• " />

     

    সমস্যার নাম পেস বোলিং

    সমস্যার নাম পেস বোলিং    

    বিশ্বকাপে বাংলাদেশের হয়ে সবচেয়ে আলো ছড়িয়েছিলেন পেসাররা। মাশরাফি, তাসকিন, রুবেল- ত্রয়ী বাংলাদেশকে অনেকবারই এনে দিয়েছেন আনন্দের উপলক্ষ। পাকিস্তানের সঙ্গে ওয়ানডে সিরিজেও খুব খারাপ করেননি। কিন্তু টেস্টে বাংলাদেশের পেসাররা যথারীতি ধুঁকছেন। রুবেল ও শহীদের সংগ্রাম থেকে প্রশ্নটা অনেকের মনেই জাগতে পারে, দীর্ঘ সংস্করণের জন্য বাংলাদেশে কি যথেষ্ট মানসম্মত পেসার আছে?

     

     

    টেস্ট স্ট্যাটাসের বয়সটা খুব বেশী নয়। আবার সাড়ে চৌদ্দ বছর খুব কমও নয়। তবে সামর্থ্যের অভাব, প্রতিভা অন্বেষণের কাঠামোগত দুর্বলতা, ভালো প্রতিভা পরিচর্যার অভাব...টেস্ট ক্রিকেটের পনেরোতম বছরে এসে বাংলাদেশের ‘আগাগোড়া’ একটি টেস্ট দল গড়ে তুলতে না পারার কৈফিয়তের তালিকা বেশ লম্বাই। তারপরও তুলনামূলক মানসম্পন্ন ব্যাটিং আর স্পিন বোলিংয়ের কল্যাণে কালেভদ্রে টেস্ট ক্রিকেটে সাফল্য মিলতে শুরু করেছে। তবে গুরুত্বপূর্ণ যে কারণে সেটা নিয়মিত হচ্ছে না তা হল পেস আক্রমণে চিরায়ত দুর্বলতা। সীমিত ওভারের ক্রিকেটে খুব সম্প্রতি সে সমস্যার সমাধানে আপাত আশার আলো দেখা গেলেও টেস্ট ক্রিকেটে বাংলাদেশের পেস আক্রমণ আজ অব্দি অন্ধকারের কানাগলিতে ঘুরপাক খাচ্ছে। এই সময়কালে ভালো বোলার আসেন নি তা নয়। তবে ইনজুরি কিংবা ধারাবাহিকতার অভাব যে কোন কারণেই হোক তাঁদের প্রায় কেউই লম্বা সময় খেলতে পারেন নি পাঁচদিনের আন্তর্জাতিক ক্রিকেট।

    বাংলাদেশের পক্ষে এ যাবতকালের সবচেয়ে সফল টেস্ট বোলার কে সেটা নতুন করে বলাটা বাহুল্যই। তবে যেটা স্মরণ করিয়ে দেয়া মোটেও বাহুল্য নয় সেটা হল মাশরাফি বিন মর্তুজার যোগ্য উত্তরসূরির অভাব। যে কোন ফরম্যাটেই বাংলাদেশের সবচেয়ে সফল এই পেসার ক্যারিয়ারের সর্বশেষ টেস্ট ম্যাচটি খেলেছেন ২০০৯ সালে।

     

    ইনজুরির উপর্যুপরি আঘাত সামলে টেস্ট ক্রিকেটে আর ফেরা হয়ে ওঠে নি মাশরাফির

     

    ৩৬ টেস্টে ৫১ ইনিংসে বল করে ৪১.৫২ গড়ে ৭৮টি টেস্ট উইকেটের মালিক মাশরাফির ধারেকাছে টেস্ট সাফল্য আছে একজনেরই। শাহদাত হোসেন রাজীব। দেশের হয়ে সবচেয়ে লম্বা সময় টেস্ট ক্রিকেটে (২০০৫-) থেকে শাহাদাত পেসারদের মধ্যে খেলেছেন সবচেয়ে বেশী ৩৭টি টেস্ট। মাশরাফির চেয়ে ৮ ইনিংস বেশী বল করে ৫১.৭৬ গড়ে তাঁর ক্যারিয়ারের উইকেটসংখ্যা ৭২। বাংলাদেশের পক্ষে এখনও পর্যন্ত সবচেয়ে বেশী ৪ বার পাঁচ উইকেট পাওয়া পেসারও তিনিই। তবে দুশ্চিন্তার বিষয় হচ্ছে সাম্প্রতিক অতীতে শাহাদাত সেভাবে নিজেকে আর মেলে ধরতে পারেন নি।

     

    নিজেকে হারিয়ে খুঁজে ফিরছেন শাহাদাত


    তারচেয়েও শঙ্কার ব্যাপার এই দু’জনের পর বাংলাদেশের টেস্ট ইতিহাসে সাফল্য বিবেচনায় তৃতীয় পেসারটি শেষ টেস্ট খেলেছেন আজ থেকে ১০ বছর আগে! উইকেটসংখ্যায় তাঁর সাফল্য প্রথম দু’জনের অর্ধেক। ২১ টেস্ট থেকে ৩৬ উইকেট পাওয়া তাপস বৈশ্য মাত্র তিন বছরেই টেস্ট ক্যারিয়ারের শেষ দেখে ফেলেছিলেন।

    বাংলাদেশ টেস্ট দলে যে কোন সময়ের চতুর্থ সফল পেসার রুবেল হোসেন। একদিনের ক্রিকেটে মাশরাফির নেতৃত্বাধীন পেস আক্রমণে রুবেল এই মুহূর্তে বাংলাদেশের অন্যতম সেরা অস্ত্রই। তবে টেস্টে এখনও পর্যন্ত ধারাবাহিকভাবে সাফল্য খুঁজে পেতে ব্যর্থ তিনিও। ২৩ টেস্ট থেকে ৭৪.৯০ গড়ে তাঁর প্রাপ্ত উইকেটসংখ্যা ৩২। ক্যারিয়ারে এক ইনিংসে ৫ উইকেট পেয়েছিলেন একবারই, সেটাও সেই ২০১০ সালে। আগে-পরে টেস্টে চার উইকেটের দেখাও পান নি তিনি।

     

    কালেভদ্রের সাফল্যে সাদা পোশাকের রুবেল হোসেনে হাসিটা চওড়া হচ্ছে না বহুদিন

     

    টেস্টে বাংলাদেশের পক্ষে সর্বোচ্চ উইকেট সংগ্রাহকরা

     

    বোলার সময়কাল ম্যাচ/ইনিংস উইকেট সেরা ইনিংস গড় ইকোনমি ইনিংসে ৫ উইকেট
    মাশরাফি বিন মর্তুজা ২০০১-২০০৯ ৩৬/৫১ ৭৮ ৪/৬০ ৪১.৫২ ৩.২৪
    শাহাদাত হোসেন ২০০৫- ৩৭/৫৯ ৭২ ৬/২৭ ৫১.৭৬ ৪.১৫
    তাপস বৈশ্য ২০০২-২০০৫ ২১/২৯ ৩৬ ৪/৭২ ৫৯.৩৬ ৩.৭৯
    রুবেল হোসেন ২০০৯- ২৩/৪০ ৩২ ৫/১৬৬ ৭৪.৯০ ৩.৯২
    মঞ্জুরুল ইসলাম ২০০১-২০০৪ ১৭/২২ ২৮ ৬/৮১ ৫৭.৩২ ৩.২৪
    রবিউল ইসলাম ২০১০-২০১৪ ৯/১৭ ২৫ ৬/৭১ ৩৯.৬৮ ৩.২০

     

    ২০১০ সালে লর্ডসে টেস্ট অভিষেক হয়েছিল সম্ভাবনাময় পেসার রবিউল ইসলামের। প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে রেকর্ড ৯ বার করে চার ও পাঁচ উইকেট দখল করা এই ডানহাতি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নিজেকে চেনাতে সময় নেন তিন বছর। ২০১৩ সালে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে জিম্বাবুয়ের মাঠে পুরো সিরিজে ১৫ উইকেট নিয়ে হয়ে যান ম্যান অব দ্য সিরিজ। সে সফরেই এক ইনিংসে ৭১ রানের বিনিময়ে ৬ উইকেট তাঁর ক্যারিয়ার সেরা। পরের টেস্টেই দ্বিতীয়বারের মতো পেয়েছিলেন এক ইনিংসে পাঁচ উইকেট। বাংলাদেশের পক্ষে টেস্টে ৪০-এর নীচে গড় থাকা ২ পেসারের একজন তিনি। খেলেছেন অবশ্য মাত্র ৯টি টেস্ট, ৩৯.৯৮ গড়ে নিয়েছেন ২৫টি উইকেট। শাহাদাতের পর দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ২ বার পেয়েছেন ৫ উইকেটও। সেই রবিউল পরের তিন টেস্টে উল্লেখযোগ্য সাফল্য না পাওয়ায় দল থেকে ছিটকে পড়েন।

    শাহাদাত-রবিউল-রুবেলদের বাইরে বাংলাদেশের হয়ে টেস্টে এক ইনিংসে পাঁচ উইকেট আছে কেবল আর একজন পেসারের। ২০০১ সালে বুলাওয়েতে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ক্যারিয়ারের প্রথম টেস্টেই পেয়েছিলেন এক ইনিংসে ৬ উইকেট। বাংলাদেশের পক্ষেও প্রথম বটে! সেই মঞ্জুরুল ইসলামও টেস্ট ক্যারিয়ার তিন বছরের বেশী দীর্ঘায়িত করতে পারেন নি। এমনি করে অসময়ে হারিয়ে যাওয়া নাম সৈয়দ রাসেল, নাজমুল হোসেন। ইনজুরির কাছে হার মেনেছেন মোহাম্মদ শরীফ, সংগ্রাম করে যাচ্ছেন শফিউল ইসলাম।

    ঘরোয়া লিগে চমকে দেয়া পারফর্ম করে বছর দুয়েক আগে টেস্ট দলে সুযোগ পেয়েছিলেন আল-আমিন হোসেন। এ পর্যন্ত খেলা ৬ টেস্টে উইকেটের দেখা সেভাবে না পেলেও জাত চেনাতে পেরেছিলেন ঠিকই। বাঁহাতি ব্যাটসম্যানদের বিপক্ষে তাঁর ভালো সাফল্য নজর কেড়েছিল বাংলাদেশের বর্তমান পেস বোলিং কোচ হিথ স্ট্রিকেরও। সেই আল-আমিন সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের সবচেয়ে হতভাগ্য ক্রিকেটারটির নাম। ‘অবৈধ’ বোলিং অ্যাকশন শুধরে সঙ্গী হয়েছিলেন বিশ্বকাপ দলের। কিন্তু শৃঙ্খলাভঙ্গের খড়গ মাথায় নিয়ে তাঁর ক্যারিয়ারই এখন হুমকির মুখে।

     

    দলে জায়গা ফিরে পেলেও পুরনো রসায়ন ফিরে পাবেন কি আল আমিন?


    ওপরে যাদের কথা বলা হল এরাই বাংলাদেশের চৌদ্দ বছরের টেস্ট ক্রিকেটে পেস আক্রমণের অর্জন। অথচ আন্তর্জাতিক মান বিবেচনায় তাঁদের কেউই সে অর্থে ‘সফল’ নন। টেস্টে এ যাবতকালে বাংলাদেশের হয়ে পেস বল করেছেন ৩০ জন বোলার। এঁদের মধ্যে একাধিক টেস্ট খেলেছেন এমন কারোরই ৩০-এর নীচে গড় নেই। চল্লিশের নীচে গড় আছে কেবল দু’জনের! রবিউল ইসলাম ছাড়া আরেকজন নাজমুল হোসেন (৩৮.৮০)। পঞ্চাশের নীচে গড় রয়েছে মাশরাফি (৪১.৫২), সৈয়দ রাসেল (৪৭.৭৫) ও আফতাব আহমেদের (৪৭.৪০)। বাংলাদেশী বোলারদের টেস্ট ক্যারিয়ারের গড় বয়স ৩ বছর!

    সাম্প্রতিক সময়ের পেসারদের মধ্যে তাসকিন আহমেদ একদিনের ক্রিকেটে বাংলাদেশ দলের নতুন অর্জন। পাকিস্তানের বিপক্ষে সর্বশেষ টিটোয়েন্টিতে অভিষিক্ত মুস্তাফিজুর রহমানও প্রতিভার ঝলক দেখিয়েছেন। ঘরোয়া ক্রিকেটে ভালো করে পাকিস্তানের বিপক্ষে চলতি টেস্টের দলে সুযোগ পেয়েছেন মোহাম্মদ শহীদ। কিন্তু টেস্ট ক্রিকেট পলকের ঝলক দেখানোর খেলা নয়। লম্বা সময় ধরে সাফল্যের সাথে খেলে যাওয়ার মতো পেস আক্রমণ বাংলাদেশের টেস্ট দল এখনও পায় নি। অথচ টেস্ট ক্রিকেটে ধারাবাহিক উন্নতির জন্য জন্য এটি অন্যতম পূর্ব শর্তই।

     

    টেস্ট ক্রিকেটের জন্য তাসকিনদের গড়ে তুলতে এখনই নিবিড় পরিচর্যা জরুরী
     

    বাংলাদেশের ঘরোয়া ক্রিকেটের কাঠামোগত দুর্বলতা নিয়ে বিশ্বকাপ চলাকালীন লিখেছিলেন জনপ্রিয় ক্রিকেট কলামিস্ট ও ভাষ্যকার ডিন জোন্স। এই দুর্বল কাঠামো থেকেও কালেভদ্রে বের হয়ে আসা প্রতিভাগুলো নষ্ট হয়ে যাচ্ছে পর্যাপ্ত পরিচর্যার অভাবে। এভাবে ধুঁকতে থাকা পেস আক্রমণ নিয়ে টেস্ট ক্রিকেটে উজ্জ্বল ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখাটা একরকম বিলাসিতা। একদিনের ক্রিকেটে বাংলাদেশ ক্রিকেট মোটামুটি ধারাবাহিক উন্নতির একটা পথ তৈরি করতে পেরেছে। টেস্টেও এমনটা করতে হলে অন্য অনেক মেরামতের পাশাপাশি পেস আক্রমণে স্থায়ীভাবে ধার বাড়ানোর কোন বিকল্প নেই। বাংলাদেশের ক্রিকেট কর্তারা যত দ্রুত সেটা বুঝে কার্যকর পদক্ষেপ নেবেন ততোই মঙ্গল।