রিস ওকস ইংল্যান্ডের পেস অ্যাটাকের অন্যতম অস্ত্র। সব মিলিয়ে পেয়েছেন ৪ উইকেট। নতুন বলে যেন ধার হারিয়ে গেছে তার। এক্সপ্রেস পেসার মার্ক উডও ক্যারিয়ারের চ্যালেঞ্জিং একটা সময় পার করছেন। এখন পর্যন্ত ইমপ্যাক্ট রাখতে পারেননি সেভাবে। ক্যারিয়ারে প্রথমবারের মতো রান দিয়েছেন দশের বেশি করে, তাও দুই ম্যাচে।
বিশ্বকাপে ওকস-উড
বোলার |
ম্যাচ |
উইকেট |
গড় |
ক্রিস ওকস |
৫ |
৪ |
৪৯.৫০ |
মার্ক উড |
৬ |
৪ |
৬৯.৭৫ |
এবারের বিশ্বকাপে ১৭ গড়ে ব্যাট করছেন তর্কাতীতভাবে সাদা বলে ইংল্যান্ডের সেরা ব্যাটার জস বাটলার। তার অফ ফর্মও ভোগাচ্ছে ইংল্যান্ডকে। টপ অর্ডারে জনি বেইরস্টোও ছন্দে নেই। একমাত্র ফিফটি পেয়েছেন শুরুর দিকে বাংলাদেশের বিপক্ষে। তার ব্যাটিং গড় মাত্র ২৩। ইংল্যান্ডের নাম্বার সিক্স লিভিংস্টোনও বলার মতো কিছু করতে পারেননি। এখন পর্যন্ত তার সর্বোচ্চ স্কোর ২৭।
কম ওয়ানডে খেলা
২০১৯ সালের পর থেকে মাত্র ৪২টি ওয়ানডে খেলে এবারের বিশ্বকাপে এসেছে ইংল্যান্ড। অথচ ২০১৫ বিশ্বকাপে ভরাডুবির পর চার বছরে মোট ৮৮টি ওয়ানডে খেলেছিল ইংল্যান্ডের বিশ্বকাপজয়ী সেই দল। টেস্ট আর টি-টোয়েন্টিতে মনোযোগ দিতে গিয়ে ওয়ানডেতে ভাটা পড়ে গেছে ইংলিশদের।
বিশ্বকাপের আগে হওয়া নিউজিল্যান্ড সিরিজ দিয়ে রুট ওয়ানডেতে ফিরেছিলেন এক বছরের বিরতির পর। অবসর ভেঙে ফেরা স্টোকসের বিরতিও একই দৈর্ঘ্যের। নিউজিল্যান্ড সিরিজের আগে দুজনই ওয়ানডে খেলেছেন ২০২২ সালে।
কম ওয়ানডে খেলা, অধিনায়কত্ব ইস্যু, শীর্ষ ক্রিকেটারদের ফর্মহীনতা মিলিয়ে বিশ্বকাপে দুঃস্বপ্নের সময় কাটছে ইংল্যান্ডের।আফগানিস্তানের কাছে হারার পর নাসের হুসাইনও বলেছেন, ওয়ানডেতে ইংল্যান্ডের দাপটের শেষ দেখে ফেলেছে ক্রিকেট। ইংল্যান্ডের হাতে আছে তিন ম্যাচ। আগামী চ্যাম্পিয়নস ট্রফিতে খেলতে চাইলে থাকতে হবে পয়েন্ট টেবিলের শীর্ষ আটে। আপাতত ইংলিশদের সামনে বড় চ্যালেঞ্জ এটাই। আর ওয়ানডে ক্রিকেটে এখনো হারিয়ে যায়নি ইংল্যান্ড, সেটা প্রমাণের লড়াইটাইও তো আছেই!