• ভারত-ইংল্যান্ড
  • " />

     

    ১৯৯ এবং কিছু আক্ষেপের গল্প

    ১৯৯ এবং কিছু আক্ষেপের গল্প    

    আদিল রশিদের অত বাইরের বল ছেড়ে দিলেই পারতেন। চাইলে কাভার কিংবা ডিপ কাভারের উপর দিয়ে উড়িয়ে মারতে পারতেন। তা চাইলে অনেক কিছুই করা যায়। কিন্তু যেটা করেছেন, সেটা ঘোর দুঃস্বপ্নেও করার কথা ভাবেননি লোকেশ রাহুল।

    আদিলের ঝুলিয়ে দেয়া ওয়াইড-অফ লেংথের বলটিকে বাটলারের হাতে ঢুকিয়ে দিয়েছেন রাহুল! এবং সাথে নিজেও ঢুকেছেন এক দুর্ভাগাদের ক্লাবে, নবীনতম সদস্য হয়ে!

    শুরুটা করেছিলেন পাকিস্তানে মুদাসসর নজর, ভারতের বিপক্ষে। টেস্ট ক্রিকেট প্রথমবারের মতো দেখেছিল, ১৯৯ রান করার পরও, মাত্র একটি রানের জন্য মানুষের কতটা অতৃপ্তি থেকে যায়! মুদাসসর তো তাও বছর দেড়েক আগেই দ্বিশতকের স্বাদ পেয়েছিলেন।

    কিন্তু আজহারউদ্দীনের যে আর সে সৌভাগ্য হয়নি। ক্যারিয়ারের ঊষালগ্নে সেই যে ১৯৯ রানে কাঁটা পড়েছিলেন, সেই দুর্ভাগ্য তাঁর আর পিছু ছাড়েনি। এরপর আরো আঠারোটি শতক পেলেও দ্বিশতক আর পাওয়া হয়নি। ১৯৯০তে একবার গিয়েছিলেন ১৯২ পর্যন্ত। শততম টেস্ট খেলতে না পারার মতো হয়তো এটিও তাঁর সারাজীবনের দুঃখই থেকে গেল। দ্বিশতকহীন সর্বোচ্চ ‘বাইশ’ সেঞ্চুরীর মালিকও তিনি। কে জানে রবি রত্নায়েকেকে কোনদিন ক্ষমা করতে পেরেছেন কি না! তাঁর বলেই তো লেগ বিফোরের ফাঁদে পড়েছিলেন আজহার।

    আজহার তাঁর দুঃখ ভাগের জন্য চাইলে ম্যাথু ইলিয়টের শরণাপন্ন হতে পারেন। বেরসিক ড্যারেন গফের বলে বোল্ড হয়ে, এই অস্ট্রেলিয়ান ওপেনারও যে ১৯৯তে কাঁটা পড়ে আর ডাবলের মুখ দেখতে পারেননি। ক্যারিয়ারের মাত্র তিনটি সেঞ্চুরী, তাতে আবার একটি ১৯৯! দুঃখটা কার বেশী, আজহারের না ইলিয়টের?

    সনাৎ জয়সুরিয়ার অবশ্য দুঃখের ধার ধারার সময় ছিল না। তিনি তখন সুবর্ণকাল পার করছেন। মাঠে গিয়ে যা ইচ্ছে তা-ই করার আশ্চর্য ক্ষমতা তাঁর হাতে! সপ্তাহ খানেক আগেই কলম্বোর আরেক মাঠে, করেছিলেন ৩৪০। সেদিনও সেরকম কিছুরই ইংগিত দিচ্ছিলেন। কুরুভিল্লা তা হতে দিলে তো! উড়তে থাকা জয়াসুরিয়াকে বোল্ড করে দেখিয়েছিলেন প্যাভিলিয়নের পথ।

    অবশ্য জয়াসুরিয়া অন্যদের থেকে একটু কিছুটা ব্যতিক্রম। অন্যরা সবাই প্রথম বা দ্বিতীয় ইনিংসে করেছেন কিন্তু মাতারা হারিকেন করেছিলেন টেস্টের তৃতীয় ইনিংসে। এবং সবচেয়ে কম সময়ে ও কম বলে তো বটেই!

    স্টিভ ওয়াহও কি ভেবেছিলেন, তীরে এসে তরী ডুববে? পেরির নিরীহ দর্শন অফ স্পিন যে, ইস্পাত মানবের ব্যাট মিস করে প্যাডে লাগবে তা কে জানতো! অবশ্য সেই ব্রিজটাউন টেস্ট ব্রায়ান লারার ‘অবিশ্বাস্য ১৫৩’ রানে ইতিহাসে জুড়ে গেছে, টেস্ট ক্রিকেটের অন্যতম সেরা ম্যাচ হিসেবে। সেবার না পারলেও, তারও বছর চারেক আগে সেই ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষেই ক্যারিয়ারে প্রথম ও একমাত্র দ্বিশতকটি পেয়ে গিয়েছিলেন বড় ওয়াহ।

     

         ব্যাটসম্যান

    বিপক্ষ দল

     ভেন্যু

     সাল

    মুদাসসর নজর

    ভারত

    ফয়সালাবাদ

    ১৯৮৪

    মোহাম্মদ আজহার উদ্দীন

    শ্রীলংকা

    কানপুর

    ১৯৮৬

    ম্যাথু ইলিয়ট

    ইংল্যান্ড

    হেডিংলি

    ১৯৯৭

    সনাৎ জয়সুরিয়া

    ভারত

    কলম্বো এসএসসি

    ১৯৯৭

    স্টিভ ওয়াহ

    ওয়েস্ট ইন্ডিজ

    ব্রিজটাউন

    ১৯৯৯

    ইউনিস খান

    ভারত

    লাহোর

    ২০০৬

    ইয়ান বেল

    দক্ষিন আফ্রিকা

    লর্ডস

    ২০০৮

    স্টিভ  স্মিথ

    ওয়েস্ট ইন্ডিজ

    ব্রিজটাউন

    ২০১৫

    লোকেশ রাহুল

    ইংল্যান্ড

    চেন্নাই

    ২০১৬

     

    অনিল কুম্বলের বলটা লং অনের দিকে ঠেলে দিয়েই একটি রানের জন্য দৌড়েছিলেন ইউনিস খান। কিন্তু শহীদ আফ্রিদী কেন যেন সে দৌড়ে সাড়া দিলেন না! ইউনিসের বদলে বল দেখতেই বেশী ব্যস্ত ছিলেন যে, শহীদ আফ্রিদী। পরের টেস্টে আবারও ১৯৪তে গিয়ে আটকে গিয়েছিলেন ইউনিস। দ্বিতীয় দ্বিশতকের দেখা পেতে পেতেও যেন পাচ্ছিলেন না। পরে অবশ্য আরো চারটি ডাবল ও একটি ট্রিপল করেছিলেন তিনি।

    প্রায় পাঁচ ঘন্টার মনসংযোগ বুঝি নড়েবড়ে হয়ে গিয়েছিল একটুক্ষণের জন্য। পল হ্যারিসের বলটিকে আলতো ঠোকা দিয়ে চেয়েছিলেন একটি রান নিতে, কিন্তু সেখানে কপাল মন্দ! কট এন্ড বল হয়ে আউট হয়ে গেলেন, ইয়ান বেল। সেবার না পারলেও, পাঁচ বছর পর লন্ডনের আরেক মাঠ ওভালে ঠিকই তুলে নিয়েছিলেন প্রথম ও একমাত্র দ্বিশতকটি। তিনিই প্রথম ব্যাটসম্যান যিনি ১৯৯তে কাঁটা পড়েও, ঠিক ডাবল পেয়েছিলেন।

       

                                                                   স্মিথের ১৯৯ রানের হতাশা 

    ইয়ান বেল যদি প্রথম হন, তাহলে স্টিভ স্মিথ দ্বিতীয়। পূর্বসূরি ওয়াহর মতো প্রতিপক্ষ সেই ওয়েস্ট ইন্ডিজ, সেই লেগ বিফোর। শুধু পেরির বদলে টেইলর। আর স্টিভ ওয়াহর বদলে স্টিভ স্মিথ। বেলের মতো ১৯৯ এর দুঃখ ঘুচিয়ে ডাবল ঠিকই পেয়ে গেছেন স্মিথ। আজহার, ইলিয়টের ভাগ্য বরণ করতে আর হয়নি।

    তালিকায় আরো দুটো নাম যোগ হতে পারে। কিন্তু হয়নি। এন্ডি ফ্লাওয়ার আর কুমার সাঙ্গাকারা। এই দুজন আবার ওই নয়জনের মতো নন। তাঁরা ১৯৯তে আটকেছেন ঠিকই, তবে আউট হননি। তাদের অবস্থা অনেকটা সেই বাংলা গানের মতো, ‘চেয়ে চেয়ে দেখলাম, তুমি চলে গেলে/আমার বলার কিছু ছিল না।’

     

    ব্যাটসম্যান

    বিপক্ষ দল

    ভেন্যু

    সাল

    এন্ডি ফ্লাওয়ার

    দক্ষিন আফ্রিকা

    হারারে

    ২০০১

    কুমার সাঙ্গাকারা

    পাকিস্তান

    গলে

    ২০১২

     

    শেষ ব্যাটসম্যান নুয়ান প্রদীপ চেষ্টা করেছিলেন প্রাণপণ। কিন্তু ব্যাট-প্যাড ফাঁকি দিয়ে, মোঃ হাফিজের বলটা কিভাবে যে স্ট্যাম্পে আঘাত হানলো ঠিক বুঝতে পারলেন না। অপর প্রান্তে উদগ্রীব হয়ে তাকিয়েছিলেন সাঙ্গা। বেল পড়তেই, হতাশায় মুহূর্তেই বিরক্তি প্রকাশ করে ফেলেছিলেন। মিনিট কয়েকের সঙ্গ যে তাঁর বড্ড দরকার ছিল!

     

    এন্ডিরও হয়তো তা-ই মনে হয়েছিল। বছর খানেক আগে ডাবল পেয়েছিলেন। এগিয়ে যাচ্ছিলেন দ্বিতীয় দ্বিশতকের দিকে। ডগলাস হোন্ডোকে নিয়ে লড়াইটা ছিল স্বদেশের সম্মান রক্ষারও। ফলো-অনে পড়া জিম্বাবুয়েকে যে তিনি একা হাতে টেনে নিয়ে যাচ্ছিলেন। দশম উইকেটে ৪৭ রানের জুটিও গড়েছিলেন। কিন্তু আন্দ্রে নেলের বল হোন্ডোর পায়ে আঘাত হানলে, শেষ হয়ে যায় সব চেষ্টা। তখন পর্যন্ত ইতিহাসের প্রথম ব্যাটসম্যান হয়ে ১৯৯তে অপরাজিত ছিলেন, এন্ডি।

    স্যার ডন ব্র্যাডম্যান আটকে গিয়েছিলেন ২৯৯তে। সতীর্থের সঙ্গ-অভাবে দুটি ট্রিপলের মাঝে, এই ট্রিপলটি আটকে যায় বারোটি ‘ডাবল’ এর তালিকায়। মার্টিন ক্রো আবার ইতিহাসে এখন পর্যন্ত একমাত্র ব্যক্তি, যিনি ২৯৯তে আউট হয়ে গিয়েছিলেন। তাও আবার অর্জুনা রানাতুঙ্গার বলে!

    এইসব ব্যাটসম্যানেরা এর আগে-পরে শত-হাজার রান করেছেন। কিন্তু ওই একটি রানের আক্ষেপ তাদের কখনো মেটার নয়। লোকেশ রাহুলেরও হয়তো মিটবে না। তবে তাঁর সামনে আছে অনেকটা সময়। স্মিথ-বেল তো দেখিয়েছেনই, কিভাবে পুনরায় দ্বিশতকের খাতায় নিজের নামটি তুলতে হয়।

    তিনি হয়তো পূর্বসূরী আজহারের মতো দুর্ভাগ্যের বরপুত্র হবেন না। মাত্র একটি রানের জন্য মাথায় হাত দেয়ার দুর্ভাগ্যটা চিরস্থায়ী করবেন না!