• ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগ
  • " />

     

    নাগরিগ থেকে মিশরের ফুটবল-ঈশ্বর

    নাগরিগ থেকে মিশরের ফুটবল-ঈশ্বর    

    কায়রোর শহরতলির একটা এলাকা। রাস্তার ধারে সার বাঁধানো সব দোকান, দেয়ালে প্রকাণ্ড সব ম্যুরাল। কিংবদন্তি গায়িকা উম্মে কুলসুম, নোবেলবিজয়ী লেখক নাগিব মাহফুজ... মিশর তো বটেই, পুরো আরব বিশ্বের সবার কাছে ছবিগুলো বেশ চেনা। তাঁদের পাশেই শোভা পাচ্ছে দাঁড়িগোঁফে ঢাকা এক তরুণের ছবি। মিশর ছাড়িয়ে যাঁর নাম ছড়িয়ে গেছে এখন মহাদেশ থেকে মহাদেশে। মোহামেদ সালাহ যেন রূপকথার সেই রাজপুত্র, যার অপেক্ষায় এতোদিন অধীর হয়ে বসে ছিল পুরো মিশর।

    ***

    ছয় মাস আগের আলেকজান্দ্রিয়ায় একটু ফিরে যাওয়া যাক। কঙ্গোর সঙ্গে ম্যাচটা জিতলেই মিশর চলে যাবে বিশ্বকাপে। ৮৮ মিনিট পর্যন্ত এগিয়ে ছিল মিশর, এরপরেই আলেকজান্দ্রিয়াকে স্তব্ধ করে দিয়ে গোল করে বসল কঙ্গো। টিভি ক্যামেরায় দেখা গেছে, সালাহ তখন হতাশায় মূহ্যমান হয়ে লুটিয়ে পড়েছেন মাটিতে। সঙ্গে সঙ্গেই উঠে দাঁড়ালেন, চিৎকার করে হাত উঁচু করে জাগিয়ে তুললেন স্টেডিয়াম। বাতাসে কোনো অলৌকিকের গন্ধ টের পেয়েছিলেন কি না কে জানে! যোগ করা সময়ের শেষে এসে পেনাল্টি পেল মিশর। স্পটকিক নেবেন সালাহ, জানেন একটা ভুল ধূলোয় মিশিয়ে দিতে পারে গোটা জাতির স্বপ্নসৌধ। সালাহ মাথা ঠাণ্ডা রেখে বল জড়িয়ে দিলেন জালে। আলেকজান্দ্রিয়া ফেটে পড়ল উল্লাস আর গর্জনের এক নারকীয় কোরাসে। ইউটিউবে সে ম্যাচের ভিডিও দেখুন, আপনার গায়ের প্রতিটি রোমকূপে শিহরণ উঠবেই! সালাহ তখন লুটিয়ে পড়েছেন মাটিতে, একটু পর আলোকচিত্রীরা পেশাগত দায়িত্ব ভুলে তাঁকে আলিঙ্গনে বেঁধেছেন। মিশরের পরানের গহীনে ঠাঁই পেয়ে গেছেন তখনই। কিন্তু কে জানত, এ তো সবে শুরু!

    ***

    সালাহর সিঁড়িভাঙার গল্প তখন শেষ, এরপর শুধু লিফটে চড়ে একের পর এক চূড়া পেরিয়ে যাওয়া । কায়রো থেকে লিভারপুল, আলেকজান্দ্রিয়া থেকে লন্ডন- সালাহ হয়ে গেছেন একটা উন্মাদনা। মিশরে ফুটবল নিয়ে পাগলামি নতুন কিছু নয়, আল আহলি-জামালেকের কায়রো ডার্বিতে দুই এক জনের হাত পা ভাঙা মোটামুটি নিয়মিত ব্যাপার। ইউরোপিয়ান ফুটবলের মাতাল হাওয়াও সেখানে লেগেছে অনেক আগেই। ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড, লিভারপুল, আর্সেনালের সমর্থকও কম নেই। তবে গত কয়েক মাসে বদলে গেছে সবকিছু। কায়রোর প্লেস্টেশনের দোকানের সামনে মেসি-রোনালদোর ছবি সরে গেছে, এসেছে সালাহর ছবি। মোহাম্মেদ মেগাহেদ নামের একজন যেমন বলছেন, তাঁর ছয় বছরের ছেলে এখন শুধুই প্লেস্টেশনে লিভারপুল নিয়ে খেলে। কারণটা বোধ হয় বলে না দিলেও চলে। কায়রোর কফিশপগুলোতে লিভারপুলের খেলা শুরু হলেই সবাই চুপচাপ বসে থাকে, সালাহর গোলের সঙ্গে সঙ্গেই শুরু হয়ে যায় হেঁড়ে গলার কোরাস। লিভারপুল সমর্থকদের সংখ্যা বেড়ে গেছে তরতর করে, হু হু করে বিকোচ্ছে তাঁর জার্সি। অথচ এমন নয় ইংলিশ লিগে সালাহই প্রথম মিশরীয়। কিন্তু সালাহ নামটাই এখন এমন একটা বারুদ, যে আগুন ছড়িয়ে গেছে নীল নদের অফুরান জলরাশি থেকে সাহারার প্রতিটি বালিকণায়।

     

    ***

    কিন্তু গোলের পর গোল করছেন, একের পর এক রেকর্ড লুটোচ্ছে পায়- এই কারণেই কি সালাহর জনপ্রিয়তা এমন পারদের মতো চড়ছে মিশরে? আসল কারণটা জানতে একটু ঘুরে আসতে হবে মিশরের মফস্বল নাগরিগ থেকে।

    নাগরিগ নামের এই জায়গাটা আসলে শহর বলার জো নেই কোনোভাবেই, বরং বড় গ্রাম বলাই উচিত। রাস্তাঘাট খানাখন্দকে ভরা, তেমনি একটা ধূলোধূসরিত রাস্তায় একটা তিন তলা ভবন। আজকের এই সালাহর বেড়ে ওঠা সেই ১৫ হাজার লোকের মফস্বলে। মাসে সেখানে গড় আয় ১২ হাজার টাকা, মানুষজন নির্বিবাদী আটপৌরে জীবনে সেখানে অভ্যস্ত। বিশ্বাস হয়তো হতে চাইবে না, এই অখ্যাত গ্রামে মাস সাতেক আগেও বন্ধুদের সঙ্গে মিলে খেলা দেখেছেন সালাহ, আড্ডা দিয়েছেন রাস্তায়। ১১ বছর আগে এই নাগরিগে গেলেই দেখতে পেতেন, কাঁধে ব্যাগ নিয়ে এক কিশোর প্রতিদিন ৮০ মাইল পার হয়ে যাচ্ছে ফুটবল অনুশীলন করতে। কখনো তিন-চার বার করেও বাস বদলাতে হয়েছে তাকে। ১০ বছর বয়সে কায়রোর ক্লাব এল মকালুনের চোখে যখন পড়ে গিয়েছেন, সালাহ জানতেন ফুটবলই তাঁর নিয়তি। বাবা-মার খুব বেশি কিছু করার সামর্থ্য ছিল না, তবে সন্তানের ফুটবলার হওয়ার ইচ্ছায় তাঁরা বাধ সাধেননি। তবে এমন কত কিশোরই তো ফুটবলার হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে কায়রোতে যায়, কজনই বা টিকে থাকে! তবে স্বল্পবাক, স্মিতভাষী সালাহ জানতেন, মানুষ তাঁর স্বপ্নের সমান বড়। সেই স্বপ্নের পেছনে তাড়া করতে করতেই সালাহ হয়ে গেছেন মিশরের মুখ।  

    ***

    অথচ কী অদ্ভুত, কিশোর সালাহ কিন্তু ছিলেন একজন লেফট ব্যাক। তাঁর মধ্যে যে বারুদ লুকিয়ে আছে, সেটা প্রথম চোখে পড়েছিল এল মকালুনের কোচ হামদি নুহের। ‘ওকে আমি বলেছিলাম, রক্ষণ তোমার জায়গা নয়। আর বাঁ পায়ের পাশাপাশি ডান পাও একটু ভালোমতো ব্যবহার করতে শেখো।’ এত বছর পর সে হামদি হাসিমুখে বলেছেন, সালাহ তাঁর উপদেশ ঠিকঠাক মেনে নিয়েছিলেন। ফলটা এলো হাতেনাতে, মকালুনের অনূর্ধ্ব-১৪ ও ১৫ দলের হয়ে পরের দুই বছর সালাহ করলেন ৬০ গোল। হামদি বলছেন, ‘খুব বেশি কথা বলত না ও, চুপচাপ শুধু শুনে যেত। কারও সঙ্গে মারামারি দূরে থাক, কথা কাটাকাটিও করতে দেখা যায়নি’। আজ, এমন মহিরুহ হয়েও সালাহ আগের মতো সেই স্বল্পবাকই আছেন। এখনও তাঁর এলাকায় গেলে আত্মীয়স্বজনরা টিভি ক্যামেরার সামনেও খুব একটা আসতে রাজি হন না। সালাহ বারণ করেছেন, প্রচারমাধ্যমের সামনে বেশি কথা বললে অনেক উটকো বিতর্ক হতে পারে। নিজেও মিডিয়ার সামনে খুব একটা মুখ খোলেন না।  স্থানীয় স্কুলের শিশুদের জন্য অকাতরে দান করেছেন, দেশকে বিশ্বকাপে নিয়ে যাওয়ার জন্য বোনাসের পুরোটাই দান করে নিয়েছেন নাগরিগের উন্নয়নে। এসবও জানা গেছে অনেক পরে। অনেকের জন্য আরও অনেক কিছুই করেছেন, যেটা জানে না কেউ। নাগরিগের মারওয়ান ইসাই এক বাক্যেই সবকিছু বলে দিচ্ছেন, ‘মানুষের জন্য সে কী করেছে, সেটা শুধুই তার আর আল্লাহ পাকের ব্যাপার।’

    ***

    সালাহর এই সাদাসিধে, নাড়ির কাছাকাছি থাকার ব্যাপারটাই তাঁকে বোধ হয় আর দশজনের চেয়ে আলাদা করেছে। সালাহর যখন ফুটবলার হিসেবে বেড়ে ওঠা, মিশর কাটাচ্ছে অস্থির একটা সময়। আরব বসন্তের ডাক এসেছে, আবার সেই বসন্ত মিলিয়ে গেছে সাহারার মরীচিকায়। মুদ্রাস্ফীতি বেড়েছে, সংগ্রাম বেড়েছে মানুষের। আবদেল হালিম নামের একজন বলেছেন, ওই সময়ে মানুষের ফুটবল নিয়ে সেই অর্থে আগ্রহও ছিল না। মুসলিম ব্রাদারহুডের বিদায়ের পর নতুন প্রেসিডেন্ট আবদেল ফাত্তাহ আল সিসি এসেছেন, তবে মানুষের সংগ্রাম তো আর কমেনি। তবে সালাহ নামটা হয়ে গেছে সব হতাশা ভুলে থেকে ফুটবলে বুঁদ হয়ে থাকার এক অব্যর্থ টনিক। সালাহ সব রকমের রাজনীতি থেকে নিজেকে সযতনেই দূরে রেখেছেন। দেশের জন্য অবশ্য কম করেননি, আল সিসির ‘উন্নত মিশর’  প্রকল্পে যেমন দুই লাখ ব্রিটিশ পাউন্ড অনুদান দিয়েছেন। তবে সালাহ দিন শেষে ব্রাদারহুড বা সিসির নয়, পুরো মিশরেরই। সেজন্যই প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে অন্য প্রার্থীদের বাদ দিয়ে তাঁর নাম লিখে আসেন লাখ লাখ মিশরীয়। পুরো মিশরে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে তাঁর নামে ছাপা হয় লাখ লাখ পোস্টার, রাজনীতি না করেই। মিশরের চতুর্থ পিরামিড; শেষ ফারাও, যা-ই বলুন, সালাহর জন্য এসব কিছুই আসলে যথেষ্ট নয়। মানুষের হৃদয়ে এমন ঠাঁই পেয়ে গেলে নশ্বর মুকুটের আর কি দরকার?