• ফ্রেঞ্চ ওপেন
  • " />

     

    ফ্রেঞ্চ ওপেনের সেরা পাঁচ ম্যাচ

    ফ্রেঞ্চ ওপেনের সেরা পাঁচ ম্যাচ    

    লালমাটির দুর্গে চলতে থাকা জমজমাট লড়াইয়ের সাথে তাল মিলিয়ে প্যাভিলিয়নের পাঠকদের জন্য উপহার “ফ্রেঞ্চ ওপেনের সেরা পাঁচ”। এই ধারাবাহিকের তৃতীয় ও শেষ কিস্তি হিসেবে আজ থাকছে ফ্রেঞ্চ ওপেনের সেরা পাঁচ ম্যাচের গল্প।

     

    একশ' চব্বিশ বছরের পুরোনো ফ্রেঞ্চ ওপেনে স্মরণীয় ম্যাচের অভাব নেই একেবারেই- তাদের মধ্যে থেকে মাত্র পাঁচটি বের করা আর ভূতের কিল খাওয়াটা প্রায় কাছাকাছি ব্যাপার। সহজ সমাধান- ম্যাচের তালিকা ছেঁটে ছোট করে আনা। ফলাফল, এখানে উল্লেখ করা পাঁচটি খেলার সবগুলোই ওপেন যুগের- ১৯৬৭ সালের পরের।      

        

     

    ৫। ইভান লেন্ডল বনাম জন ম্যাকেনরো, ১৯৮৪

     

    জন ম্যাকেনরোকে ধরা হয় টেনিস বিশ্বের সবচেয়ে ক্যারিশমাটিক খেলোয়াড়দের একজন। ৭টি গ্র্যান্ড স্ল্যামের মালিক কুখ্যাত ছিলেন তার মেজাজের জন্যও- আর সেই মেজাজটাই বুঝি তার কাল হয়েছিল ১৯৮৪’র ফাইনালে। ক্লে কোর্টে বরাবরই দুর্বল ছিলেন ম্যাকেনরো, কিন্তু সেবার যেন অন্য কিছু ভর করেছিল তার ওপর- কোনো কোর্টেই হারানো যাচ্ছিল না তাঁকে। টানা ৪২ ম্যাচ জিতে (যার বড় অংশই মাটির কোর্টে) ফাইনালে ম্যাকেনরো মুখোমুখি হলেন ইভান লেন্ডলের, যার সাথে ওই বছর চারটি ম্যাচ খেলে চারটিতেই জিতেছিলেন তিনি (যার শেষ দুটি মাটির কোর্টেই, একেবারে সরাসরি সেটে)। লেন্ডল আগে কখনও কোন গ্র্যান্ড স্ল্যামও জেতেননি, তাই সবার কাছে ম্যাকেনরোই ছিলেন ফেভারিট।

     

     

    ফেভারিটের তকমাটাকে ভালই বয়ে নিয়ে যাচ্ছিলেন তিনি, প্রথম দু’সেটে পাত্তাই পেলেন না লেন্ডল। কিন্তু তৃতীয় সেটে এসে বের হয়ে এল চিরচেনা ম্যাকেনরো- দুম করে এক টিভি ক্যামেরার মাইক্রোফোনের উপর মেজাজ হারিয়ে বসলেন, সাথে বুঝি হারিয়ে বসলেন ম্যাচটাও। ক্যামেরাম্যানের কাছ থেকে মাইক্রোফোনটা কেড়ে নিয়ে প্রচন্ড ধমকে দিলেন সেটাকে, ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে ফেরত আসলেন খেলায়। কিন্তু ততক্ষণে দর্শকরা সবাই চলে গেছেন ধীরস্থির লেন্ডলের পক্ষে- লেন্ডলও পায়ের নীচে মাটি পেলেন যেন। হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ে শেষ পর্যন্ত লেন্ডল জিতলেন তার প্রথম ফ্রেঞ্চ ওপেন শিরোপা- আর ম্যাকেনরোকে পুরো ক্যারিয়ার জুড়ে ওই এক ফ্রেঞ্চ ওপেনের ফাইন্যালেই সন্তুষ্ট থাকতে হল।     

     

     

    ৪। রাফায়েল নাদাল বনাম নোভাক জোকোভিচ, ২০১৩

     

    ফ্রেঞ্চ ওপেনের সেরা ম্যাচের তালিকা হবে আর তাতে ফ্রেঞ্চ ওপেনের সর্বকালের সেরা খেলোয়াড়ের কোন ম্যাচ থাকবে না তা কি হয়? খুব হয়। মাটির রাজা তার ফ্রেঞ্চ ওপেনে এই পর্যন্ত জেতা ৬৯টি ম্যাচের প্রায় সবগুলোতেই প্রতিপক্ষকে এমন হেসেখেলে উড়িয়ে দিয়েছেন, যে সেগুলোকে আলাদা করে মনে রাখা বাতুলতাই। তবে এর মধ্যেও একটা ম্যাচ আলাদা জায়গা করে রাখবে টেনিসপ্রেমীদের মনে, ২০১৩’র নাদাল-জোকভিচ সেমিফাইনাল- যে ম্যাচকে কিংবদন্তি জন ম্যাকেনরো “ক্লে কোর্টের সেরা ম্যাচ” বলেই ঘোষণা দিয়ে দিয়েছেন।

     

     

    জোকোভিচ তখন ফর্মের তুঙ্গে- প্রথমবারের মতো উঠেছেন র‍্যাংকিংয়ের শীর্ষে- আর ইনজুরিকে জয় করে নাদাল এসেছেন ফ্রেঞ্চ ওপেনে তার শিরোপা ধরে রাখতে। প্রথম তিন সেটের একটি জোকোভিচ ৬-৩ ব্যবধানে জিতলেও বাকি দুটোয় নাদাল ৬-৪ আর ৬-১ গেমে জিতে ফাইনালের পথে এগিয়ে গিয়েছিলেন অনেকটাই।

     

    চতুর্থ সেটেও নাদাল এগিয়ে ছিলেন, তুমুল প্রতিদ্বন্দিতাপূর্ণ সেটটা ৬-৫ থাকতে নাদাল সার্ভ করছিলেন সেট আর ম্যাচের জন্য। কিন্তু জোকোভিচ দুর্দান্তভাবে ফিরে এলেন, গেম বাঁচিয়ে সেটটাই জিতে নিলেন টাইব্রেকারে। তারপরই শুরু মহাকাব্যিক এক ফাইনাল সেটের। ক্লান্ত নাদালকে নাচিয়ে বেড়ালেন জোকোভিচ প্রথম ছয় গেমে, ৪-২ ব্যবধানে এগিয়ে গেলেন শেষ সেটে। কিন্তু মাটির রাজা এত সহজে হার মানলে তো! জোকোভিচের সার্ভিস ব্রেক করে নাদাল ঠিকই ফিরলেন খেলায়, টেনে নিয়ে গেলেন ষোলতম সেটে- এবং জিতে নিলেন তার অষ্টম সেমিফাইনাল।

     

     

    ৩। মনিকা সেলেস বনাম স্টেফি গ্রাফ, ১৯৯২

     

    পাঁচ গ্র্যান্ড স্ল্যামজয়ী আঠারো বছর বয়সী এক নম্বরের বিপরীতে দশ গ্র্যান্ড স্ল্যামজয়ী বাইশ বছর বয়সী দুই নম্বর খেলোয়াড়ের ফাইনাল ম্যাচ- একটা ম্যাচকে সেরার তালিকায় রাখার জন্য এই সংখ্যাগুলোই যথেষ্ট। সাথে ৬-২,৩-৬,১০-৮ স্কোরলাইন আর দেড়ঘন্টা ধরে খেলা তৃতীয় সেট- নিশ্চিতভাবেই এই ম্যাচ ফ্রেঞ্চ ওপেনের সেরা পাঁচে জায়গা পাওয়ার দাবিদার। অনিশ্চয়তার দোলনায় দুলতে থাকা ম্যাচটার শুরুতে কিন্তু অনিশ্চয়তার কোন ইঙ্গিত একেবারেই পাওয়া যায়নি- প্রথম সেটে আগের দু’বারের চ্যাম্পিয়ন সেলেস দাঁড়াতেই দেননি স্টেফিকে।

     

     

    কিন্তু দ্বিতীয় সেটেই ঘুরে দাঁড়ালেন স্টেফি, ৬-৩ ব্যবধানে জিতে নিলেন দ্বিতীয় সেট। তারপরই শুরু মহাকাব্যিক সেই তৃতীয় সেটের। স্টেফি ৩-৫ গেমে পিছিয়ে পড়ে সার্ভ করছিলেন ম্যাচ বাঁচানোর জন্য। সেই সেটেও তিনি পিছিয়ে পড়েছিলেন, কিন্তু প্রচন্ড দৃঢ়তায় চার-চারটি ম্যাচ পয়েন্ট বাঁচিয়ে ফিরে এলেন খেলায়। সে এমনই ফিরলেন যে একাদশ সেটে এগিয়েই গেলেন তিনি ৬-৫ গেমে। সেলেস পরের সেটটি জিতে সমতা আনলেও স্টেফি আবার এগিয়ে গেলেন ৭-৬ ব্যবধানে। যখন মনে হচ্ছিল স্টেফি বুঝি অবশেষে ১৯৯০'র ফাইনালের প্রতিশোধ নিয়েই ছাড়বেন, তখনই সেলেস আবার দু’টো সেট জিতে এগিয়ে গেলেন ৮-৭ গেমে, সেখান থেকে আবার সমতা আসল (৮-৮)।

     

    কিশোরী চ্যাম্পিয়নের অহংয়ে তাতে শেষ আঘাতটা লাগলো কিনা, সেলেস পরের দুই সেটে দাঁড়াতেই দিলেন না স্টেফিকে; ১০-৮ গেমে শেষ সেট জিতে চুমু খেলেন তাঁর টানা তৃতীয় ফ্রেঞ্চ ওপেন শিরোপায়। টেনিসের ইতিহাসবিদদের কাছে এই ফাইনালের আরেকটা মাহাত্ম্য ছিল সবসময়; এটাই ছিল ফর্মের তুঙ্গে থাকা সেলেসের শেষ ফ্রেঞ্চ ওপেন- ১৯৯৩’র ফ্রেঞ্চ ওপেনের সপ্তাহ তিনেক আগে স্টেফির এক উন্মাদ ভক্তের ছুরিকাঘাতে প্রায় শেষই হয়ে গিয়েছিল সেলেসের ক্যারিয়ার।

     

     

    ২। মাইকেল চ্যাং বনাম ইভান লেন্ডল, ১৯৮৯

     

    টানা তিন ম্যাচ সরাসরি সেটে জিতে র‍্যাঙ্কিংয়ে এক নম্বরে থাকা ইভান লেন্ডল চতুর্থ রাউন্ডে সামনে পেলেন সতেরো বছরের কিশোর মাইকেল চ্যাংকে। প্রথম দু’সেটেই নিজের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করলেন লেন্ডল, দুটো সেটই জিতে নিলেন ৬-৪ ব্যবধানে। কিন্তু তৃতীয় সেটে ফিরে এলেন চ্যাং; ৬-৩ গেমে জিতে নিলেন সেটটা। তাতেই কি অহমে লাগল লেন্ডলের?

     

    চতুর্থ সেট থেকেই লেন্ডল বারবার অভিযোগ করতে শুরু করলেন কন্ডিশন নিয়ে, বাজে কলের অজুহাতে কয়েকবার তো তেড়েই গেলেন আম্পায়ারের দিকে। পেনাল্টিতে এক পয়েন্ট হারিয়ে একটা গেমই হেরে বসলেন এসবের জন্য, ৬-৩ ব্যবধানে হেরে গেলেন চতুর্থ সেটও। ওদিকে চতুর্থ সেট চলাকালেই ক্র্যাম্প ধরল চ্যাংয়ের পায়ে; এতোটাই যে, নিজের স্বভাবগত ফ্ল্যাট ফোরহ্যান্ড ছেড়ে ভাসিয়ে দেয়া মুনবল মারতে শুরু করলেন।

     

     

    মুনবলের অতিরিক্ত বাউন্স সামলাতে লেন্ডলের ঘাম ছুটে গেল, ফলাফল- পঞ্চম সেটেও চ্যাং এগিয়ে গেলেন। তারপরও ক্র্যাম্পের যন্ত্রণায় অস্থির হয়ে খেলা ছেড়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে চ্যাং যাচ্ছিলেন চেয়ার আম্পায়ারের দিকে- কিন্তু শেষে কী বুঝে যেন আবার খেলা শুরু করলেন। অষ্টম সেটে ৪-৩ ব্যবধানে এগিয়ে থেকে সার্ভ করছিলেন চ্যাং- কিন্তু দুটো সার্ভিস মিস করে পিছিয়ে গেলেন ১৫-৩০ পয়েন্টে।

     

    তখনই তাঁর হাত থেকে বেরোল একটি আন্ডারআর্ম সার্ভ- নিখুঁত সার্ভটি একটি পয়েন্ট তো দিলই, সাথে নাড়িয়ে দিল লেন্ডলের আত্মবিশ্বাসও। ফলাফল, পরের সেটের শেষ সার্ভে লেন্ডলের ডাবল ফল্ট, আর চ্যাংয়ের কোয়ার্টার ফাইনাল। সবচেয়ে কমবয়সী পুরুষ খেলোয়াড় হিসেবে গ্র্যান্ড স্ল্যাম জেতার ইতিহাস করেছিলেন চ্যাং সেবারই।

     

     

    ১। স্টেফি গ্রাফ বনাম মার্টিনা হিঙ্গিস, ১৯৯৯

     

    ফ্রেঞ্চ ওপেনের সেরা ম্যাচ? সন্দেহ থাকতে পারে, কিন্তু ফ্রেঞ্চ ওপেনের সবচেয়ে বিতর্কিত ম্যাচ সে বিষয়ে নিশ্চিতভাবেই সন্দেহ নেই। ফর্মের তুঙ্গে থাকা ঊনিশ বছরের কিশোরী মার্টিনা হিঙ্গিস ফাইনালে মুখোমুখি হয়েছিলেন ত্রিশ ছুঁই-ছুঁই অবসরের দোরগোড়ায় দাঁড়ানো স্টেফি গ্রাফের। র‍্যাঙ্কিংয়ের হিসেবে হিঙ্গিস ছিলেন ফেভারিট- ফেভারিটের মতই প্রথম সেট জিতে নিয়েছিলেন ৬-৪ গেমে, দ্বিতীয় সেটেও স্টেফির সার্ভিস ব্রেক করে এগিয়ে ছিলেন ২-০তে।

     

    তারপরই অঘটন; হিঙ্গিসের একটা ফোরহ্যান্ড বাইরে পড়েছিল কিনা সেটা নিয়ে তুমুল তর্ক শুরু হল আম্পায়ার আর খেলোয়াড় দু’জনের মধ্যে। এতটাই উত্তাপ ছড়ালো সেটা যে হিঙ্গিস নিজের কোর্ট থেকে বেরিয়ে এসে গ্রাফের কোর্টে দাঁড়িয়ে থাকলেন ব্যাখ্যার জন্য। ফলাফল- পেনাল্টিতে একটা পয়েন্ট হারালেন হিঙ্গিস, সাথে জুটল পুরো স্টেডিয়ামের দুয়ো।

     

     

    তারপরও দ্বিতীয় সেটে ৫-৪ গেমে এগিয়ে থেকে চ্যাম্পিয়নশিপের জন্য সার্ভ করছিলেন হিঙ্গিস; আর তখনই স্টেফি দেখালেন জাদু- টানা তিনটা গেম জিতে দ্বিতীয় সেট নিজের করে নিলেন। শেষ সেটে এসে আগেও পাঁচবার ফ্রেঞ্চ ওপেন জেতা স্টেফি ৫-২ গেমে এগিয়ে গেলেন- ম্যাচ পয়েন্টের মুহূর্তে এসে ম্যাচ হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে বুঝতে পেরে টেনিসের আইনের বইয়ের একটা ফাঁককে কাজে লাগালেন হিঙ্গিস; আন্ডারআর্ম সার্ভ করে বসলেন এবং পুরো গ্যালারিকে স্তব্ধ করে দিয়ে জিতে নিলেন পয়েন্টটি।

     

    কাজ হচ্ছে ভেবে আরও একবার হিঙ্গিস আন্ডারআর্ম সার্ভের চেষ্টা করলেন, কিন্তু বিফল হলেন এবারে- পুরো স্টেডিয়াম আবার ফেটে পড়ল দুয়োতে। দ্বিতীয় ম্যাচ পয়েন্টেই স্টেফি জিতে নিলেন ম্যাচ, আর অভিমানী হিঙ্গিস সব ছুঁড়ে ফেলে ঢুকে গেলেন ড্রেসিং রুমে; ম্যাচ-পরবর্তী পুরস্কার বিতরণী রেখেই (হিঙ্গিসের মা শেষ পর্যন্ত বুঝিয়ে মেয়েকে ফেরত এনেছিলেন রানার্স আপের ট্রফিটা হাতে নেয়ার জন্য)। এই ফাইনালের দু’মাস পরেই টেনিসকে বিদায় জানিয়েছিলেন বাইশ গ্র্যান্ডস্ল্যাম জয়ী স্টেফি গ্রাফ।

     

     


     

    আরও পড়ুনঃ
     

    ফ্রেঞ্চ ওপেনের আদ্যোপান্ত

    ফ্রেঞ্চ ওপেনের সেরা পাঁচ নারী খেলোয়াড়

    ফ্রেঞ্চ ওপেনের সেরা পাঁচ পুরুষ খেলোয়াড়