অল্প গল্পে অলিম্পিক -৪: লজ্জা, আফসোস এবং অন্ধকারের গল্প
প্রথম পর্বঃ অল্প গল্পে অলিম্পিক ১ঃ হারকিউলেসের হাত ধরে
দ্বিতীয় পর্বঃ অল্প গল্পে অলিম্পিক ২ঃ সিনেমা যেখানে হার মানে
তৃতীয় পর্বঃ অল্প গল্পে অলিম্পিক ৩ঃ হিটলার, জয় ও ভয়
‘শেইম’ ‘শেইম’ ‘শেইম’
পেন্টাথলনের উদ্ভব খ্রীস্টের জন্মেরও ৭০৬ বছর আগে, প্রাচীন গ্রিসে। লং জাম্প, জ্যাভলিন থ্রো, ডিসকাস থ্রো, স্তাদিওন এবং রেসলিং নিয়ে আয়োজিত পেন্টাথলনে একজন এথলেটের নৈপুণ্য এবং সক্ষমতার চূড়ান্ত প্রদর্শনী হত। এখনকার যুগেও পেন্টাথলন হয় তবে সেটা দু’ভাগে ভাগ হয়ে গেছে। ‘ক্ল্যাসিক পেন্টাথলন’ প্রাচীন পেন্টাথলনের মতই; তবে এখন স্তাদিওন আর রেসলিং এর বদলে ২০০ মিটার এবং ১৫০০ মিটার দৌড়ে প্রতিযোগীদের অবতীর্ণ হতে হয়। আরেকটা পেন্টাথলন আছে যেটা আধুনিক অলিম্পিকের জনক ব্যারন পিঁয়েরে দ্য কুবার্তিনের মস্তিষ্ক-প্রসূত। একজন সৈনিকের যেসব ক্ষেত্রে দক্ষতা অপরিহার্য তা নিয়েই এই ‘মডার্ন পেন্টাথলন’। এই পেন্টাথলনের ইভেন্টগুলো হচ্ছে ফেন্সিং, পিস্টল শ্যুটিং, ফ্রিস্টাইল সাঁতার, ইকুয়েস্ট্রিয়ান আর দৌড়।
বরিস ওনিশ্চেঙ্কো, তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের পেন্টাথলন ইভেন্টের ধারক বাহক সবই ছিলেন উনি। ১৯৬৮ মেক্সিকো সিটি অলিম্পিকের রূপাজয়ী ছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন, পরবর্তী মিউনিখ অলিম্পিকের সোনাজয়ীও ছিল তাঁরা। দলগত সোনার পাশাপাশি ব্যক্তিগত ইভেন্টেও ঐ অলিম্পিকে বরিস রূপা জিতেছিলেন। ১৯৭৬ মন্ট্রিল অলিম্পিকেও পেন্টাথলন ফেবারিট ছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন, তৃতীয় অলিম্পিক খেলতে আসা বরিস ওনিশ্চেঙ্কো গেমস ভিলেজে ছিলেন অন্যতম সম্মানিত এথলেট।
ফেন্সিং খেলার সময় খেলোয়াড়েরা যেই জবরজং পোষাক পড়ে খেলেন তা নিরাপত্তা যেমন দেয় তেমনি স্কোরিংয়েও সহায়তা করে। পোষাকের উপর একটা কর্ড তৈরি করা থাকে, যদি প্রতিপক্ষ ৭৫০ গ্রামের বেশি বল প্রয়োগ করে ফেন্স দিয়ে খোঁচা দিতে পারে তাহলে এই কর্ড, ফেন্সের অগ্রভাগ এবং পোষাকের ভিতর থাকা বিশেষ স্কোরিং বক্স একটা সার্কিট তৈরি করে। ফলশ্রুতিতে জ্বলে উঠে বাতি এবং প্রতিপক্ষ এক পয়েন্ট পায়। তবে বরিস এমন একটি ফেন্স ব্যবহার করেছিলেন যেটি ৭৫০ গ্রাম বল প্রয়োগ না করলেও সার্কিট তৈরি করে ফেলত যার পুরোটাই ছিল কারিগরি কারসাজি! শরীরে আঘাত না করেও পয়েন্ট পাচ্ছেন দেখে ব্রিটেনের এথলেটরা সোচ্চার হয়ে প্রতিবাদ জানালে তাঁর ফেন্স পরীক্ষা করা হয়। ধরা পরে যাবার ফলাফল তো অনুমিতই, সোভিয়েত ইউনিয়ন ইভেন্ট থেকে বহিষ্কৃত হয়।
তাঁর এই জালিয়াতির কথা পেন্টাথলন দলের অন্যান্য সদস্যরাও জানতেন না, তাই নিশ্চিত পদক হারিয়ে তাঁরা প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ হন, গেমস ভিলেজেই বরিসকে বেশ কয়েকধাপ মার খেতে হয়! দেশের ভাবমূর্তি বিনষ্ট করায় সোভিয়েত ভলিবল টিম হুমকি দেয় গেমস ভিলেজে দেখা হলে বরিসকে তাঁরা তিন তলা থেকে নিচে ফেলে দিবে! অবস্থা বেগতিক দেখে পুলিশি তৎপরতায় তাঁকে দ্রুত দেশে পাঠানো হয়। দেশে ফিরেও অবশ্য নিষ্কৃতি মিলে নি। তৎকালীন সোভিয়েত রেড আর্মি তাঁকে তলব করে সব পদক ফিরিয়ে নেয়। সাথে ফিরিয়ে নেয় রাষ্ট্রপ্রদত্ত সব সুবিধাও।
বরিস ওনিশ্চেঙ্কো বর্তমান রাশিয়াতে তাই অলিম্পিক সোনাজয়ী হিসেবে নন বরং ‘ডিজওনিশ্চেঙ্কো’ নামে পরিচিত। স্বর্গ থেকে নরকে পতনের উদাহরণ বোধ হয় এমনি হয়!
পলার দুঃখ!!!
ব্রিটিশ দূরপাল্লার দৌড়বিদ পলা রেডক্লিফ বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে সোনা জিতেছেন, বিশ্ব ক্রস কান্ট্রি চ্যাম্পিয়নশিপে সাত বার পদক জিতেছেন, ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপে ১০০০০ মিটার দৌড়ে হয়েছেন চ্যাম্পিয়ন, বিশ্ব হাফ ম্যারাথনে তিনবার অংশ নিয়ে তিনবারই হয়েছেন চ্যাম্পিয়ন, ইউরোপিয়ান ক্রস কান্ট্রি চ্যাম্পিয়নশিপ এবং ইউরোপিয়ান কাপ মিলে পদক জিতেছেন আরো দশবার। তিনি কমনওয়েলথ গেমসেরও ৫০০০ মিটারে সোনাজয়ী। প্রমীলা ম্যারাথনের বিশ্বরেকর্ড ধারীও তিনি, নিজের রেকর্ড নিজেই ভেঙ্গেছেন দুবার! ব্রিটেনের গত বিশ বছরের ইতিহাসে একমাত্র নারী এথলেট তিনি যিনি ‘বিবিসি স্পোর্টস পার্সোনালিটি অব দ্য ইয়ার খেতাব’ জিতেছেন। এতকিছুর পরও পলা তাঁর এই সমস্ত খেতাব দিয়ে দিতে রাজি আছেন একটি অলিম্পিক পদকের বিনিময়ে! তাঁর শোকেসে এই একটি পদকই তো নেই!
পলার দুঃখটা আসলে ব্রিটেনেরই দুঃখ। ২০০৪ এথেন্স অলিম্পিকের অবিসংবাদিত ফেবারিট ছিলেন তিনি। প্রমীলা ম্যারাথনে ব্রিটেনের সোনা নিশ্চিত ধরা ছিল এই পলা রেডক্লিফের জন্যেই। গেমস শুরুর দুই সপ্তাহ আগে পায়ের সামান্য চোটের দ্রুত আরোগ্যের জন্য হাই ডোজ ওষুধ সেবনই শেষ পর্যন্ত কাল হয়ে দাঁড়ায় তাঁর জন্যে। ওষুধটার জন্যে তাঁর পাকস্থলী খাবার শোষণ করতে পারছিল না, ফলশ্রুতিতে দৌড়ানোর সময় অনুভব করছিলেন তীব্র ব্যথা। ম্যারাথনে ৩৬ কিলোমিটার দৌড়ানোর পর এজন্যেই নিজেকে গুটিয়ে নেন। ৫ দিন পর ১০০০০ কিলোমিটার ইভেন্টেও একই সমস্যাতে পড়েন, ওই ইভেন্টের দৌড়ও শেষ করতে তিনি পারেননি। যার উপলক্ষ্যে দুটি সোনা ব্রিটেন নিশ্চিত ধরে রেখেছিল, তাঁর এই ‘উইথড্রয়াল’ স্বাভাবিকভাবেই ব্রিটিশ মিডিয়া সহজভাবে নেয় নি। তিনি কেঁদেছেন এই ছবি যেমন তাঁরা ছেপেছে, তেমনি ‘উইথড্র’ করার জন্যে কঠোর ভাষায় এর সমালোচনাও করেছে! হিপোক্রিসি বোধহয় একেই বলে!
এথেন্স আর বেইজিং অলিম্পিকের মাঝখানে পলা আরো অনেক পদক জিতেছেন, ফর্মের চূড়ান্তে উঠেছেন এবং বেইজিং অলিম্পিক শুরুর আগে পুনরায় চোটে পড়েছেন! পলার অলিম্পিক পদকহীনতা আসলে অলিম্পিকের ইতিহাসেই একটা বিরাট ধাঁধা।
‘ওয়ার্ল্ড’স গ্রেটেস্ট এথলেট’
বর্তমানে মর্ত্যে বাসকারী সেরা অ্যাথলেট অ্যাশটন কীটন! টাইসন গে, উসাইন বোল্টকে বাদ দিয়ে এই কোথাকার কোন অ্যাশটন কীটনকে বিশ্বসেরা অ্যাথলেটের মর্যাদা দেয়ায় আপনি ভ্রুকুটি করলেও আসলে কিছু করার নেই। ১৯১২ সাল থেকে এই নিয়মই চলে আসছে, দুই দিন ব্যাপী চলা ডেকাথলন ইভেন্টে সোনাজয়ী অ্যাথলেটকেই এই অভিধায় ভূষিত করা হয়!
কীটন এই ইভেন্টে যদি এবিডি ভিলিয়ার্স হন, তবে ডালি থম্পসন হবেন স্যার ডোনাল্ড ব্র্যাডম্যান! এই ইভেন্টে ডালি নিজের করা বিশ্বরেকর্ড নিজেই ভেঙ্গেছেন ৪ বার! জিতেছেন পরপর দুই অলিম্পিকে সোনা। এত কঠিন এই ইভেন্টটিতে সোনা ধরে রাখার এই গর্ব কেবল তাঁর একারই আছে। একটু ঝুঁকি নিয়ে তাই বলাই যায়- চারবার রেকর্ড ভাঙ্গার রেকর্ডের মত তাঁর এই রেকর্ডটিও অবিনশ্বর হয়ে থাকবে।
ব্রিটিশ অ্যাথলেট ডালি থম্পসন শুধু অলিম্পিকেই সোনা ধরে রাখেন নি, টানা তিনটি কমনওয়েলথ গেমসেও তিনি ছিলেন ডেকাথলনের চ্যাম্পিয়ন। এই ইভেন্টের প্রথম দিনে একজন অ্যাথলেটকে ১০০ মিটার, ৪০০ মিটার দৌড়ের সাথে লং জাম্প, হাই জাম্প, শটপুটে অংশ নিতে হয়। দ্বিতীয় দিনে ১১০ মিটার হার্ডলস আর ১৫০০ মিটার দৌড়, সাথে ডিসকাস থ্রো, পোল ভোল্ট এবং জ্যাভলিন থ্রো। বেশি সংখ্যক ইভেন্টে প্রথম হলেই আপনি পদক জিতবেন ব্যাপারটা এখানে সেরকম নয়, আপনাকে আলাদাভাবে প্রত্যেক ইভেন্টে দক্ষতা দেখিয়ে পয়েন্ট জিততে হবে! শারীরিক সক্ষমতা তো লাগবেই, সাথে থাকতে হবে সাংঘাতিক মানসিক জোর। ডালির টানা চ্যাম্পিয়ন হবার মর্মার্থটা আসলে এখানেই। টানা আট বছর ফিট থেকে সব আসরে টানা সোনা জয়ের এই কৃতিত্বটা এজন্যেই অমূল্য, অস্পর্শনীয়। আমরা ডালির নাম না জানলেও বাইরের দেশে কিন্তু তিনি ঠিকই বিখ্যাত। সেই ১৯৮৪ সালেই ডালি থম্পসনকে নিয়ে ভিডিও গেমস বের হয়েছে। ট্র্যাক এন্ড ফিল্ডের কোন ক্রীড়াবিদকে নিয়ে কম্পিউটার গেমস বানানোর উদাহরণ বোধহয় এই একটাই।
‘মিউনিখের কালো রাত’
জার্মানিতে অলিম্পিক ফিরল ৩৬ বছর পর।
পশ্চিম জার্মানির আয়োজকেরা চেষ্টার কমতি রাখেন নি; ১৯৩৬ আসরের নাৎসি আদবকেতা জার্মানদের গায়ে যে কালো দাগ রেখে গিয়েছিল, আয়োজকরা তা দূর করতে আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়েছিলেন। তা আর হয়নি, জার্মানির অলিম্পিক এখনো তাই যতটা মাঠের কারণে স্মরণে আসে, তাঁর চাইতে বেশি আসে মাঠের বাইরের কলঙ্কজনক অধ্যায়ের জন্য।
মিউনিখের অধ্যায়টা তবে শুধু অলিম্পিক নয়, পুরো মানবজাতির জন্যেই কালো ইতিহাস। প্যালেস্টাইনের স্বাধীনতাকামী এবং বিপথে যাওয়া কিছু বিদ্রোহী গেমস ভিলেজে এসে এগারজন ইসরায়েলিকে জিম্মি করে ফেলে! জার্মানির অভ্যন্তর থেকে তাদের সহায়তা দেয় নব্য নাৎসি দল ‘ফ্যাকশন রেড আর্মি’। ইসরায়েলিদের ছেড়ে দিতে শর্ত ছিল ইসরায়েলের কারাগারে আটক থাকা ২৩৪ ফিলিস্তিনি এবং জার্মান কারাগারে আটক থাকা দুই নব্যনাৎসি নেতার মুক্তি। বলা বাহুল্য এতে ইসরায়েল এবং জার্মান সরকার কেউই রাজি হয়নি।
৫ সেপ্টেম্বর ভোর সারে চারটায় শুরু হওয়া এই নাটকের পদে পদে অনেক জল ঘোলা হয়েছে। রাজনীতিবিদদের অনমনীয় নীতি বুঝতে পেরে জার্মান পুলিশ পরিকল্পনা করে অ্যামবুশের। জিম্মিকারীদের চাহিদা মত হেলিকপ্টার জোগান দেয়া হয়। পরিকল্পনা হয় হেলিকপ্টারে উঠার সময় স্নাইপার দিয়ে আক্রমণ করার।
স্টিভেন স্পিলবার্গের ‘মিউনিখ’ চলচ্চিত্রটা দেখেছেন? এটা কিন্তু এই ঘটনার উপর ভিত্তি করেই বানানো। গুগলে যদি আপনি মিউনিখ অলিম্পিক নিয়ে খোঁজ লাগান তাহলে খেলার কোন বিষয়ের আগে আপনার ‘সাজেশন’ আসবে ‘মিউনিখ ম্যাসাকার’ শব্দটি এবং এটিই পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ বলে দিচ্ছে। জার্মান পরিকল্পনা সম্পূর্ণভাবে ব্যর্থ হয় সে ভোরে। হেলিকপ্টারে উঠার পথে আক্রমণের শিকার হয়ে জিম্মিকারীরা ওখানেই চারজনকে মেরে ফেলে। হেলিকপ্টারে উঠার পর যখন পালানো অসম্ভব বুঝে যায় তখন গ্রেনেড বিষ্ফোরণে পুরো হেলিকপ্টারই উড়িয়ে দেয়। এগারজন ইসরায়েলি কাউকেই তাই জীবিত উদ্ধার করা যায় নি!
খেলার ফিচারে লাশ, গ্রেনেড, বারুদের কথা লিখতে আসলে কারোরই ভাল লাগে না। তবুও লিখতে হয়, বিশ্বনেতাদের ক্ষমতার লোভ আর কপটতার ফাঁদে পড়ে নিরীহ অ্যাথলেটদের খেলতে এসে জীবন দিয়ে দেয়ার কাহিনির প্লট সাজাতে হয়। সেই প্লটে আবার ক্ষমতালোভী সেসব নেতাদের ঘটনা পরবর্তী বড় বড় আশার বুলিও অন্তর্ভুক্ত করতে হয়! এমন বুলির উপর ভর করেই মিউনিখ অলিম্পিক এরপরও চলেছিল। শেষও হয়েছিল অনেক সোনা-রূপা-ব্রোঞ্জের হাসি-কান্না দিয়ে। তবুও মিউনিখ অলিম্পিক মনে থাকবে ঐ এগারজনের জন্যেই। গুগল সার্চে মিউনিখ লিখার সাথে সাথে আসা ‘ম্যাসাকার’ শব্দটি অলিম্পিকের ‘ভ্রাতৃত্ববোধ’ স্লোগানের উপর আবহমান কাল ধরেই তাই চপেটাঘাত করতেই থাকবে। মাঝেমধ্যে খেলার আসলেই সাধ্য নেই ভ্রাতৃত্বের বোধ জাগ্রত করার। দিনশেষে ‘খেলা’ আসলে নিছক ‘খেলা’ই!
পরের পর্বঃ