• বাংলাদেশ-অস্ট্রেলিয়া
  • " />

     

    বদলে যাওয়া সাকিব, বদলে দেওয়া সাকিব

    বদলে যাওয়া সাকিব, বদলে দেওয়া সাকিব    

    মাস পাঁচেক আগে ওই কথাটা কি সাকিব আল হাসানের কানে পৌছেছিল? গল টেস্টের পর বাংলাদেশ কোচ চন্ডিকা হাথুরুসিংহে বলেছিলেন, সাকিব সেই আর আগের বোলার নেই। তার আগের ২০ ইনিংসে একবারই মাত্র পাঁচ উইকেট পেয়েছিলেন। হাথুরুসিহে হয়তো সেজন্যই বোলার সাকিবের 'এপিটাফ' লিখে ফেলেছিলেন। এরপর কলম্বো টেস্টে চার উইকেট নিয়ে অবদান রাখলেন সাকিব। আর মিরপুরে দুই ইনিংসে দশ উইকেট নিয়ে উঠে গেলেন নতুন উচ্চতায়, যেখানে ওঠার স্বপ্ন দেখাটাও অনেক ক্রিকেটারের জন্য বাড়াবাড়ি। বোলার সাকিবের পুনর্জন্মের জন্য হাথুরুসিংহে একটা ধন্যবাদ পেতেই পারেন!


    পরিসংখ্যান বলছে, এই টেস্টে সাকিব এমন কিছু কীর্তি গড়েছেন যা আর কারও নেই। অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে প্রথম ইনিংসে পাঁচ উইকেট নিয়েই একটা চক্রপূরণ করেছিলেন, সবকটি টেস্ট খেলুড়ে দেশের সঙ্গে হয়ে গিয়েছিল পাঁচ উইকেট। কিন্তু এই টেস্ট তো সাকিবকে শুধু দুই হাতে ভরিয়ে দেওয়ার। দ্বিতীয় ইনিংসে আবার নিলেন পাঁচ উইকেট, দ্বিতীয়বারের মতো ম্যাচে দশ উইকেট নেওয়ার কীর্তি গড়লেন। এক টেস্টে অন্তত ৮০ রান আর দশ উইকেট নেওয়ার কীর্তি দুইবার করেছেন তো শুধু সাকিবই। আর ফিফটি আর পাঁচ উইকেট ধরলেও সাকিবের (৮) চেয়ে কীর্তিটা বেশি করেছেন শুধু ইংলিশ কিংবদন্তি ইয়ান বোথাম (১১)। বাংলাদেশের হয়েও টেস্টে সবচেয়ে বেশি ম্যাচসেরার (ছয় বার) রেকর্ডও তো তাঁর। 

     


    তবে এসব রেকর্ড আর পরিসংখ্যান নিয়ে সাকিবের খুব একটা ভাবান্তর নেই। নিজের সময়ের এক নম্বর অলরাউন্ডারের সিংহাসন অনেক আগে থেকেই তাঁর। তবে হিসেবটা যখন 'সর্বকালের', সেখানেও 'সিংহাসনের লড়াইয়ে' নিজের অবস্থান নিয়ে একেবারেই নিস্পৃহ। শুধু মৃদু হেসে জানালেন, এসব নিয়ে কোনো মাথাব্যথা নেই তাঁর। ব্যাটে-বলে দলের জন্য অবদান রাখতে পারলেই খুশি। 


    তবে শুধু পরিসংখ্যান কি দিয়ে কি আর সাকিবকে বোঝা যায়? প্রথম দিনে ১০ রানে ৩ উইকেট পড়ার পর বাংলাদেশ দল যখন কোণঠাসা, সাকিবের ব্যাটে আবার ফিরে পেল বিশ্বাস। তামিমের সঙ্গে তাঁর যে জুটিকে স্টিভেন স্মিথ বলছেন ম্যাচের 'টার্নিং পয়েন্ট' হিসেবে। এরপর অস্ট্রেলিয়ার ম্যাট রেনশ যখন বড় হুমকি হয়ে দাঁড়াচ্ছেন, ফিরিয়ে দিলেন তাঁকে। গ্লেন ম্যাক্সওয়েলকে স্পিনের ভেলকিতে বোকা বানালেন, পরে নিলেন পাঁচ উইকেট। 


    কিন্তু এসবই ছিল 'ট্রেলার'। আসল সিনেমাটা তখনও শুরুই হয়নি। চতুর্থ দিনে ওয়ার্নার পেয়ে গেছেন সেঞ্চুরি, স্মিথের সঙ্গে মিলে বাংলাদেশের জয়টা নিয়ে যাচ্ছেন দূর থেকে দূরে। একটা ব্রেকথ্রুর জন্য যখন বাংলাদেশ মাথা খুঁটে করছে, তখন আবারও সাকিব। ওয়ার্নার-স্মিথকে ফিরিয়ে আবারও ম্যাচে ফেরালেন দলকে। ম্যাক্সওয়েল-ওয়েডকে পরে আউট করে একাই ভেঙে দিলেন মেরুদণ্ড। 


    এসবের সাক্ষী হয়ে আছে স্কোরকার্ড। শুধু সাক্ষ্য দিচ্ছে না, সাকিব নিজে টানা এক প্রান্ত থেকে বল করে যাওয়ার পর উৎসাহ যুগিয়েছেন অন্য প্রান্ত থেকেও। কামিন্স যখন শেষদিকে দুই ছয়ে বড় কিছুর হুমকি দিচ্ছেন, তাইজুলকে গিয়ে কী যেন বললেন। শেষ পর্যন্ত ওই তাইজুলই নিয়েছেন শেষ উইকেট, তার আগে আরও দুইটি উইকেটে হয়ে গেছে টেস্ট উইকেটের ফিফটি। সাকিব পরে শুধু জানালেন, এক প্রান্ত থেকে টানা বল করে যাওয়ার জন্যই ব্যাটসম্যানদের শক্তি-দুর্বলতা ভালোভাবে পড়তে পারছিলেন। সেটা নিয়েই কিছু 'টিপস' দিয়েছেন তাইজুলকে। কাজ হয়েছে তাতেই। এসব তো আর পরিসংখ্যানে লেখা থাকবে না! 


    সাকিব নিজের চেয়ে সতীর্থদের কীর্তিটাই দেখলেন বড় করে, 'ছোট ছোট অবদান অনেক সময় গুরুত্বপূর্ণ। একটা ক্যাচ মিস বা একটা রান সেভ করা।  প্রতিটা জিনিসেরই অবদান আছে। কেউ বেশি করবে, কেউ কম করবে। এভাবেই একটা দল ফল পাবে। সবচেয়ে বড় উপলব্ধি দলের জেতার জন্য অবদান রাখতে পারাটা, যেটা আমি সবসময়ই করতে চাই। ' এমনকি ৫০তম টেস্টটাও স্মরণীয় করে রাখতে পারাটাও তাঁর কাছে এমন কিছু বলে মনে হচ্ছে না, 'অবশ্য আলাদা একটা অনুভূতি, দলের কিছু করতে পারা। আমার কাছে যদিও এটা (৫০তম টেস্ট) কিছুই মনে হয়নি কখনোই। এরকম একটা উপলক্ষে ভালো কিছু করতে পারলে অবশ্যই ভালো লাগে।'

     


    বরং এই টেস্ট জয়ে স্ত্রীর 'অবদানের' কথা বলতে গিয়েই খানিকটা উচ্ছ্বসিত হলেন। নিজের বিশ্বাসের নৌকা যখন টলমলো, স্ত্রীর কথা শুনেই বৈঠায় হাল ধরেছেন শক্ত করে। সেই বৈঠায় সওয়ার হয়েই তো বাংলাদেশের এই বদলে যাওয়া। সাকিব যে ব্যাপারটা দেখছেন দলের মানসিকতার বদল হিসেবেই, 'আজ যারা এসেছে, সবাই বিশ্বাস করেছে বাংলাদেশ জিতেছে। ওদের সেই বিশ্বাস থাকলে আমাদের কেন থাকবে না? আমরা হয়তো ছয় , সাত বা পাঁচ উইকেটে হারতে পারতাম। কিন্তু আমাদের চেষ্টা বড় ব্যাপার ছিল। দলের পরিবর্তন এসেছে এটা তারই বড় উদাহরণ।'


    সেই পরিবর্তনের হাওয়া লেগেছে বাংলাদেশের ড্রেসিংরুমেও। দল এখন জয়ের জন্য খেলে, বলেকয়েই দিতে পারে জয়ের ঘোষণা। আগ্রাসী সেই শরীরী ভাষাটাই সাকিবের চোখে দিনবদলের শুরু, 'আমি চাই সবার যেন এই সাহস থাকে। দলের জন্য ইতিবাচক মনোভাব থাকলে দলের জন্য ভালো হবে। সব সময় হয়তো এটাতে কাজে দেবে না, কিন্তু বেশির ভাগ সময়ই সফল হব।'

     
    বদলে যাওয়া এই বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বিজ্ঞাপন তো সাকিব আল হাসানই!