গ্যালারির গল্পটা যেন বদলে না যায়

কতোই হবে ছেলেটার বয়স? তেরো-চৌদ্দর বেশী হওয়ার কথা নয়। শহীদ মুশতাক স্ট্যান্ডের নীচ তলায় হসপিটালিটি বক্সের দেয়াল ঘেঁষে একা একাই বসে ছিল। গতকালের বাংলাদেশ-পাকিস্তান ম্যাচের দ্বিতীয়ার্ধের প্রায় পুরোটা সময় ছেলেটা ক্লান্তিহীন চিৎকার করে গেলো। সাকিব, তাসকিন, রুবেল, সানি, মুশফিক যার হাতেই বল যাচ্ছে তাঁর নাম ধরেই আনাড়ি স্লোগান দেয়ার চেষ্টা। কখনও উইকেট চেয়ে গেলো, কখনও বাংলাদেশ জিতবেই - এমন জোর প্রত্যয় ব্যক্ত করলো। আশেপাশের দর্শকরা ফিরে ফিরে তাকিয়ে খানিকটা বিস্ময় নিয়েই তার গলার জোর দেখে গেলেন।
এমন উদ্যমী সমর্থকে অবশ্য গতকালের পুরো শেরে বাংলাই ভরপুর ছিল। এতোটা প্রাণবন্ত দর্শক মিরপুরের গ্যালারিতে প্রতিদিনই মেলে না। নির্ধারিত আসন ছাড়িয়ে জনসমাগম উপচে পড়লো মাঝের সিঁড়িতে, পিছনের কোরিডরে...আক্ষরিক অর্থেই হোম অব ক্রিকেটে কাল তিল ধারণের ঠাই ছিল না।
গতকালের মিরপুর শেরে বাংলা জাতীয় ক্রিকেট স্টেডিয়াম। ছবিঃ প্যাভিলিয়ন।
কেবলই কি সংখ্যাধিক্য? ত্রিশ ডিগ্রীর ওপর তাপমাত্রা মাথায় নিয়ে মিরপুরের ত্রিশ সহস্রাধিক দর্শক কাল নিরলস সমর্থন যুগিয়ে গেলো টাইগারদের। মাঝে তামিম-সৌম্য-মাহমুদুল্লাহদের সাথে খানিকটা সময়ের জন্য গ্যালারিও যে ঝিমিয়ে পড়ে নি তা নয়। তবে সেটা খুবক্ষণ স্থায়ী হয় নি। প্রচণ্ড গরমে হাঁসফাঁস করতে করতেও দর্শক সম্ভবত বুঝে গিয়েছিল কাঠফাটা রোদ্দুর গ্যালারির উত্তাপ হয়ে মাঠে ছড়িয়ে না গেলে ম্যাচ লাগামছাড়া হয়ে যাওয়াটা অস্বাভাবিক নয়। সে তাগিদ থেকেই হয়তো আওয়াজ উঠলো তামিমের নামে। জেগে উঠলেন তামিমও...দশ ওভার বাদে এলো চারের মার, সাদ নাসিমের ফুল লেন্থ আউটসাইড ডেলিভারি কাভার ড্রাইভে সীমানা ছাড়াল।
এমন তাৎক্ষণিক প্রতিউত্তর পেয়ে গ্যালারির গর্জন ক্রমেই বাড়তে লাগলো। রাহাত আলী মাহমুদুল্লাহর ষ্ট্যাম্প উড়িয়েও তাতে ভাটা দিতে পারলেন না। সুরটা কেটে যাওয়ার আগেই তামিমের সাথে যোগ দিলেন মুশফিকুর রহিম। স্ট্রোকের ফুলঝুরিতে বাংলাদেশ ইনিংসের বাকিটা সময় দর্শকরা বিশ্রামের ফুরসত কদাচিৎই পেলেন। টর্নেডো তামিম আর মারকুটে মুশফিকের ব্যাটে কালবৈশাখীর সব সংস্করণ যেন কাল মিরপুরে আছড়ে পড়েছিল।
পাঁচ বছরেরও বেশী সময় পর আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে তামিমের শতক উদযাপনের সৌভাগ্য হল শেরে বাংলা স্টেডিয়ামের। আর মুশফিকুর রহিম তো যে কোন ধরণের আন্তর্জাতিক ফরম্যাটে প্রথম শতক পেলেন বাঘের ডেরায়! প্রথমবারের মতো একদিনের আন্তর্জাতিকে এক ইনিংসে দুই শতক, যে কোন উইকেট জুটিতে সর্বোচ্চ রান...ষোল বছরের হিসেব চুকনোর দিনে অনেককিছুই নতুন করে পেলো বাংলাদেশ।
এতো নতুনত্বের দিনে গ্যালারিতেও কি নতুন কিছু ছিল না? মার খাওয়া বোলার কিংবা ফিল্ডিং মিস করা ফিল্ডারটিকে যেভাবে দর্শকরা উৎসাহ দিয়ে সাহস যুগিয়ে গেলেন সেটাও হয়তো নতুন কিছুরই ইঙ্গিতবহ। তবে একদিনের এমন পরিবর্তন দেখে জোর দিয়ে বলা যায় না যে ক্যাচ মিস করা মাহমুদুল্লাহ বা এক ওভারে চারটে চার দিয়ে বসা আবুল হাসানের উদ্দেশ্যে গ্যালারি থেকে আর কোনদিনই দুয়োধ্বনি ছুটে যাবে না।
কিন্তু অন্তত গতকাল দর্শকরা যেভাবে বিরতিহীন সমর্থন যুগিয়ে গেলেন সেটার প্রশংসা তো খোদ সাকিব আল হাসানই করলেন! সঙ্গে এই অনুরোধও রাখলেন যে দুঃসময়ে যেন চিত্রটা বদলে না যায়। সমর্থকরা পারবেন তো অনুরোধটুকু রাখতে? বাংলাদেশ ক্রিকেটের দিনবদল যে এই প্রশ্নের জবাবের উপরও অনেকাংশে নির্ভরশীল - সাকিবের আকুতিতে সেটা স্পষ্টই।
[থাম্বনেল ছবি সৌজন্যঃ দ্য ডেইলি স্টার]