বিশ্বকাপের ব্যবচ্ছেদ: গ্রুপ 'সি'
ফ্রান্স
ফেভারিটদের তালিকায় শীর্ষেই আছে ফ্রান্স। ২৩ জনের স্কোয়াডে তারুণ্যের জয়গান, বাছাইপর্বে গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হয়েই রাশিয়ার টিকেট নিশ্চিত করেছে দিদিয়ের দেশমের দল। ২০০৬-এ তীরে এসে তরী ডুবলেও পরের দুই বিশ্বকাপ ছিল দুঃস্বপ্নের মতই। কিন্তু তারকামণ্ডিত এই স্কোয়াডই ফ্রান্সবাসীকে স্বপ্ন দেখাচ্ছে দুই দশক পর আবারও ১৮ ক্যারেটের স্বর্ণশিরোপা ঘরে তোলার।
'৯৮-এর সেই বিশ্বজয়ী ফরাসী দলের অধিনায়ক দেশম নিজের দেশের হয়ে যাচ্ছেন টানা দ্বিতীয় বিশ্বকাপে। বাছাইপর্বে তরুণদের থেকে আদায় করে নিয়েছেন সেরাটাই। ৪-৩-৩ বা ৪-৪-১-১ ফর্মেশনে ফ্রান্সের চোখ ধাঁধানো ফুটবল নজর কেড়েছে সবারই। কয়েকদিন আগে ইতালিকে প্রীতি ম্যাচে হারিয়ে বিশ্বকাপের প্রস্তুতিটাও ভালমতই সেরে নিয়েছে তারা। তরুণরা জ্বলে উঠলে ১৫ জুলাই লুঝনিকি স্টেডিয়ামে দেশমের হাতেই হয়ত দু'দশক পর আবারও বিশ্বকাপ উঁচিয়ে ধরবে ফ্রান্স।
শক্তিঃ
- শুধুমাত্র স্কোয়াডের বিচারে খুব সম্ভবত রাশিয়া বিশ্বকাপের সেরা দল ফ্রান্স। প্রত্যেক পজিশনেই মূল একাদশ ছাড়াও 'ব্যাক আপ' ফুটবলাররাও স্বনামধন্য একেকজন। 'স্কোয়াড ডেপথ' বিচারে ফরাসীদের ধারেকাছে নেই তেমন কেউই। তাই রাশিয়ায় দলের কেউ ইনজুরিতে পড়লে তেমন দুশ্চিন্তায় পড়তে হবে না দেশমকে।
- মিডফিল্ডার বা ফরোয়ার্ড- ফ্রান্সের রক্ষণের সামনের যে কেউই ম্যাচের মোড় ঘুরিয়ে দিতে পারেন নিমিষেই। কোনো ম্যাচে গ্রিযমান-এম্বাপ্পেরা জ্বলে উঠতে না পারলে পগবা-ফেকিরদেরও ম্যাচ জিতিয়ে দেওয়ার ক্ষমতা আছে।
দুর্বলতাঃ
- বিশ্বকাপের সপ্তাহখানেক বাকি থাকতে এখনও নিজেদের ফর্মেশন নিয়ে নিশ্চিত নন খোদ দেশম। এম্বাপ্পে, গ্রিযমান, ডেম্বেলে, জিরুদের কে কোথায় খেলবেন- এই অনিশ্চয়তার কারণেই হয়ত ম্যাচে বোঝাপড়ার ঝামেলায় পড়তে হতে পারে ফরাসীদের। ফ্রান্স সমর্থকদের জন্য সেটা মোটেই স্বস্তির নয়।
- বাছাইপর্বে চ্যাম্পিয়ন হলেও ফ্রান্সের ম্যাচ নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা নিয়ে আছে যথেষ্ট সংশয়। অপেক্ষাকৃত সহজতর গ্রুপে পড়ায় তেমন সমস্যার সম্মুখীন না হলেও ব্রাজিল-জার্মানিদের বিপক্ষে বেশ বেগ পেতে হতে পারে ফ্রান্সকে।
ভবিষ্যতবাণীঃ গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হয়ে দ্বিতীয় রাউন্ডে, সেখান থেকে সেমিফাইনালে
ডেনমার্ক
ব্রাজিল বিশ্বকাপে সুযোগ হয়নি। আরেকটু হলেই রাশিয়া বিশ্বকাপেও থাকতে হত দর্শক হিসেবেই। কিন্তু প্লে-অফে আয়ারল্যান্ডকে হারিয়ে রাশিয়ার টিকেট পাকা করেছে ডেনিশরা। '৮৬ বা '৯৮-এ কোয়ার্টারে উঠার সুখস্মৃতিকে অনুপ্রেরণা হিসেবে নিয়েই প্রতিদ্বন্দ্বীতা করবে ডেনমার্ক।
ডেনমার্ককে নিয়ে নিজের প্রথম আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টে যাচ্ছেন কোচ আগা হারিডা। দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই হাজারো সমালোচনার সম্মুখীন হলেও দলকে এক সূতোয় বেঁধে ঠিকই এনে দিয়েছেন বিশ্বকাপের মূল পর্বের টিকেট। ৪-২-৩-১ ফর্মেশনে এরিকসেন-ডলবার্গদের থেকে আদায় করে নিয়েছেন সেরাটাই। 'সি' গ্রুপ থেকে দ্বিতীয় রাউন্ডে ফ্রান্সের সঙ্গী হতে হলে কোচের ট্যাকটিক্যাল মস্তিষ্কের কারসাজির আশাতেই তাকিয়ে থাকবে ডেনমার্কবাসী।
শক্তিঃ
- শারীরিক শক্তিমত্তা বিবেচনায় এই বিশ্বকাপের অন্যতম সেরা দল ডেনমার্ক। 'পাওয়ার ফুটবল' দিয়ে পোল্যান্ডের মত দলকেও কুপোকাত করেছে তারা। মাঝমাঠ বা রক্ষণের লড়াইয়ে ডেনিশদের এই বৈশিষ্ট্য বেশ কাজে দিবে
- 'সেটপিস' থেকে ডেনমার্কের দক্ষতা দুর্দান্ত। পুরো বাছাইপর্বে করা ২০ গোলের ৯টিই এসেছে কর্ণার বা ফ্রিকিকে করা হেড থেকে। এছাড়া ক্রিশ্চিয়ান এরিকসেনের ফ্রিকিক দক্ষতার কথা সবারই জানা। তাই ডেনিশদের ডিবক্সের আশেপাশে ফাউল করার আগে অন্তত দু'বার চিন্তা করাটা আসে প্রতিপক্ষের
দূর্বলতাঃ
- রক্ষণে, বিশেষ করে ফুলব্যাক পজিশনে কে খেলবে- সেটা হয়ত নিশ্চিতভাবে জানেন না হারিডা নিজেও। জার্গেনসন-ভেস্টারগার্ড না ডালসগার্ড-স্ট্রাইগার্ড; রক্ষণে এই অনিশ্চয়তা বড় দলগুলোর বিপক্ষে ভোগাতে পারে ডেনিশদের
- 'মিডফিল্ড মায়েস্ত্রো' এরিকসেনের ওপর অতিরিক্ত নির্ভরশীল তারা। গোল করা, করানো থেকে মাঝমাঠে এসে খেলা নিয়ন্ত্রণ করা- সবখানেই ডেনিশদের ভরসার নাম স্পার্সের মিডফিল্ডার। কোনো কারণে এরিকসেন মিইয়ে গেলে বেজে যাবে ডেনমার্কের বিশ্বকাপ থেকে বিদায়ঘণ্টাও।
ভবিষ্যতবাণীঃ গ্রুপ রানার-আপ হয়ে দ্বিতীয় রাউন্ডে
অস্ট্রেলিয়া
বাছাইপর্ব শেষে প্লে-অফ খেলেছে অনেক দলই। কিন্তু অস্ট্রেলিয়াকে প্লে-অফই খেলতে হয়েছে দুই রাউন্ড, সিরিয়া এবং হন্ডুরাসের বিপক্ষে। ৩১তম দল হিসেবে রাশিয়া বিশ্বকাপের টিকেট নিশ্চিত করেছে সকারু'রা। বিশ্বকাপের বাছাইপর্বের ইতিহাসে কখনোই এত ম্যাচ খেলতে হয়নি কোনো দলকেই। শত চড়াই-উৎরাই পার হয়ে নিজেদের টানা ৪র্থ বিশ্বকাপে খেলতে এসেছে অস্ট্রেলিয়া।
বিশ্বকাপের ইতিহাসে বার্ট ফন মারউইকের নামটা লেখা থাকবে নেদারল্যান্ডসকে ২০১০-এর ফাইনালে নিয়ে যাওয়ার জন্য। কোচ অ্যাঞ্জি পস্তেকগলুর থেকে দায়িত্ব নিয়েছেন বাছাইপর্ব শেষে। নিজের পছন্দের ফর্মেশন ৪-২-৩-১ বা ৪-৩-৩ এই খেলিয়েছেন প্রীতি ম্যাচগুলোতে। 'সি' গ্রুপ থেকে ফ্রান্সের সঙ্গী হতে হলে আবারও মারউইকের চমকে দেওয়ার ক্ষমতার দিকেই তাকিয়ে থাকবে অস্ট্রেলিয়াবাসী।
শক্তিঃ
- মানসম্পন্ন মিডফিল্ড। অধিনায়ক মাইল জেডিনাক, এবং অ্যারন মুইয়ের আছে ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগের মত বিশ্বমানের লিগে খেলার দীর্ঘ অভিজ্ঞতা। আর টিম কাহিল তো এভারটনের একজন কিংবদন্তীই। বল ধরে রাখার মতই কাহিল, টমি জুরিচদের পাস যোগানোতেও সিদ্ধহস্ত মুই-জেডিনাকরা।
- মিডফিল্ডারদের সাথে ফরোয়ার্ড লাইনের ওপরও ভরসা করতেই পারেন মারউইক। কাহিল-জুরিচদের সাথে দুই উইংয়ে লুওঙ্গো, লেকির আছে ইউরোপিয়ান ফুটবলের অভিজ্ঞতা। গতি, ড্রিবলিং দিয়ে যেকোনো রক্ষণকেই ঝামেলায় ফেলতে পারে তারা।
দুর্বলতাঃ
- বাছাইপর্ব শেষে দায়িত্ব নেওয়ায় দলকে এখনও নিজের পছন্দ মতো সাজাতে পারেননি মারউইক। এ কারণেই অস্ট্রেলিয়ার ফ্রান্সের সঙ্গী হিসেবে পরের রাউন্ডে যাওয়ার সম্ভবনা কমই।
- মিডফিল্ড এবং উইঙ্গাররা ভাল খেললেও অস্ট্রেলিয়ার গোল করার ক্ষমতা নিয়ে আছে যথেষ্ট সংশয়। বাছাইপর্বে খেলা ১৪ ম্যাচে মাত্র ২২বার লক্ষ্যভেদ করেছিল অস্ট্রেলিয়া, গোল হজম করেছিল ১৪টি। বেশ নড়বড়ে রক্ষণ হওয়ায় আক্রমণভাগের খেলোয়াড়দের দিকেই তাকিয়ে থাকতে হবে মারউইককে। কিন্তু বাছাইপর্বের মত খেললে খুব সম্ভবত গ্রুপপর্বের পরই দেশের ফিরতি প্লেন ধরতে হতে পারে তাদের।
ভবিষ্যতবাণীঃ কোনো ম্যাচ না জিতেই প্রথম রাউন্ড থেকে বিদায়
পেরু
বাছাইপর্বে ৫ ম্যাচ বাকি থাকতে দক্ষিণ আমেরিকার ১০ দলের মধ্যে অবস্থান ৮ম। আবারও আরেকটি বিশ্বকাপ দর্শক হয়েই দেখার মানসিক প্রস্তুতিতে তখন সমগ্র পেরু। কিন্তু তখনই ভাগ্যদেবী মুখ তুলে তাকালেন তাদের দিকে। বলিভিয়া অবৈধ এক ফুটবলারকে খেলিয়ে পেরুকে উপহার দিল ৩ পয়েন্ট, নতুন প্রাণের সঞ্চার হল পেরুভিয়ানদের মাঝে। ওদিকে বাছাইপর্বের শেষ ৬ ম্যাচে অপরাজিত থেকে ১২ পয়েন্ট আদায় করে ঠিকই প্লে-অফের টিকেট নিশ্চিত করেছিল তারা। আর প্লে-অফে নিউজিল্যান্ডকে হারিয়ে শেষ দল হিসেবে রাশিয়ার টিকেট পাকা করেছে তারা, পেয়েছে ৩২ বছর পর বিশ্বকাপ খেলার সুযোগ।
দক্ষিণ আমেরিকার ক্লাব পর্যায়ে কোচিং করিয়ে 'এল টাইগার' নাম হয়ে গিয়েছিল পেরুর বর্তমান কোচ রিকার্ডো গারেচা। এবারের বাছাইপর্বে যেন নিজের ডাকনামের যথার্থতাই প্রমাণ করেছেন তিনি। ৭ ম্যাচ শেষে মাত্র ৭ পয়েন্ট নিয়ে পেরু যখন ধুঁকছে, তখনও আশা হারাননি গারেচা। দলকে একতাবদ্ধ করে খেলিয়েছেন স্বভাবসুলভ আক্রমণাত্মক এবং উইংনির্ভর খেলা, যার কারণেই দক্ষিণ আমেরিকাজুড়ে তার নামডাক। পেরুও সাড়া দিয়েছে কোচের আস্থায়, অনুপ্রেরণায়। ৪-৪-২ বা ৪-৪-১-১ ফর্মেশনেও সমান দক্ষতা দেখিয়েছে গারেচার পেরু।
শক্তিঃ
- গারেচার পছন্দের উইংনির্ভর ফুটবলে আগে থেকেই বেশ দক্ষ পেরু। দুই উইঙ্গার আন্দ্রে কারিও এবং এডিসন ফ্লোরেস গতি, ড্রিবলিংয়ের সাথে মাপা ক্রসেও প্রতিপক্ষের রক্ষণকে ঝামেলায় ফেলতে সিদ্ধহস্ত। প্রতি আক্রমণেও বেশ দক্ষ তারা।
- বাছাইপর্বের নাটকীয়তার পর স্বাভাবিকভাবেই আত্মবিশ্বাসে টইটুম্বুর পেরু। সেক্ষেত্রে ফ্রান্সের বিপক্ষেও নির্ভীক ফুটবল খেললে খুব একটা অবাক হওয়ার কিছুই থাকবে না। শেষ মুহুর্তে পাওলো গেরোরোকে রাশিয়ার যাওয়ার অনুমতি পাওয়া দলে অনুপ্রেরণা যুগিয়েছে আরও। আত্মবিশ্বাস একটি দলকে কতদূর নিয়ে যেতে পারে, গতবার তা প্রমাণ করেছিল কোস্টারিকা। এবারের 'ডার্ক হর্স' হিসেবে পেরু এক রূপকথার জন্ম দিলেও অবাক হওয়ার অবকাশ থাকবে না তেমন একটা।
দুর্বলতাঃ
- দুর্বল রক্ষণভাগ বেশ পোড়াতে পারে পেরুকে। বাছাইপর্বের ১৮ ম্যাচে ২৬ গোল হজম করেছে তারা। আর গারেচার আক্রমণাত্মক ফুটবলের জন্য প্রায় ম্যাচেই প্রতিপক্ষের প্রতি আক্রমণে দিশেহারা হয়ে পড়তে দেখা গেছে পেরুকে। গ্রুপপর্বে রক্ষণটা জমাট না রাখতে পারলে হয়ত ৩২ বছর পর খেলতে আসা বিশ্বকাপটা এক দুঃস্বপ্নই হয়ে থাকবে গারেচার দলের জন্য।
- বয়স এখন তার ৩৪, কিন্তু পাওলো গুরেরোর ওপর থেকে নির্ভরশীলতা এখনও কমাতে পারেনি পেরু। উইঙ্গার এডিসন ফ্লোরেস বাছাইপর্বে তার সমান ৫ গোল করলেও গুরেরোর রীতিমত অতুলনীয় পেরুর দলে। ড্রাগ টেস্টের নাটকের পর অবশেষে বিশ্বকাপে খেলার সবুজ সংকেত পেয়েছেন ঠিকই, কিন্তু বয়সের ভারে মূল পর্বে গুরেরো গড়পড়তা পারফরম্যান্স দিলে পেরুর স্বপ্নবাতি নিভে যাবে অচিরেই।
ভবিষ্যতবাণীঃ এক ম্যাচ জিতে গ্রুপপর্ব থেকে বিদায়