• কোপা আমেরিকা
  • " />

     

    কোপা আমেরিকার শুরু যেখান থেকে

    কোপা আমেরিকার শুরু যেখান থেকে    

    ১৮৯৪ সালে চার্লস মিলার নামের একজন ব্রিটিশ ব্রাজিলে এসেছিলেন দুইটি ফুটবল নিয়ে। দক্ষিণ আমেরিকার এই দেশে কীভাবে এই বিজাতীয় ছড়িয়ে পড়ল দাবানলের মতো? কোপা আমেরিকার ধারণাই বা কীভাবে এলো? ইতিহাসের পাতা খুঁড়ে তুলে এনেছেন ইমতিয়াজ আজাদ


    শুরুর গল্প 

    দক্ষিণ আমেরিকাতে ফুটবলের যাত্রা শুরু হয়েছিলো উনবিংশ শতকে।

    সে সময়ে দক্ষিণ আমেরিকার দেশ আর্জেন্টিনাতে প্রচুর ইউরোপিয়ান থাকত কাজের সূত্রে। এদের মধ্যে একটা বড় অংশ ছিল ব্রিটিশ। ব্রিটিশ নাবিকরা অবসর সময়ে ফুটবল খেলত। এই ব্রিটিশরাই ১৮৬৭ সালে বুয়েনস আইরেস নামে প্রথম ফুটবল ক্লাব প্রতিষ্ঠা করে আর্জেন্টিনাতে। এই ক্লাব প্রতিষ্ঠার পরে আর্জেন্টিনাতে ফুটবল ক্রমশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। ১৮৯৩ সালে আর্জেন্টাইন ফুটবল অ্যাসোসিয়েশন গঠিত হওয়ার পরে শুরু হয় প্রথম আর্জেন্টাইন লিগ চ্যাম্পিয়নশিপ।

    ১৮৯১ সালে ব্রিটিশ রেলওয়ে’র ইঞ্জিনিয়াররা উরুগুয়েতে প্রতিষ্ঠা করেন সেন্ট্রাল উরুগুয়ে রেলওয়ে ক্রিকেট ক্লাব। নামে ক্রিকেট ক্লাব হলেও ক্রিকেট এবং ফুটবল দুটো খেলাই খেলতো তারা। উরুগুয়েতে ফুটবলের শুরু ছিল সেটাই।

     

    চার্লস মিলার :দক্ষিণ আমেরিকায় ফুটবল এসেছে যাঁর হাত ধরে

     

    ১৮৯৪ সালে চার্লস মিলার নামে একজন ব্রিটিশ ব্রাজিলের সাও পাওলোতে আসেন দুইটি ফুটবল নিয়ে। তিনি যখন তাঁর বন্ধু এবং সহকর্মীদেরদের সাথে ফুটবল খেলতেন তখন তাঁদের চারপাশে ভিড় করে ব্রাজিলিয়ানরা খেলা দেখতো। দেখতে দেখতে তাদের মনে হল, “আরে! এই খেলা তো আমরাও খেলতে পারি।” খেলা শুরুর পরে দেখা গেল ইংরেজদের যেমন বল নিয়ন্ত্রণের জন্য নানারকম কারিকুরি করা লাগে তাদের সেরকম কিছুই করা লাগে না। বল যেন তাদের পায়েরই একটা অংশ। রাতারাতি এই খেলার দিকে ঝুঁকে পড়লো বেশিরভাগ ব্রাজিলিয়ান। ফুটবল ক্রমশ জনপ্রিয় হয়ে উঠলো ব্রাজিলে।

    ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা এবং উরুগুয়ে এই তিন ফুটবল জায়ান্টকে দেখে দক্ষিণ আমেরিকার অন্য দেশগুলোও আস্তে আস্তে ফুটবলে আগ্রহী হয়ে উঠল। এরই ফলশ্রুতিতে ১৯১৬ সালে আর্জেন্টিনার স্বাধীনতার ১০০ বছর উপলক্ষে ব্রাজিল, উরুগুয়ে, আর্জেন্টিনা আর চিলি এই চার দেশকে নিয়ে শুরু হয় কোপা আমেরিকা। তখন এই প্রতিযোগিতার নাম ছিল দক্ষিণ আমেরিকান ফুটবল চ্যাম্পিয়নশিপ। কোপা আমেরিকা নাম দেওয়া হয় আরও পরে। প্রথম আসর বসেছিলো আর্জেন্টিনাতে। মজার ব্যাপার হল কোপা আমেরিকা’র মতো বিশ্বকাপও শুরু হয়েছিল দক্ষিণ আমেরিকার দেশে এবং দুইক্ষেত্রেই চ্যাম্পিয়ন দলের নাম উরুগুয়ে, রানার্সআপ দলের নাম আর্জেন্টিনা। এই আসরে ৩ গোল করে টুর্নামেন্টের টপ গোলস্কোরার হন উরুগুয়ের ইসাবেলিনো গ্রাডিন।

    বিশ্বকাপের আগে এক ডজন কোপার ইতিহাস 
    ফুটবলের এই জনপ্রিয়তা দেখে কোপা আমেরিকা শুরুর পরের বছর, ১৯১৭ সালে প্রতিষ্ঠা পেল দক্ষিণ আমেরিকান ফুটবল সংগঠন ‘কনমেবল।’ এটা ছিল উরুগুইয়ান ফুটবল অ্যাসোসিয়েশনের একজন সদস্য হেক্টর রিভাদাভিয়া’র মস্তিষ্কপ্রসূত। সেবছরই কোপা আমেরিকার দ্বিতীয় আসর বসল উরুগুয়েতে। ভেন্যু বদলালেও বদলালো না আর্জেন্টিনার ভাগ্য। সেবারও আর্জেন্টিনাকে হতাশ করে দ্বিতীয়বারের মতো চ্যাম্পিয়ন হয় উরুগুয়ে। ৪ গোল করে টুর্নামেন্টের টপ গোলস্কোরার হন উরুগুয়ের অ্যাঞ্জেল রোমানো।

    কোপার পরের আসর বসার কথা ছিল ১৯১৮ সালে, সাম্বার দেশ ব্রাজিলে। কিন্তু ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার কারণে সেবারের আসর স্থগিত করা হয়। ১৯১৯ সালে বসে কোপার তৃতীয় আসর। অনেকদিক দিয়েই এটা ছিল প্রথম। প্রথমবারের মতো স্বাগতিক হয় ব্রাজিল। দুজন টপ গোলস্কোরারের দেখাও পাওয়া যায় প্রথমবারের মতো এই আসরেই। এই আসরেই প্রথমবারের মতো চ্যাম্পিয়ন নির্ধারণ করার জন্য প্লে-অফ ম্যাচ খেলানো হয় যেটা কোপা আমেরিকার ইতিহাসেই দীর্ঘতম ম্যাচ হিসেবে পরিচিতি পায়। এই ম্যাচে দুইবারে ৩০ মিনিট করে অতিরিক্ত ৬০ মিনিট খেলানো হয়। উরুগুয়েকে পরাজিত করে প্রথমবারের মতো চ্যাম্পিয়ন হয় ব্রাজিল। যৌথভাবে টপ গোলস্কোরার হন ব্রাজিলের নেচো এবং ফ্রাইডেনরাইখ।

    পরের কোপা অনুষ্ঠিত হয় ১৯২০ সালে। চিলিতে বসা এই আসর ছিল ৪ দলের সমন্বয়ে হওয়া কোপা’র শেষ আসর। এবার শিরোপা ব্রাজিলের হাত থেকে ফিরে আসে উরুগুয়ের কাছে। আবারো আর্জেন্টিনাকে রানার্সআপ বানিয়ে চ্যাম্পিয়ন হয় উরুগুয়ে। এর মাধ্যমে প্রথম ৪ আসরে ৩ বারই চ্যাম্পিয়ন হয় তাঁরা। তিন বছর আগের ফর্ম ধরে রেখে এবারো টপ গোলস্কোরারের খেতাব পান অ্যাঞ্জেল রোমানো। সাথে থাকেন তাঁরই সতীর্থ হোসে পেরেজ।  

    ১৯২১ সাল। কনমেবলে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার পরে প্যারাগুয়ে এবারই প্রথম অংশগ্রহণ করে কোপা’তে। প্যারাগুয়েকে নিয়ে দলের সংখ্যা দাঁড়ায় ৫টি। কিন্তু দলের মধ্যে ঝামেলা থাকায় চিলি এ আসরে অংশগ্রহণ করেনি। অবশেষে স্বাগতিক আর্জেন্টিনার ভাগ্য শিকে ছিঁড়লো। প্রথমবারের মতো দক্ষিণ আমেরিকার সেরা হল আর্জেন্টিনা। টুর্নামেন্টের টপ গোলস্কোরারও হন একজন আর্জেন্টাইন, জুলিও লিবোনাত্তি। ব্রাজিল হয় দ্বিতীয় সেরা। 

    কোপা’র ষষ্ঠ আসর অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল চিলিতে। কিন্তু ব্রাজিল নিজেদের স্বাধীনতার ১০০ বছর পূর্তিতে কোপা আয়োজন করার আগ্রহ প্রকাশ করে। তাই ১৯২২ সালে ব্রাজিলের রিও ডি জেনিরো তে কোপা আমেরিকার ষষ্ঠ আসর শুরু হয়। চিলি খেলায় ফিরে আসে এ বছরে। মোট ৫ টি দলের এই কোপা আমেরিকাতে ব্রাজিল, উরুগুয়ে এবং প্যারাগুয়ে গ্রুপ পর্ব শেষ করে সমান পয়েন্ট নিয়ে। তাই তিন দলকে নিয়ে তিনটি প্লে-অফ ম্যাচ খেলানোর পরিকল্পনা করা হয়। শেষ মুহূর্তে উরুগুয়ে নিজেদেরকে প্রত্যাহার করে নিলে একমাত্র প্লে-অফটি হয় ব্রাজিল এবং প্যারাগুয়ের মধ্যে। প্যারাগুয়েকে ৩-০ গোলে পরাজিত করে দ্বিতীয়বারের মতো চ্যাম্পিয়ন হয় ব্রাজিল। আর্জেন্টিনা চতুর্থ হলেও ফ্রাঙ্কিয়া নামে এক আর্জেন্টাইন খেলোয়াড় হন টপ গোলস্কোরার।

    ১৯২৩ সালে কোপা ফিরে আসে উরুগুয়েতে। স্বাগতিক এবং চ্যাম্পিয়ন উভয়ভাবেই। কোপা’র ইতিহাসে দ্বিতীয়বারের মতো চিলি অংশগ্রহণ করেনি। ১৯২৪ সালের সামার অলিম্পিকের বাছাই হিসেবেও এই আসরকে বিবেচনা করা হয়। এই আসরে সবগুলো ম্যাচ জিতে অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন হয় উরুগুয়ে। রানার্সআপ দলের নাম আর্জেন্টিনা। এবারের টপ গোলস্কোরার হন আগুইরে নামে একজন আর্জেন্টাইন এবং পেট্রোন নামে একজন উরুগুইয়ান।

     

    ১৯১৯ সালের চ্যাম্পিয়ন ব্রাজিল দল

     

    কনমেবল ১৯২৪ সালের কোপা আয়োজন করতে বলে প্যারাগুয়েকে। কিন্তু কোপা’র মতো একটি টুর্নামেন্ট আয়োজনের সক্ষমতা না থাকায় প্যারাগুয়ে অসম্মতি জানিয়ে দেয়। কনমেবল সিদ্ধান্ত নেয় যে এবারের আসর আয়োজন করা হবে অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে। শেষ পর্যন্ত ১৯২৪ সালে প্যারিসে অনুষ্ঠিত সামার অলিম্পিকে স্বর্ণজয় করার সুবাদে এই আয়োজনের দায়িত্ব পায় উরুগুয়ে। ব্রাজিল এই আসরে অংশ নেয়নি। আবারো আর্জেন্টিনাকে কাঁদিয়ে শিরোপা জয় করে উরুগুয়ে। উরুগুইয়ান খেলোয়াড় পেট্রোন তাঁর আগের বছরের ফর্ম বজায় রেখে আবারো টুর্নামেন্টের টপ গোলস্কোরার হন।

    কোপার নবম আসর বসে আর্জেন্টিনার বুয়েনস আইরেসে, ১৯২৫ সালে। চিলি এবং উরুগুয়ে অংশগ্রহণ না করায় এই আসর হয়ে পড়ে ‘ট্রায়াঙ্গুলার সিরিজ’। এই কারণে দুই রাউন্ড করে খেলানোর সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। দুই রাউন্ড অর্থাৎ ৪টি ম্যাচ শেষে সবচেয়ে বেশি পয়েন্ট পেয়ে চ্যাম্পিয়ন হয় আর্জেন্টিনা। রানার্সআপ হয় ব্রাজিল। আর প্যারাগুয়ে হয় ৩ দলের মধ্যে তৃতীয়। টপ গোলস্কোরার হন আর্জেন্টিনার সিওয়ান।

    ১৯৩০ সালে প্রথম বিশ্বকাপ শুরু হওয়ার আগেই মাঠে গড়িয়েছিল 'এক ডজন' কোপা আমেরিকার আসর। তবে প্রথম বিশ্বকাপের পর থেকেই একটা রীতিতে বেধে ফেলা হয় কোপা আমেরিকাকে। তখন সাধারণত প্রতি দুই বছর পর পর কোপা আয়োজনের সিদ্ধান্ত নেওয়া। যদিও এই নিয়মের ব্যত্যয়ও হয়েছে বহুবার। চার বছর পর পর কোপা আয়োজনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় আরও অনেক পরে। 

     


    আরো পড়ুনঃ

    কোপা কাহিনী পর্ব ২