• " />

     

    "দ্য কুইন অব ক্রিকেট"

    "দ্য কুইন অব ক্রিকেট"    

    রামসি ক্রিকেট ক্লাবের ছোট্ট মাঠে গুটি গুটি পায়ে বাবার সাথে চলে আসত মেয়েটি। মুগ্ধ চোখে দেখতো ক্রিকেট নামের আজব খেলা। তাঁর সমবয়সীরা যখন পুতুল খেলায় ব্যস্ত, গান শোনায় মত্ত। কেউ বা বইয়ে বুঁদ হয়ে থাকতো, তখন তাঁর সমস্ত আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু কেবল ওই ক্রিকেট। বাবা কেন বারবার বোলার পরিবর্তন করে, কেন ফিল্ডার এদিক-সেদিক করে, মাথায় ঢুকত না তাঁর। বাবার অধিনায়কত্ব দেখতে দেখতে মেয়েটি অধিনায়কত্বের প্রতি অদ্ভুত এক মোহ অনুভব করতে শুরু করে। বাবাকে দেখে, ছেলে বন্ধুদের খেলতে দেখে তাঁরও বড় স্বাদ জাগে, সে-ও খেলবে। কিন্তু অপেক্ষায় কাটে প্রহর, তাঁর আর খেলা হয় না।
     
    মাত্র দশ বছরের জীবনে সবচেয়ে সুখের মুহূর্ত এলো এক শনিবারের বিকেলবেলা, যেদিন সুযোগ মিললো একাদশে। তাঁর খুশী তখন দেখে কে? প্রথম প্রথম ব্যাট করতে হতো একদম শেষদিকে। তবুও একটুও মন খারাপ হতো না তাঁর, বরং তাতেও কত আনন্দ!
     
    ন্যাচারাল স্ট্রোকমেকার হওয়ায় ব্যাটিংয়ে প্রমোশন ঘটেছিল দ্রুতই। বলকে এমনভাবে হাওয়ায় ভাসিয়ে দিতেন, মনে হতে পারে বল তো নয় যেন কোন পালক উড়িয়ে দিয়েছেন বাতাসে। তাঁর বাউন্ডারী ঠেকাতে না পেরে, ছেলে বন্ধুরা তাঁর দিকে বিমার ছুঁড়ে দিতেন। মেয়ে হয়ে ক্রিকেট খেলছেন বলে অনেকে মজা করতেন, উপহাস করতেন। কিন্তু সেসব তাকে বিন্দুমাত্র দমাতে পারেনি। খেলাটার প্রতি ভালোবাসা, ক্রিকেট পাগল বাবা ক্লাইভ এডওয়ার্ডসের উৎসাহ, তাকে অফুরন্ত উদ্যম যুগিয়েছে বরাবরই। তাই ছোট্ট মেয়েটি বড় হওয়ার সাথে সাথে ছড়িয়ে দিয়েছে তাঁর ক্রিকেট-জ্যোতি। রামসি ক্রিকেট ক্লাবের মাঠ ছাড়িয়ে যা পৌছে গেছে বিশ্ব ক্রিকেটের আনাচে কানাচে।
     


    কিন্তু শার্লট এডওয়ার্ডসই কি ভেবেছিলেন এমন এক উচ্চতায় পৌছে যাবেন, যেখানে তাঁর আগে কেউ কখনো পৌছতে পারেননি? মন অসম্ভব কল্পনা তিনিই বা কীভাবে করবেন বলুন? তিনি যে সময় ক্রিকেট খেলতে শুরু করেছিলেন, সেসময় যে মেয়েরা স্কার্ট পরে ক্রিকেট খেলতো! পেশাদারী-প্রতিদ্বন্দ্বিতার সাথে ছিল না দূরতম সম্পর্ক। অনেকে বলতেন খেলাধূলা মেয়েদের জন্য নয়। সেই সময়ে এমসিসিতে ছিল না কোন নারী সদস্যের প্রবেশাধিকার। লর্ডসের লং রুম ছিল নারী বিবর্জিতা। ছেলেদের মা-বাবারা তাদের ছেলেদের ভৎসনা করতো, কেন তাঁরা একটা মেয়ের সাথে ক্রিকেট খেলে!
     
    কৈশোরে তিনি যখন ব্যাট হাতে নিয়মিত রানের বন্যা বয়ে দিচ্ছিলেন, তখনও তো জানতেন না ইংল্যান্ডের একটি নারী ক্রিকেট দলও আছে! তিনি ভাবতেন বুঝি ছেলেদের সাথেই তাঁর ক্রিকেট খেলতে হবে। যদিও পরে বুঝেছিলেন তাঁর সে দুর্ভাবনা অবান্তর। তাঁর অবিশ্বাস্য প্রতিভা বলে মাত্র ‘বারো’ বছর বয়সেই সুযোগ পেয়ে গিয়েছিলেন ইংল্যান্ড নারী অনূর্ধ্ব-১৯ দলে। সেখান থেকে মাত্র ষোল বছর বয়সে ঢুকে যান জাতীয় দলেও। ধারাবাহিকতার ফলস্বরূপ দলে থিতু হতে একদমই সময় লাগেনি তাঁর।
     
    সেই যে শুরু, ১৯৯৬-২০১৬ পর্যন্ত কুড়ি বছরের এই দীর্ঘ যাত্রায় তাঁর অবদান-ধন্যে শোভিত হয়েছে ক্রিকেট। কেবল ইংলিশ ক্রিকেট নয়, পুরো বিশ্বের নারী ক্রিকেটের গতিপথই বদলে গেছে তাঁর হাত ধরে। এখন তাকে দেখেই মেয়েরা ক্রিকেট খেলে, ক্রিকেট শেখে। ‘নারী ক্রিকেট’ বলতে তাকেই বোঝানো হয়। তিনি হয়ে উঠেছেন একজন যুগ-বদলে দেয়া ক্রিকেটার।
     
     যখন ক্রিকেটে ক্যারিয়ার গড়ছিলেন তখন ইংল্যান্ডের অনেক মানুষই যে জানে না, ইংল্যান্ডের একটা মহিলা ক্রিকেট দলও আছে! মেয়েদের ক্রিকেটের প্রতি কোন আগ্রহ ছিল না কারও। সাধারণের কথা না হয় বাদ দিন, ইসিবি পর্যন্ত নারী ক্রিকেটারদের সাথে কোন চুক্তিতে যায়নি, এই বছর কয়েক আগেও। আর্থিক ব্যাপারগুলোয় মেয়েদের নির্ভর করতে হতো কোনো চ্যারিটি ফাউন্ডেশনের উপর। শার্লট নিজেই এক ব্যাট কোম্পানীতে চাকরি করেছিলেন, এবং সেই ব্যাট কোম্পানীই ছিল তাঁর স্পন্সর। দেশের হয়ে খেলতে গিয়ে কতবার তাকে ছাড়তে হয়েছে চাকরি, পার করতে হয়েছে অর্থনৈতিক অস্বচ্ছলতা! আইসিসির টুর্নামেন্টগুলোতে নারী-পুরুষের আর্থিক বৈষম্য ছিল। ভ্রমণেও ছিল বিজনেস-ইকোনমি, শ্রেণী বিভাজন!


    এমন এক বৈষম্য ও অবহেলাপূর্ণ ব্যবস্থা থেকে, নারী ক্রিকেট যে আজ পৌছে গেছে সবার আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে, সে তো একজন শার্লট এডওয়ার্ডস ছিলেন বলেই।


    হ্যাঁ, র‍্যাচেল হেইহো-ফ্লিন্ট, বেলিন্ডা ক্লার্ক, ক্লেয়ার কনোররা ছিলেন, শার্লটেরও আগে। নারী-ক্রিকেটে তাদের অবদানও খাটো করে দেখার অবকাশ নেই। তবে শার্লট যে উচ্চতায় পৌঁছেছেন, যেভাবে পৌঁছেছেন তেমন করে আর কেউ পারেননি যে!
    তাই তাকে ‘সর্বকালের সেরা নারী ক্রিকেটার’ বললেও, আপত্তি তোলার সুযোগ খুব একটা নেই।
     
    এক বছরে দু-দুটি বিশ্বকাপ জিতেছেন। যা কিনা নারী-পুরুষ মিলিয়ে আর কেউ করতে পারেননি। জিতেছেন ব্যাক টু ব্যাক এ্যাশেজ সিরিজ। নারী-এ্যাশেজে সবচেয়ে বেশী(১৫৩৪) রান আছে তাঁর। মেয়েদের একদিনের ক্রিকেটেও সবচেয়ে বেশী(৫৯৯২) রান তাঁর, সবচেয়ে বেশী ফিফটিও(৪৬), সেঞ্চুরির রেকর্ডও কদিন আগে হাতছাড়া করেছেন মেগ লেনিংয়ের কাছে। শুনতে অবিশ্বাস্য মনে হলেও সত্যি যে, টি-টুয়েন্টির ইতিহাসে সবচেয়ে বেশী ২৬০৫ রানও তাঁর! যেখানে পুরুষ ক্রিকেটে কেউ এখনো আড়াই হাজারী ক্লাবেই পৌছতে পারেননি।
     শুধু ক্রিকেটীয় সামর্থ্যেই তো তিনি নিজেকে নিয়ে গেছেন অনেক উঁচুতে।

     
    ২০১৪তে এসে প্রথমবারের মতো তিনি ইসিবির সাথে চুক্তিবদ্ধ হন। কোন চ্যারিটির বদলে বোর্ড থেকে অর্থ প্রাপ্তি ঘটে তাঁর। তিনি প্রথমবারের মতো পরিচিত হন একজন পেশাদার ক্রিকেটার হিসেবে।


    যদিও একদিন পেশাদার ক্রিকেটার হবেন বলে তিনি ক্রিকেটে আসেননি। অর্থ-যশ-খ্যাতির আশায়  ক্রিকেট খেলেননি। উইজডেনের সেরা ক্রিকেটার হওয়ার জন্যেও খেলেননি, খেলেননি এমবিই(মেম্বার অফ দি বর্ডার অফ দি ব্রিটিশ এম্পায়ার) বা সিবিই(কমান্ডার অফ দি বর্ডার অফ দি ব্রিটিশ এম্পায়ার) প্রাপ্তির জন্য। আইসিসির সেরা নারী ক্রিকেটার হওয়াটাও তাঁর লক্ষ্য ছিল না।
     
    তিনি ক্রিকেটটা খেলেছিলেন ভালোবাসার টানে। বাবার অধিনায়কত্ব দেখে নেতৃত্বের প্রেমে পড়ে গিয়েছিলেন, সেটাও তাঁর ক্রিকেটাসক্তির বিশাল একটা কারণ। সেজন্যেই হয়তো রেকর্ড ২২০টি আন্তর্জাতিক ম্যাচে ইংল্যান্ডকে নেতৃত্ব দিয়েছেন তিনি। তাঁর অধীনে ইংলিশ মেয়েদের গোটা একটা প্রজন্মকেই জিততে শিখিয়েছেন, লড়তে শিখিয়েছেন। শিখিয়েছেন কিভাবে অসম্ভব সব বাধা উতরে যেতে হয়। শিখিয়েছেন, কিভাবে হৃদয় দিয়ে ক্রিকেট খেলতে হয়!
     
    তাই অনেকেই বলেন, এই ইংলিশ দলটা আসলে তাঁরই দল। এই নারী ক্রিকেটাররা এতটাই অসাধারণ যে, তাদের পৃষ্ঠপোষকতা না দিয়ে ইসিবির আর উপায় ছিল না। শার্লটের এই দুর্দান্ত দলটা ইংল্যান্ড ক্রিকেটের অভিভাবক সংস্থাকে, পেশাদারীর পর্যায়ে উন্নীত হতে বলতে গেলে একপ্রকার বাধ্য-ই করেছেন। মেয়েদের ক্রিকেটকে যে উপেক্ষা করার উপায় ছিল না কোনমতেই!
     
    গত মে’তে অবসরের ঘোষণা দেয়ার সময় তাঁকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, “কোন মুহূর্তটি তাঁর জন্য সবচেয়ে গর্বের ছিল?” উত্তর দেয়ার সময় স্বাভাবিকভাবেই তিনি আপ্লুত হয়ে পড়েছিলেন। চোখভরা জল নিয়ে বলেছিলেন, “ছোট ছোট মেয়েদের ‘রোল মডেল’ হতে পারাটাই আমার জীবনের সবচেয়ে বড় পাওয়া। আমি বড় হওয়ার সময় নারী ক্রিকেটের কোন পথিকৃৎ পাইনি। তাই আমার কাছে এটা সবসময়ই বিশেষ কিছু যে, মেয়েরা আমাকে দেখে ক্রিকেট খেলছে।”


    তিনি এখন স্কুলগুলোতে আমন্ত্রিত হন, একজন বিশ্বকাপজয়ী অধিনায়ক হিসেবে। একজন এ্যাশেজ জয়ী দলপতি হিসেবে। একজন পেশাদার ক্রিকেটার হিসেবে। একজন কিংবদন্তী হিসেবে। তিনি মেয়েদের স্কুলগুলোতে ছুটে যান, তাদের ক্রিকেট খেলতে অনুপ্রাণিত করেন। তাদের বলেন, “তোমরা চাইলে ক্রিকেটেই তোমাদের ক্যারিয়ার গড়তে পারে।”
     
    কুড়ি বছরে টেস্ট খেলেছেন মাত্র তেইশটি। তাই পেশাদারিত্বের বিলম্ব নিয়ে তাঁর আক্ষেপ ছিল, কিন্তু অতৃপ্তি ছিল না মোটেই। এত বড় মহাতারকা হওয়া সত্ত্বেও তাকে স্পর্শ করেনি তারকাসুলভ কোন দাম্ভিকতা। কথা বলেন যেন খুব কাছের একজন। যেন খুব সাধারণ কেউ। আসলেই কি তিনি সাধারণ ছিলেন? কুড়িটি বছর ধরে যে ক্রিকেট খেলেছেন হাঁটুর ইঞ্জুরি নিয়ে! ব্যাপারটাকে সাধারণ বলা যায়? শেষ বেলায়ও বলছিলেন, “আমি এখনও খুব করে চাই ক্রিকেটটা খেলতে, কিন্তু আসলে তা আর সম্ভব নয়। ব্যাপারটা আমার জন্য অনেক বড় আঘাত। কিন্তু কিছু করার নেই। এতটা যে খেলতে পেরেছি, তাতে আমি অনেক খুশী।”
     
    স্বনামধন্য ক্রিকেট লিখিয়ে জেরড কিম্বার তাই যথার্থই বলেছেন, “মিতালী রাজ অনেক ভালো ব্যাটসম্যান হতে পারেন, সুজি বেটস অনেক ভালো অধিনায়ক হতে পারেন, এলিস পেরি আরো বড় তারকা হতে পারেন, সারাহ টেইলর অনেক ভালো খেলোয়াড় হতে পারেন। কিন্তু ইনি হচ্ছেন শার্লট এডওয়ার্ডস, তিনি যখন ক্রিকেট খেলতে শুরু করেছিলেন, তখন নারী ক্রিকেটের অবস্থা ছিল একদম শোচনীয়। শুধুমাত্র ইংলিশ ক্রিকেটের নয়, বিশ্বের নারী ক্রিকেটেরই শোচনীয় অবস্থা বদলে দিয়েছেন তিনি। তাঁর মাধ্যমে নারী ক্রিকেট প্রবেশ করেছে, আলোকাজ্জ্বল এক যুগে।


    “অনেক খেলোয়াড়ই আছেন, যারা তাদের দেশের হয়ে খেলেন। তাদের মধ্যে খুব কম সংখ্যকই আছেন, যারা বিশ্বজয় করেন, বিশ্বকাপ জিতেন। অধিনায়ক হয়ে তা করতে পারেন আরো কম সংখ্যাক খেলোয়াড়। কিন্তু ইতিহাসে হাতে গোনা দু-চারজনই থাকেন, যারা খেলাটাকে বদলে দিতে পারেন। শার্লট এডওয়ার্ডস ছিলেন সেই হাতে গোনা কয়েকজনের একজন।”
     শার্লট মেরী এডওয়ার্ডস আসলে হাতেগোনা কয়েকজন নন, তিনি একজনই।