সৌম্য-কায়েসদের উত্তরসূরি এবার কারা?
ছবির মতো সুন্দর, সাজানো-গোছানো, সবুজ একটি দেশ নিউজিল্যান্ড। ভ্রমণ পিয়াসীদের দেশটি আকর্ষণ করে চুম্বকের মতো, আমন্ত্রণ জানায় আন্তরিক প্রগাঢ় আহবানের মতো। তবে যাদের ভ্রমণের উদ্দেশ্য ক্রিকেট, তাদের জন্য নিউজিল্যান্ড অতটা বন্ধুবৎসল নয়। অতিথি আপ্যায়নের জন্য বাতাসে আছে সাপের মতো ফনা তোলা সুইং আর মাঠে চোখ ধাঁধানো সবুজ গালিচা।
অভিজ্ঞরাই যেখানে প্রায় বিধ্বস্ত-দশা ধারণ করেন, সেখানে নবীনদের জন্য তো তা ‘ছেঁড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি’ অবস্থা-ই হবে। তাহলে শুভাশীষ, মিরাজ, তানবির, মোসাদ্দেকদের ঘাড় দিয়ে কি ভয়ের চোরাস্রোত বয়ে যাচ্ছে?
নবীনদের জন্য কিউই-কন্ডিশন আসলেই কি এতটা কঠিন-দুরূহ, অজেয় ব্যাপার?
সৌম্য সরকার হয়তো ‘ধ্যাৎ’ বলে হেসেই উড়িয়ে দেবেন। গত বছর ওয়ানডে বিশ্বকাপে যখন মাঠে নেমেছিলেন, তামিম-কায়েস তখন বোল্ট-সাউদিতে রীতিমতো কাঁপছেন। কায়েসকে বোল্ড করে বোল্ট যখন বিভীষিকা থেকে মুক্তি দিলেন, স্কোরবোর্ডে তখন ৫.৪ ওভারে রান উঠেছে মাত্র ৪! সেই ভয়ংকর দুরবস্থায় সৌম্য দেখালেন আগ্রাসনের নান্দনিক মাত্রা। আঁটোসাঁটো আক্রমণ ভাঙলেন দুঃসাহসিক প্রতি-আক্রমণে। স্রোতের বিপরীতে খেলে নিজের প্রথম ফিফটি তুলে নিয়েছিলেন। সৌম্যের কাছে অন্তত নিউজিল্যান্ড-কন্ডিশন খুব একটা দুর্বোধ্য মনে হয় না, নিশ্চয়!
ইমরুল কায়েসেরও সেটি মনে হওয়ার কথা নয়। ২০১০ সালে সালে সতীর্থদের আসা-যাওয়ার মিছিলে, অন্যপাশে ব্যতিক্রম হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন, তুলে নিয়েছিলেন ক্যারিয়ারের প্রথম ওডিআই সেঞ্চুরী। সেই সেঞ্চুরীতে ভর দিয়েই দল গড়ে তুলতে পেরেছিল দারুণ এক লড়াই। সেই সেঞ্চুরীর সময় তাঁর ঝুলিতে ছিল মাত্র নয়টি আন্তর্জাতিক একদিনের ম্যাচ খেলার অভিজ্ঞতা!
কায়েস তা-ও না-হয় নয় ম্যাচ খেলেছিলেন। কিন্তু তামিম-জুনাইদ?
জেমি সিডন্স যখন ঊনিশ বছরের তামিম ইকবাল আর কুড়ি বছরের জুনাইদ সিদ্দীকিকে টেস্ট ওপেনার হিসেবে অভিষেক করিয়ে দিয়েছিলেন কিউই কন্ডিশনে, তখন অনেকেরই চোখ কপালে উঠেছিল বৈকি! পোড় খাওয়া ব্যাটসম্যানদেরই যেখানে হাঁটু-কাঁপা অবস্থা হয়, সেই নিউজিল্যান্ডে কি না বাংলাদেশ কোচ নামিয়ে দিলেন, সদ্য কৈশোর পেরোনো দুই তরুণকে!
প্রথম টেস্টের দুই ইনিংসেই পঞ্চাশ পেরিয়ে তামিম বুঝিয়ে দিয়েছিলেন, কোচ খুব একটা ভুল করেননি। জুনাইদও দ্বিতীয় ইনিংসে করেছিলেন ৭৪। অথচ জুনাইদ নিউজিল্যান্ডে গিয়েছিলেন মাত্র একটি আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টি ম্যাচ খেলার অভিজ্ঞতা সম্বল করে! এই দুজনের উদ্বোধনী জুটিতেই দেড়শ পেরিয়ে গিয়েছিল বাংলাদেশ। সেই কপালের ভাঁজ কমাতে ভেট্টোরির দ্বারস্থ হতে হয়েছিল সাবেক অধিনায়ক স্টিফেন ফ্লেমিংয়ের।
মাহমুদউল্লাহর ব্যাপারটা অবশ্য একটু আলাদা। ক্যারিয়ারের টেস্ট ও ওয়ানডেতে সর্বোচ্চ ইনিংসই যে খেলেছেন নিউজিল্যান্ডেরই মাঠে, নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে! আরো বিশেষ করে বললে, হ্যামিল্টনের স্যাডন পার্কে। নিউজিল্যান্ডের কঠিন কন্ডিশনের কথা কেউ তুললে, তাকে তো জবাব দিতেই পারেন মাহমুদউল্লাহ?
এতক্ষণ কেবল ব্যাটসম্যানদের কথা-ই হলো। তাহলে বোলাররা কি দোষ করলেন? নিউজিল্যান্ড ব্যাটসম্যানদের জন্য বিভীষিকা হলেও, বোলারদের জন্য যে পুলক-সঞ্চারী। সেই জন্যেই কি না, রুবেল হোসেনের টেস্ট ক্যারিয়ারের একমাত্র পাঁচ উইকেট প্রাপ্তি, সেখানেই ঘটেছিল। তখন মাত্রই আন্তর্জাতিক ক্রিকেট শুরু করা শফিউল, সেখানে গিয়ে তিন ওয়ানডেতে পেয়ে গিয়েছিলেন সাত উইকেট। উপমহাদেশের প্রতিকূল-উইকেটে ছড়ি ঘোরানো মুস্তাফিজের আকন্ঠ বিস্তৃত হাসিটা আরো বিস্তৃত হওয়ারই কথা!
সৌম্য, তামিম, মাহমুদুল্লাহ, কায়েসরা দেখিয়েছেন নিউজিল্যান্ড-কন্ডিশন কীভাবে জয় করতে হয়। নবীনরা তাই দলের প্রবীণ সদস্যদের কাছ থেকে কিউই-কন্ডিশন জয়ের টোটকাটা শিখে নিতে পারেন। তামিম-সৌম্য-কায়েসরা তো আগেই প্রমাণ করেছিলেন, দুর্বোধ্য বলতে কিছু নেই। এবার কে প্রমাণ করবেন? মোসাদ্দেক, মিরাজ? নাকি আনকোরা তানবির হায়দার?
অতিথি-সৎকারে আপ্যায়নের দুর্বোধ্য ব্যবস্থা রাখা নিউজিল্যান্ডকে, তাতেই সংহার-উৎসবে যে মুস্তাফিজ-শুভাশীষ মেতে উঠবেন না, তা-ই বা নিশ্চিত করে বলছে কে?
ওদিকে অভিজ্ঞরা তো আছেনই। মুশফিক, তামিম কিংবা সাকিব-মাশরাফি... প্রয়োজনে যে কেউ দাঁড়িয়ে যেতে পারেন ত্রাতা হয়ে। সেটা হলে নিউজিল্যান্ড থেকে হয়তো সুখস্মৃতি নিয়েও ফিরতে পারে বাংলাদেশ।