• ভারত-ইংল্যান্ড
  • " />

     

    রাজকোটে যেভাবে সত্যি হলো সরফরাজ আর তার বাবার স্বপ্ন

    রাজকোটে যেভাবে সত্যি হলো সরফরাজ আর তার বাবার স্বপ্ন    

    ভারতের অভিষিক্ত টেস্ট ক্রিকেটার সরফরাজ খান জড়িয়ে ধরেছেন তার বাবা নওশাদ খানকে। হাতে টেস্ট ক্যাপ। গত কয়দিনে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে স দেখে হয়তো আবেগাপ্লুত হয়েছেন আপনিও। একজন ক্রিকেটারের জীবনে বাবার অবদান কতখানি? সেটা বলে দিচ্ছে সরফরাজ খান আর নওশাদ খানের এই ছবিটাই।সন্তানের জন্য বাবারা তো কত ত্যাগই স্বীকার করেন। তবে নওশাদ খান যা করেছেন, সেটা আলাদা একটা গল্পই বলে যায়।  কিংবদন্তি অনীল কুম্বলের হাত থেকে সরফরাজ যখন টেস্ট ক্যাপটা নিচ্ছিলেন। তখন একটু দূরে দাঁড়িয়ে ছিলেন নওশাদ। যার অনুপ্রেরনা, জেদ, ত্যাগ আর পরিশ্রমে সরফরাজের এত দূর আসা।

    বাবার পরিশ্রম আর নিজের নিবেদনে ভারতের ঘরোয়া ক্রিকেটে রান বন্যা বইয়ে দিয়েছিলেন সরফরাজ, কিন্তু জাতীয় দলে ডাক পাচ্ছিলেন না। অবশেষে ভাগ্যের শিকে ছিঁড়ল। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে প্রথমবার জাতীয় দলে ডাক পেয়ে সেই সিরিজেই টেস্ট অভিষেক। দুই ইনিংসেই করেছেন ফিফটি। 

    নওশাদ চোখে জল নিয়ে ছেলের টেস্ট ক্যাপটায় হাত ছুঁইয়েছেন, চুমু খেয়েছেন। ভারতের ৩১১ নম্বর টেস্ট ক্যাপটা তো তারও। নিজে ছিলেন মুম্বাইয়ের ক্রিকেটার। স্বপ্ন দেখতেন একদিন জাতীয় দলে খেলবেন। নওশাদ নিজে পারেননি, তবে ছেলেকে দিয়ে সেই স্বপ্ন পূরণ করেছেন। চোখের সামনে সেই স্বপ্ন সত্যি হয়েছে। এমন দিনে আবেগ কি আর বাধা মানে!

    সরফরাজের এই রোলার কস্টার রাইডে তার ছায়াসঙ্গী ছিলেন তার বাবা ও কোচ নওশাদ খান। সেই ছয় বছর বয়সে ছেলের হাতে তুলে দিয়েছিলেন ব্যাট। মুম্বাইয়ের কুরলায় নিজের বাড়িতে বানানো ১৮ গজের টার্ফের উইকেটে থ্রোয়ের পর থ্রো করে গেছেন সরফরাজকে। মূলত সেখানেই গড়ে উঠেছে সরফরাজের ব্যাটিং সত্তা।

    এরপর থেকে ক্রিকেটকে ধ্যানজ্ঞানই বানিয়ে ফেলেছেন সরফরাজ। যেদিন কোনো খেলা থাকে না, সেদিন ভোর পাঁচটায় শুরু হয় ক্রস ময়দানের অনুশীলন। এরপর মুম্বাইয়ের রঞ্জি দলের নেটে কাটে দুপুর পর্যন্ত। বাড়ি ফিরেও ক্ষান্ত নেই, সন্ধ্যা পর্যন্ত চলে টার্ফের উইকেটে ব্যাটিং।

    অফ সিজনেও ছুটি মেলেনি সরফরাজ ও তার ভাই মুশিরের। যিনি এবার খেলেছেন ভারতের হয়ে অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপে। নওশাদ তার দুই ছেলেকে নিয়ে বেরিয়ে পড়তেন মুম্বাই থেকে আগ্রার উদ্দেশ্যে ১৮০০ কিলোর লং ড্রাইভে। চলতি পথে বিভিন্ন শহরের নানান ক্লাবে ম্যাচ খেলে বেড়াতেন দুজন। অর্থাৎ ক্রিকেট থেকে বাইরে যাওয়ার সুযোগই নেই সরফরাজ-মুশিরের। 

    সরফরাজ ক্রিকেটের প্রতি এই নিবেদনের ফলটা মাঠে পেতে শুরু করেছেন ২০১৯ মৌসুম থেকে। ২০১৯-২০ ও ২০২১-২০২২ টানা দুই মৌসুমে রঞ্জি ট্রফিতে ৯০০-এর বেশি রান। ঘরোয়া ক্রিকেটে তার ব্যাটিং গড় ৭০ ছোঁয়া, ক্রিকেটের ইতিহাসেই চতুর্থ সর্বোচ্চ। ২০২০ সালের পর থেকে এখন পর্যন্ত ফার্স্ট ক্লাস ক্রিকেটে দুই হাজারের বেশি রান করেছেন ৮২ গড়ে। এই সময়ে তার চেয়ে বেশি  রান করতে পারেনি আর কোনো ব্যাটারই।

    এমন দারুণ রেকর্ডের পরও জাতীয় দলের দরজা খুলছিল না সরফরাজের জন্য।  এ নিয়ে সুনীল গাভাস্কার, ইরফান পাঠান, আকাশ চোপড়ার মতো  সাবেক অনেক ক্রিকেটারই সমালোচনা করেছেন নির্বাচক প্যানেলের। সরফরাজ নিজেও এক সেঞ্চুরির পর তেড়েফুড়ে উদযাপন করে জবাব দিয়েছিলেন। তবে সরফরাজের অপেক্ষার প্রহর ফুরিয়েছে, ধৈর্য্য আর পরিশ্রমের ফল পেয়েছেন তার বাবা নওশাদও। বাবা-ছেলের অক্লান্ত পরিশ্রমের প্রতিদান পাওয়ার সাক্ষী হয়ে রইল রাজকোট স্টেডিয়াম। 

    অবশ্য প্রথমবার ব্যাটিংয়ে নামার আগেও অপেক্ষা ফুরাচ্ছিল না সরফরাজের । চার ঘণ্টা প্যাড-আপ করে বসেছিলেন। পরে অবশ্য ভেবেছেন, সারাজীবন যে মুহূর্তটার জন্য অপেক্ষা করেছেন, সেটার জন্য আরো কয়েক ঘন্টা ধৈর্য্য তো ধরাই যায়। বলেছিলেন, 'প্যাড পরে প্রায় চার ঘণ্টা বসে ছিলাম। তখন মনে পড়ল সারাজীবনই আমি অপেক্ষা করেছি। আরো একটু অপেক্ষা করাই উচিত আমার।'

    রাজকোটের গ্যালারিতে বসে ছেলের প্রথম আন্তর্জাতিক ইনিংস দেখেছেন নওশাদ। দারুণ খেলতে থাকা সরফরাজ থেমেছেন জাদেজার ভুল করে রান আউটে কাটা পড়ে। সরফরাজের ইনিংসের এমন সমাপ্তি দেখে ড্রেসিংরুমে অধিনায়ক রোহিত তখন রেগেমেগে মাথার ক্যাপটা আছড়ে ফেলেছেন। দিন শেষে জাদেজাও সোশ্যাল মিডিয়াতে সরফরাজকে স্যরি বলেছেন। এটাই বলে দেয় সরফরাজের সামর্থ্য আর প্রতিভার প্রতি কতটা প্রত্যাশা সবার।

    আলোচনায় এসেছিলেন সেই শৈশবেই। হ্যারিস শিল্ড আন্তঃস্কুল টুর্নামেন্টে  ২০০৯ সালে ৪৩৯ রানের ইনিংসে  ভেঙেছিলেন শচীন টেন্ডুলকারের রেকর্ড। সরফরাজকে একবার দেখবেন বলে মুম্বাইয়ের ক্রস ময়দানে সেদিন টিভি রিপোর্টারদের সাথে ভিড় জমিয়েছিলেন দর্শকরাও।

    যার রেকর্ড ভেঙে স্পটলাইট টেনেছিলেন নিজের দিকে, সেই শচীনকে প্রথম সামনে থেকে দেখেছিলেন মুম্বাই ইন্ডিয়ান্সের নেটে। বাংলাদেশের মোহাম্মদ আশরাফুল তখন ব্যাটিংয়ের টোটকা নিচ্ছিলেন শচীনের কাছ থেকে। আশরাফুলকে দেয়া শচীনের সেই টিপস শুনে সেটা কাজে লাগিয়েছিলেন সরফরাজও।

    এরপর থেকে কেবলই ছুটেছেন সরফরাজ। মুম্বাইয়ের বয়সভিত্তিক দল থেকে শুরু করে মূল  দল, দুটো অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপ, আলো ঝলমলে আইপিএল। সবই পেয়েছেন। তবুও এরপর পা হড়কেছে, পথ হারিয়ে আবার ফিরেছেন। এখন সরফরাজের অপেক্ষা আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে রান ফোয়ার ছোটানোর।

    রাজকোট টেস্টের প্রথমদিন শেষে ভিডিও কলে ছোট ভাই মুশিরের সাথে কথা বলছিলেন সরফরাজ।দুই ভাইয়ের কথোপকথনের এক পর্যায়ে শোনা যায়, সরফরাজ মুশিরকে বলছেন, একদিন তুইও এখানে খেলতে আসবি। কে জানে! পাঠান কিংবা পান্ডিয়া ব্রাদার্সের মতো খান ব্রাদার্সকেও হয়তো অদূর ভবিষ্যতে ভারতের জার্সিতে দেখা যাবে একসাথে