বিশ্বকাপের ব্যবচ্ছেদ: গ্রুপ 'বি'
স্পেন
বিশ্বকাপের একদিন আগেই কোচ হুলেন লোপেতেগিকে বরখাস্ত করেছে স্প্যানিশ ফেডারেশন। নিজেদের প্রথম ম্যাচের মাত্র দিন দুয়েক আগে দিয়ে ফেডারেশনের এমন সিদ্ধান্তে স্বাভাবিকভাবেই টালমাটাল স্প্যানিশ ক্যাম্প। এর ঘণ্টা পরেই সাবেক স্প্যানিশ ডিফেন্ডার ফার্নান্দো হিয়েরোকে কোচ হিসেবেও ঘোষণা করে দিয়েছেন ফেডারেশন প্রেসিডেন্ট লুইস রুবিয়ালেস। গত দুই দিনের এই মানসিক ধাক্কাটা স্পেন আসলে ঠিক কতটা সামলে নিতে পারবে- তা হলফ করে বলা যাচ্ছে না এখনই। তবে স্পেনের 'প্লাস পয়েন্ট' হল, অনেকদিন ধরেই একসাথে খেলছেন রামোস-ইনিয়েস্তা-ইস্কোরা। এই অবস্থায় সিনিয়ররা এগিয়ে আসলে ভাল কিছুর আশা হয়ত তারা করতেই পারে। নিঁখুত বাছাইপর্ব, দুর্দান্ত স্কোয়াড, অভিজ্ঞতার সাথে তারুণ্যের চমৎকার মিশেল- সব মিলিয়ে এবারের বিশ্বকাপের অন্যতম দাবিদার স্পেন। ২০১৪-এর হতাশাকে শক্তি এবং ২০১০-এর স্মৃতিকে অনুপ্রেরণা হিসেবে নিয়েই রাশিয়া যাচ্ছেন 'লা রোহা'রা।
রাশিয়া বিশ্বকাপে স্পেনের হেডকোচের গুরুদায়িত্ব থাকবে তাঁর কাঁধে- সপ্তাহখানেক আগেও হয়ত এমনটা ঘুণাক্ষরেও ভাবেননি স্পেনের নতুন কোচ ফার্নান্দো হিয়েরো। কোচিং অভিজ্ঞতা বলতে কেবল স্প্যানিশ দ্বিতীয় বিভাগের দল রিয়াল ওভিয়েদোর কোচ ছিলেন তিনি। এর আগে ২০১৪-১৫ মৌসুমে ছিলেন রিয়াল মাদ্রিদে কার্লো আঞ্চেলত্তির সহকারী। একেবারেই অনভিজ্ঞ হিয়েরোর ওপর আস্থা রাখার এ 'জুয়া'টা ঠিক কতটা সফল হবে- তাই এখন দেখার বিষয়।
শক্তি
- খুব সম্ভবত এবারের বিশ্বকাপের সেরা রক্ষণ তাদেরই। পুরো বাছাইপর্বে মাত্র ৩ গোল হজম করেছিল স্পেন। রামোস, পিকেদের দুর্ভেদ্য দেয়ালের সাথে দুই ফুলব্যাক পজিশনে কারভাহাল-আলবা এক কথায় অনন্য। প্রতিপক্ষের আক্রমণভাগকে রুখে দেওয়া তো বটেই, সেই সাথে আক্রমণে ইস্কো-আসেন্সিওদের বল যোগানেও সমান পারদর্শী তারা। আর কাউন্টারপ্রেসিং-এও সমান দক্ষ 'লা রোহা'রা।
- গোলের জন্য কেবল ফরওয়ার্ডদের ওপর নির্ভর করার চিন্তা নেই হিয়েরোর। বাছাইপর্বেই স্পেন প্রমাণ করেছে; পজিশন যা-ই হোক, দলের প্রয়োজনে গোল করার সামর্থ্য রাখেন মূল একাদশের প্রায় সবাই-ই।
দুর্বলতা
- স্কোয়াডে জায়গা হয়নি আলভারো মোরাতার। বিশ্বকাপের মাত্র সপ্তাহখানেক আগে স্পেনের মূল স্ট্রাইকার কে- এমনটা হয়ত নিশ্চিতভাবে জানেন না হিয়েরো নিজেও। সেক্ষেত্রে আক্রমণভাগের ফুটবলারদের মধ্যে বোঝাপড়ার অভাবটা গ্রুপপর্বে তেমন না ভোগালেও নকআউট পর্বে বেশ বেগ পেতে হতে পারে স্পেনকে।
- টিকিটাকার ফুটবলে অভ্যস্ত স্পেনের পজেশন ধরে রেখে গোলমুখে শট নেওয়ার অনীহা বাছাইপর্বে চোখে পড়েছে বেশ। শট করার চেয়ে মাঝমাঠে পাসিং-এর ওপর স্প্যানিশদের জোর মনোনিবেশ রাশিয়ায় বেশ ভোগাতে পারে হিয়েরোর দলকে।
ভবিষ্যতবাণীঃ গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হয়ে দ্বিতীয় রাউন্ডে, সেখান থেকে সেমিফাইনালে
পর্তুগাল
রোনালদো সহ অদম্য, রোনালদো ছাড়া নিতান্তই সাধারণ- পর্তুগালের চিরচেনা এই রূপ আরও প্রকটভাবে ধরা দিয়েছিল এবারের বাছাইপর্বে। অধিনায়ক ছাড়া খেলা একমাত্র ম্যাচেই হেরেছিল ফার্নান্দো সান্তোসের দল, জিতেছে তাকে নিয়ে খেলা বাকি ৯ ম্যাচ। রাশিয়া বিশ্বকাপে কোনো একজন ফুটবলারের ওপর নির্ভরশীলতার বিচারে মিশরের পরই খুব সম্ভবত স্থান পর্তুগিজদের। সবসময় 'ডার্ক হর্স' হয়ে থাকা পর্তুগাল ইউরো জয়ের পর থেকে এখন তাল মিলিয়ে চলছে জার্মানি-স্পেনদের সাথে।
দেশের হয়ে নিজের প্রথম টুর্নামেন্টেই বাজিমাতের সুখস্মৃতি নিয়েই রাশিয়া যাচ্ছেন সান্তোস। পর্তুগালের নবাগত সোনালী প্রজন্মকে বেঁধেছেন এক সূতোয়। রোনালদো নির্ভরশীলতা কমিয়ে দলগত নৈপুণ্যের দিকে নজর দিচ্ছেন বেশি। সচরাচর রোনালদো, সিলভাকে সামনে নিয়ে ৪-৪-২ ফর্মেশনে খেলানো পর্তুগাল ৪-২-৩-১ বা ৪-৫-১ ফর্মেশনেও সমান কার্যকরী। সাধারণত দুই স্ট্রাইকার নিয়ে দল সাজাতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করা সান্তোস টুর্নামেন্টের বড় ম্যাচগুলোয়, বিশেষ করে গ্রুপপর্বে স্পেনের বিপক্ষে, একজন স্ট্রাইকার নিয়ে খেললেও অবাক হওয়ার অবকাশ থাকবে না তেমন একটা।
শক্তি
- বয়স ৩৩, তারপরও খুব সম্ভবত সেরা ফর্মেই রাশিয়া যাচ্ছেন রোনালদো। সাথে আছেন তরুণ প্রজন্মের দুই সিলভা (আন্দ্রে এবং বের্নার্দো), জেলসন আর পুরনো দিনের সতীর্থ কারেসমা, মুতিনিয়োরা। সব মিলিয়ে গোলাবারুদের রসদটা পরিপূর্ণই আছে পর্তুগালের। রোনালদো জ্বলে উঠলে পর্তুগালের অপ্রত্যাশিত কিছু করে ফেলাটা খুব আশ্চর্যজনক হবে না একেবারেই।
- জয়ের মানসিকতাটা দলের মাঝে বেশ দারুণভাবেই ঢুকিয়ে দিয়েছেন সান্তোস। '১৪ বিশ্বকাপের ব্যর্থতার পর মাত্র ২টি প্রতিযোগীতামূলক ম্যাচ হেরেছে পর্তুগাল। শেষ পর্যন্ত লড়াই করে যাওয়ার দুর্দান্ত এক দৃষ্টান্ত স্থাপন করে এসেছে সান্তোসের দল।
দুর্বলতা
- যত সোনালী প্রজন্মই আসুক, যেকোনো ম্যাচে জয়ের জন্য পর্তুগালের ভরসার একমাত্র প্রতীক সেই রোনালদোই। বাছাইপর্বে ১৫ গোল করে দলকে রাশিয়ার টিকেট এনে দিয়ে আবারও প্রমাণ করেছেন নিজের অপরিহার্যতা। নির্ভরশীলতার এই খোলস ছেড়ে এখনও বেরিয়ে আসতে পারেনি তারা। রাশিয়া বিশ্বকাপে রোনালদো কোনো ম্যাচে জ্বলে ,উঠতে না পারলে সে ম্যাচ থেকে তাদের খালি হাতেই ফেরার সম্ভাবনা প্রবল
- তারুণ্যের জয়গান সমৃদ্ধ এক স্কোয়াড নিয়ে রাশিয়া গেলেও পর্তুগালের রক্ষণভাগ যেন রীতিমত বয়সের ভারে ন্যুব্জ। দুই তরুণ ফুলব্যাক গেরেরো-সিলভার সাথে রক্ষণের মাঝে আছেন পেপে-ফন্ট, আলভেজরা; যাদের গড় বয়সই ৩৩ বছর! স্পেন-ইরান-মরক্কোর মত তরুণ প্রতিপক্ষের গতির সাথে কিভাবে খাপ খাইয়ে নেন, তা-ই এখন দেখার বিষয়।
ভবিষ্যতবাণীঃ গ্রুপ রানার আপ হয়ে দ্বিতীয় রাউন্ডে, সেখান থেকে কোয়ার্টার ফাইনালে
মরক্কো
বিশ্বকাপে মরক্কো নাম শুনলেই স্মৃতিপটে মনে পড়ে '৮৬-এর বিশ্বকাপ। ইংল্যান্ড, পোল্যান্ড, পর্তুগাল থাকলেও গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হয়েই শেষ ষোলতে গিয়েছিল মরক্কো। প্রথম আফ্রিকান দল হিসেবে বিশ্বকাপের নকআউট পর্বে গিয়েছিল তারা। কিন্তু সেই সুদিন এখন কেবলই ইতিহাস মরক্কোর জন্য। এরপর দুই বিশ্বকাপে ('৯৪ এবং '৯৮) অংশ নিলেও বিদায় নিতে হয়েছে গ্রুপপর্ব থেকেই। দীর্ঘ দুই দশক পর আবারও বিশ্বকাপের মূলপর্বে মরক্কো। আবারও প্রতিপক্ষ ইউরোপের রাঘব-বোয়ালরা। '৮৬-এর স্মৃতি রোমন্থনের অনুপ্রেরণা নিয়েই রাশিয়া যাচ্ছে 'অ্যাটলাস লায়ন'রা।
কোচ হার্ভি রেনার্ড আফ্রিকান ফুটবলের অন্যতম সেরা কোচ। গত ৬ বছরে দু'বার আফ্রিকান কাপ অফ নেশন্স জেতা ফরাসী এই কোচের অধীনে অপরাজিত বাছাইপর্ব শেষ করেই রাশিয়ার টিকেট পাকা করেছে তারা। ৪-২-৩-১ ফর্মেশনে মরক্কোকে বানিয়েছেন আফ্রিকার অন্যতম সেরা দল। পজেশন ধরে রাখার সাথে প্রতি আক্রমণেও দুর্দান্ত মরক্কোর ইতিহাস পুনরাবৃত্তির নীলনকশা বানানোর গুরুদায়িত্বটা তাই বর্তাচ্ছে রেনার্ডের ওপরই।
শক্তিঃ
- নিঃসন্দেহে আফ্রিকার দলগুলোর মধ্যে সেরা রক্ষণভাগ মরক্কোর। পুরো বাছাইপর্বে একবারও গোল হজম করেনি রেনার্ডের দল। স্পেন, পর্তুগালকে টপকে দ্বিতীয় রাউন্ডে যেতে হলে এই রক্ষণের দিকেই তাকিয়ে থাকবে মরক্কো।
- প্রতি আক্রমণেও সমান পারদর্শী মরক্কো। পজেশন ফুটবলের চেয়ে বল পায়ে থাকার সময়টুকুই কাজে লাগানোতে বেশ পটু তারা।
দুর্বলতাঃ
- দলের অর্ধেকেরই বয়স ত্রিশের কোঠায়। ওদিকে প্রতিপক্ষে তারুণ্যের জয়জয়কার। তরুণদের গতি, স্ট্যামিনার বিপক্ষে কেমন প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারে মরক্কো; তা-ই দেখার বিষয়
- দু'দশক পর বিশ্বকাপের মূল আসরে খেলতে নামায় দলের কারোই অভিজ্ঞতা নেই ফুটবলের শ্রেষ্ঠ মঞ্চে খেলার। অনভিজ্ঞতাই হয়ত কাল হয়ে দাঁড়াতে পারে রেনার্ডের দলের জন্য। এছাড়া বাছাইপর্বে গোলের তেমন দেখা না পাওয়া মরক্কোর জন্য স্পেন, পর্তুগালের রক্ষণভেদ করা যেন পাহাড়সম কোনো কাজ।
ভবিষ্যতবাণীঃ কোনো জয় ছাড়াই প্রথম রাউন্ড থেকে বিদায়
ইরান
গত কয়েক বছর ধরেই এশিয়ার অন্যতম সেরা দল তারা। ব্রাজিলের পর দ্বিতীয় দল হিসেবে রাশিয়ার টিকেট নিশ্চিত করেছিল ইরান। কিন্তু ৪বার বিশ্বকাপ খেললেও কোনোবারই গ্রুপপর্বের গেরো কাটাতে পারেনি এশিয়ার 'পার্সিয়ার সিংহ'রা। এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সর্বোচ্চ র্যাঙ্কিং নিয়েই রাশিয়া যাচ্ছে ইরান।
মূল দলে নয়, বরং ইরানের সবচেয়ে বড় তারকা কিন্তু ডাগআউটে। ইরানের হেডকোচ হয়ে টানা দ্বিতীয় বিশ্বকাপে যাচ্ছেন কার্লোস কুইরোজ। দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই ইরানের ফুটবলে এনেছেন দারুণ এক পরিবর্তন। রক্ষণাত্মক ভঙ্গি থেকে সরে এসে দলকে বানিয়েছেন আক্রমণাত্মক। ৪-৫-১ ফর্মেশনে সর্দার আজমুনের গোল করার ক্ষমতার ওপর অনেকটাই নির্ভর করবে ইরানের আশা-ভরসা।
শক্তিঃ
- বাছাইপর্বে নিজেদের শেষ ম্যাচে সিরিয়া ছাড়া আর কোনো দলের বিপক্ষেই গোল হজম করেনি ইরান। কুইরোজের হাত ধরে গড়া উঠা এই ইস্পাতদৃঢ় রক্ষণের ওপরই অনেকটা নির্ভর করছে এশিয়ার সেরা রক্ষণভাগের ওপর।
- মাঝমাঠ এবং রক্ষণের ফুটবলারদের মাঝে চমৎকার সমন্বয়ের প্রভাব স্পষ্ট। নিজেদের দিনে গ্রুপের দুই রাঘব-বোয়ালকে সমস্যায় ফেলতেই পারে ইরান।
দূর্বলতাঃ
- বাছাইপর্বে দারুণ ধারাবাহিকতার পরিচয় দিলেও বিশ্বমানের প্রতিপক্ষের বিপক্ষে ইরানের ম্যাচসংখ্যা একেবারেই হাতেগোনা। সেক্ষেত্রে রাশিয়ায় শিরোপা দাবিদারদের সাথে বেশ ঝামেলা পোহাতে হতে পারে।
- বাছাইপর্বের ১০ ম্যাচে মাত্র ১০ গোল করেছে ইরান। সিরিয়া, কোরিয়া, চীনের মত দেশগুলোর বিপক্ষে জাল খুঁজে পেতে গলদঘর্ম হওয়া ইরান রামোস, পেপেদের মত রক্ষণ আদৌ ভেদ করতে পারবে কি না, তা নিয়ে আছে জোর সংশয়।
ভবিষ্যতবাণীঃ তৃতীয় হয়ে গ্রুপপর্ব থেকে বিদায়